তারপর হয়েছে কী মুকুুলবাবুুর?! তাঁর একটা চৌষট্টি বছরের পুরোনো পাম্প আছে। সে জন্য চৌষট্টি বছরের পুরোনো জেনসেট আছে। এবং মজার ব্যাপার হল পাম্প, জেনসেট-সহ সব কিছুই চৌষট্টি বছর ধরে একটানা চলছে। এবং কোনো রকম মেরামতি বা সার্ভিসিং ছাড়া।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা হতেই কাঁচা-পাকা গোঁফের ফাঁকে হেসে তিনি বলেন, হুঁ হুঁ বাওয়া – বংশগত সম্পত্তি। সলিড জিনিস। এ সবের কোনো চেকআপ লাগে না। আমরাও ভারী খুশি। হুঁ হুঁ বাবা, সলিড জিনিস। ঠুনকো নয়কো, পলকা নয়কো। কেয়ার করি না। রামদাদা রহিমদাদা আছেন। আমরা ওঁদের মেনে চলি। তবে তা-ই হোক।
আমরা বরঞ্চ এই পাম্পের ব্যাপারে খোঁজখবর করি। এই পাম্প সমানে চব্বিশ ঘণ্টা রাতদিন সাত দিন এক টানা চলেছে। জন্ম থেকেই। পাম্প নেই, তো শ্বাস নেই। কোনো যন্ত্র এমন নেই যা এই ছোটোখাটো শক্তপোক্ত যন্ত্রটা খারাপ হলে তাকে আবার চালাতে পারে। আজ্ঞে না। ওই সব ভেন্টিলেটার, ফেটার – কেউ পারে না। কোটি কোটি টাকা থাকলেও না। সে যতই ইমন আর আনন্দবাবু চব্বিশ ঘণ্টা ধরে বলুন না কেন! তাই থেমে গেলেই রিগর মর্টিস, তাপ্পর পচন মানে পচা।
এই পাম্প থেকে তরল যেটা বেরোয়, সেটাকে আমরা রক্ত বলব। প্রায় প্রতি ০.৮ সেকেন্ডের মধ্যে যতটা জায়গায় রক্ত বয়ে যায় তা প্রায় পৃথিবীকে নিরক্ষরেখা বরাবর এক পাক দেওয়ার সমান। মজাদার ব্যাপার, তাই না? এর পাইপলাইনের ব্যাপার আরও চমৎকার। রক্ত যারা নিয়ে যায় তারা ধমনি আর যারা ফেরত আনে তারা শিরা। একদম গুলিয়ে ফেলবেন না। হাত, পা, মাথা সব জায়গাতেই এরা আছে।
এই পাইপলাইন কী দিয়ে তৈরি? শক্ত নয়, ল্যাতপ্যাতেও নয়, লোহা নয়, ইস্পাতও নয়। তা হলে তো হাত-পা নাড়ানোই যেত না। আবার ল্যাতপ্যাতে রবারও নয়, তা হলে তো বেলুনের মতো ফুলে ফুলে উঠত। এটা মাংসপেশি দিয়ে তৈরি। ইচ্ছেমতো সংকুচিত, প্রসারিত হতে পারে। যদি ভেতরে কোথাও কেটেকুটে যায়, তা হলে বিশেষ কায়দায় রক্ত জমাট বেঁধে দেওয়ার ব্যযবস্থা আছে।
আজ্ঞে এটাই রক্ষা করে। আবার এই ব্যবস্থাটাই গণ্ডগোল পাকায়। বুঝে দেখুন, যে কিনা রক্ষক সেই ভক্ষক। এই সব পাইপ দিয়ে যেমন রক্ত এবং চর্বি, সবই বয়ে চলে। ধরুন আপনি নেশাড়ু। ধোঁয়া এবং মদ্য পান করেন। মদ থেকে হয় চর্বি। আর ধোঁয়া শিরার ভেতরে পাইপলাইনের ক্ষয় করে। যেইমাত্র না পাইপের ক্ষতি, অমনি সেখানে রক্ত জমতে শুরু করে। তার পর সেই ক্লটের ওপর চর্বির দল আটকে যায়। ব্যাস খেল খতম, পয়সা হজম। ধমনিতে রক্ত চলাচল কমে গেল।
এটা কিন্তু মাথার ঘিলুতে, পাম্পের ভেতরে, চোখে বা হাতে পায়ে সব জায়গায়ই হতে পারে। সাধারণত এক সঙ্গে অনেক জায়গায় হয়। যেমনটি হয়েছিল এক হার্ট অ্যাটাকের রোগীর, তার পায়েও পচন ধরেছিল। খেল খতম। অমনি সবাই রে রে করে উঠল! একি হল হার্ট অ্যাটাক – আর পায়ে ধরল পচন? মানুষ চব্বিশ ঘণ্টা রাতদিন সাত দিন চ্যাঁচাতে লাগল। ডাক্তার বেচারা পলায়ে গেল।
যাই হোক না কেন – ঘিলুতে রক্ত বন্ধ হলে বলে সেরিব্র্যালল অ্যাটাক আর হার্টে হলে বলে হার্ট অ্যাটাক। চোখ আছে, কিডনি আছে, পিলে আছে আর আছে গোটা শরীরটা। যেখানে খুশি রক্ত চলাচল বন্ধ হতে পারে। হলে সঙ্গে সঙ্গে পাইপলাইন খোলার ব্যবস্থা করতে হবে – নো জড়িবুটি নো তুকতাক – কিচ্ছুটি নট । সময় বড়োই দামী, নষ্ট করবেন না। আমাদের শুধুমাত্র জানতে হবে লক্ষণ আর সাবধান হওয়ার পথ। আজকের মতো এই ডাক্তারের কলম বন্ধ হচ্ছে।
(লেখক একজন সাধারণ চিকিৎসক)