আগের পর্বে আলোচনা করেছি, প্রেগন্যান্সি চলাকালীন দাঁত ও মাড়ির কী কী সমস্যা হতে পারে। এই পর্বে আলোচনা করব, তা প্রতিরোধ করার উপায়।
প্রথমেই বলে রাখি, প্রতিরোধ কেন, ও সমাধান নয় কেন। কারণ দাঁতের চিকিৎসাপদ্ধতির অধিকাংশই গর্ভাবস্থায় করা বিভিন্ন কারণে সম্ভব নয়। প্রেগন্যান্সিকে মূলত তিনভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে – প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রিমেস্টার। ভ্রূণের সম্ভাব্য দুর্বলতার কারণে প্রথম ট্রিমেস্টারের সময় দাঁতের চিকিৎসা এড়ানো হয়। দ্বিতীয় ট্রিমেস্টার ও তৃতীয় ট্রিমেস্টারের শুরুর দিক হল সবচেয়ে নিরাপদ সময় যে সময়ে নিয়মিত দাঁতের চিকিৎসা করা যায়। সক্রিয় রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গর্ভাবস্থার পরে বা অবিলম্বে প্রসবোত্তর সময়কালে ঘটতে পারে এমন সম্ভাব্য সমস্যাগুলি দূর করার উপর জোর দেওয়া উচিত, কারণ এই সময়কালে দাঁতের যত্ন নেওয়া প্রায়শই কঠিন। যাইহোক, তৃতীয় ট্রিমেস্টারের মাঝামাঝি থেকে, দাঁতের চিকিৎসা বন্ধ করা ভাল। কারণ বর্ধিত জরায়ুর জন্য তাদের শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য বিঘ্নিত হয় ও এসময়ে দীর্ঘক্ষণ ডেন্টাল চেয়ারে শায়িত থাকলে Supine Hypotensive syndrome দেখা দিতে পারে। এজন্যই দীর্ঘ সময় ধরে চলা দাঁতের চিকিৎসা একবারে করা যায় না, বারবার ছোট অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে হয়। কিন্তু এই শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখেই মনে রাখতে হবে, ‘Prevention is better than cure.’
এইসময়ে কী কী করবেন ও করবেন না, তা একঝলকে বুঝে নেওয়া যাক
১. যেসব দম্পতি পরিকল্পিত গর্ভাবস্থার জন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিচ্ছেন, তাঁরা একই সাথে ডেন্টাল সার্জনেরও পরামর্শ নেওয়া শুরু করুন। প্রেগন্যান্সি শুরুর আগেই দাঁতের যতরকম চিকিৎসা সম্ভব, ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ মতো করিয়ে ফেলুন। এতে গর্ভাবস্থা চলাকালীন দাঁতের সমস্যা কম থাকবে, আগে থেকেই কীভাবে যত্ন নেওয়া সেই পরামর্শও পেয়ে যাবেন। ফলে দাঁতের সমস্যার জন্য অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও ব্যথা সহ্য করতে হবে না।
২. দাঁতে প্লাক নিয়ন্ত্রণ করা ভীষণ প্রয়োজন। প্লাক হল খাবারের অবশিষ্টাংশ, যা দাঁতের ওপরে জমে থেকে তার ওপর মুখের ব্যাকটেরিয়াদের বাড়তে সাহায্য করে, মুখের লালায় থাকা ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফেট ইত্যাদি আয়নের মাধ্যমে ক্যালকুলাস বা দাঁতের পাথর তৈরীতে সাহায্য করে। ব্যাকটেরিয়াদের বৃদ্ধির কারণে দাঁতের কেরিস (ক্যাভিটি), দাঁতে যন্ত্রণা, দাঁতের গোড়ায় পুঁজ জমা, মাড়ির অসুখ দেখা দিতে পারে।
৩. বেশ কিছু স্টাডিতে দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত মাড়ির অসুখের কারণে Preterm Low Birth weight শিশুর জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, এর ফলে শিশুর শারীরিক দুর্বলতা থাকে, অনেকক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটতে পারে। সেজন্যই গর্ভাবস্থায় মাড়ির যত্ন নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
৪. Refined carbohydrates, Carbonated soft drink দাঁতের ক্ষতি করে, প্লাক জমার সম্ভাবনা বাড়ায়। তাই গর্ভাবস্থায় এজাতীয় খাবার থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকাই শ্রেয়।
৫. প্রেগন্যান্সিতে দাঁতের চিকিৎসা বন্ধ রাখার আরেকটা বড় কারণ হল, X ray বা রেডিওগ্রাফ করায় কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকা। দাঁতের চিকিৎসায় রোগ নির্ণয়ে রেডিওগ্রাফ হল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। প্রথম ট্রিমেস্টারে ক্রমবর্ধমান ভ্রূণের ক্ষতি হতে পারে তেজষ্ক্রিয়তা থেকে। কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে এক্সরে নেওয়া গেলেও একান্ত প্রয়োজন ছাড়া গর্ভাবস্থায় তা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। এই কারণেই রোগিণীর স্বেচ্ছায় বা পরিবারের কোন অচিকিৎসক সদস্যের পরামর্শে এক্সরে করানো থেকেও বিরত থাকতে হবে।
৬. প্রেগন্যান্সি চলাকালীন নিজে থেকে কোন ব্যথার ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না। এমন অনেক ওষুধ আছে, যা একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের কোন ক্ষতি করে না, কিন্তু ভ্রূণের চিরস্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। সেজন্যই প্রফেসনাল সাহায্য ছাড়া এসময়ে নিজের চিকিৎসা নিজে করবেন না। একইভাবে যেসব মায়েরা সন্তানকে তাঁদের নিজস্ব দুধ খাওয়ান, তাঁরাও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ নিজে থেকে খাবেন না।
৭. দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, মাউথওয়াশ ও টুথপেস্ট ব্যবহার করুন। এর ফলে আপনার মুখের প্লাক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর প্লাক নিয়ন্ত্রণে থাকলে দাঁতের অনেক সমস্যাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
৮. সময়সাপেক্ষ চিকিৎসাগুলি যদি গর্ভাবস্থার আগে না করিয়ে থাকেন, তাহলে সন্তানের জন্ম হলে একে একে ধীরে সুস্থে করিয়ে নিন।
মোটামুটিভাবে, এই পরামর্শগুলি মেনে চলতে পারলে প্রেগন্যান্সি চলাকালীন দাঁত ও মাড়ির সমস্যা থেকে দূরে থাকা যাবে৷ এর ফলে মা হয়ে ওঠার রাস্তায় আপনার হাসি আরো প্রশস্ত হবে।
সবাই সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন।
তথ্যসূত্র –
১. Dental Management of the Medically Compromised Patient – Little, Falace, Miller, Rhodus
২. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3941365/