সম্পূর্ণ বাংলায়, সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা একটি প্রেসক্রিপশন বেশ ভাইরাল হয়েছে। যিনি লিখেছেন আমি তাঁর অসম্ভব অনুরাগী। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লেখা আমি নিয়মিত পড়ি। সমৃদ্ধ হই। সংশ্লিষ্ট প্রেসক্রিপশনটি প্রায় আদর্শ একটি প্রেসক্রিপশন। ওরকম কিছু লিখতে পারলে আমি গর্ববোধ করতাম। সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় লেখা এরকম প্রেসক্রিপশন বিরলদৃষ্ট। খুব সম্ভবত ভাষা দিবসের আবহে বাঙালির সেন্টিমেন্টও এসে মিশেছে।
তবু, এখানে কয়েকটা জায়গায় আমার খটকা আছে-
১.
কাল একইরকম একটি মালয়ালম ভাষায় লেখা প্রেসক্রিপশন হাতে পেলে তার মর্মোদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আবার, আমার বাংলায় লেখা প্রেসক্রিপশন গুজরাটে গিয়ে পড়লে সেখানের ডাক্তার একই সমস্যায় পড়বেন। আপনি বলতেই পারেন ওষুধের নামগুলো তো ইংরেজিতে লেখা… কিন্তু আপনি বোধহয় ওষুধের নাম ছাড়া প্রেসক্রিপশনের উপদেশ সংক্রান্ত অংশটি নিয়েই বাড়তি উদ্বেল, তাই না?
২.
এভাবে একটি প্রেসক্রিপশন লিখতে ন্যূনতম ১৫ মিনিট সময় লাগার কথা। অর্থাৎ, ঘন্টায় ৪ জন রোগী দেখা হবে। ডাক্তার নাওয়া-খাওয়া ভুলে ৮ ঘন্টা রোগী দেখলে ৩২ জন রোগীকে পরিষেবা দিতে পারবেন। উল্টোদিকে ৩২ নম্বরে থাকা আপনি সকাল ১০ টায় ডাক্তার দেখাতে এসে সন্ধ্যে ৬ টায় ডাক পেলে কতখানি স্বস্তি অনুভব করবেন?
৩.
আমার মতো যেসব অভাগাদের প্রতিদিন এর চেয়ে অনেক, অনেকগুণ বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয় তাঁদের পক্ষে এসব কষ্টকল্পনা। রোগীর বাড়ির লোকের কাছে রোগের ইতিহাস জানা পৃথিবীর অন্যতম শক্ত কাজ। চলুন, একটা উদাহরণ দেখা যাক-
– কী সমস্যা?
– এই ত দ্যাখঅনা মোদের গ্যারামের ডাক্তরের কাছে এউসব ওসুদ খাবাইলি কিচ্ছু হয় নি
– আরে, বাচ্চার কষ্টটা কী?
– ২০০ টাকার ওসুদ কিনছি বাবু। এই ত দ্যাখঅনা…
– ওষুধ পরে দেখবো। আগে কী হয়েছে বলো। কেন ওষুধ খাওয়াচ্ছিলে?
– রোগে ভুগ্যা ভুগ্যা দুবলা হয়েইছ্যা। আর কিচ্ছু খেতে পারে নি গ ছ্যালাটা মোর…
– ওরে বাবা, দয়া করো… বাচ্চার কী অসুবিধে হচ্ছিল সেটা বলো
– অসুবিদা বল্যা অসুবিদা… যি রকম সদ্দিকাশি…
– উঃ! এই এতক্ষণে বেরোলো। তা, কতদিন ধরে সর্দিকাশি?
– যেদিন থ্যিকানু ওসুদ চালু হচ্যা তার তিনদিন আগে
– সেটা কতদিন? কবে থেকে ওষুধ খাচ্ছে? আজ ক’দিন?
– আজ দেড় বচ্ছর ধর্যা ত রোগ লেগ্যাই আছে। কত ওসুদ খাবাইলি…
– সেসব না। এবারের সর্দিকাশিতে কতদিন ওষুধ খাচ্ছে?
– প্যারায় দশদিন হবে…
****
উপরোক্ত ঘটনাকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক মনে করার কোনও কারণ নেই। তারপর ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন এবং ওষুধ লেখা। কী মনে হয়? এরপরেও ওরকম প্রেসক্রিপশন লেখা খুব বাস্তবসম্মত? বলতে চাইছি, লেখা সম্ভব?
এবার বলি, আমি কী করি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ বাংলায় লিখে দিই। ‘বেশি করে জল খাওয়াবেন’, ‘প্রতিদিন ফল, শাকসব্জী দেবেন’, ‘নুনজলে গার্গল করাবেন। গরম জলের ভাপ দেবেন’ ইত্যাদি। কিন্তু, প্রেসক্রিপশনের মোদ্দা কথাগুলো আমি ইংরেজিতেই লিখি। বিশেষত, রেফার করার থাকলে তো বটেই।
আবারও বলছি, বাংলায় লেখা ওই প্রেসক্রিপশনটি অসাধারণ কিন্তু বাস্তবসম্মত নয়। ওষুধ খাওয়ার পরামর্শগুলো বরং ফার্মাসি থেকে বাংলায় লিখে দেওয়া তুলনায় বাস্তবসম্মত।
তবে একটা বিষয় ঠিক, ডাক্তারদের অধিকাংশেরই হাতের লেখা অত্যন্ত খারাপ। তাঁদের বড় হাতের অক্ষরে লেখা উচিত যাতে সবাই পড়ে বুঝতে পারেন। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে বাংলায় লিখে দেওয়াই যায়। সেটা ডাক্তারকেই নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিতে হবে। শুধুমাত্র বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগে ভাসতে গিয়ে আমি অন্তত এরকম প্রেসক্রিপশন করার পক্ষপাতী নই। অনেকেই এরকম একটি আদর্শ প্রেসক্রিপশন দেখে এটিকেই মাপকাঠি ধরে বাদবাকি ডাক্তারদের ‘ইয়ের ইয়ে’ ভেবে ফেলেছেন। সে তাঁরা ভাবুন। ভেবে ফেলার স্বাধীনতা তাঁদের আছে। আমারও নিজের তরফে কৈফিয়তটুকু থাক। বাকিটা আপনাদের বিবেচনা। পক্ষে-বিপক্ষে সব মতামতই স্বাগত। মন খুলে বলুন। আমাদেরও বুঝতে সুবিধে হবে ঠিক কোথায় সমস্যাটা হচ্ছে। দিনের শেষে, রোগী-চিকিৎসক ভুল বোঝাবুঝিগুলো কেটে যাওয়াই সবথেকে বেশি প্রয়োজন।