আমি সারাদিন ধরে লেখা লিখি করি। শুধু লিখেই সংসার চালাই। আমি যে জিনিসটা লিখি সেটা হলো প্রেসক্রিপশন।
প্রেসক্রিপশন লেখাও একটা শিল্প। রোগের উপসর্গ, রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা, আনুমানিক অসুখ, ওষুধপত্র, খাদ্য, জীবন যাত্রা- সব কিছুর উল্লেখ থাকে সেখানে। ঠিক যেন সার্থক ছোটো গল্প। তবে রোগীর চাপে আমার বেশিরভাগ প্রেসক্রিপশন এখন অণু গল্প হয়ে যাচ্ছে।
তবে কখনো কখনো প্রেসক্রিপশন বিপদজনক হয়ে ওঠে। কিছু প্রেসক্রিপশনের পাঠোদ্ধার তো দূরের কথা, ভাষা বোঝাই অসম্ভব। দেখে জাপানি বা হিব্রু মনে হলেও সেগুলো ইংরেজিতেই লেখা। এবং রোগী সেই অনুযায়ী দিব্যি ওষুধ খাচ্ছেন। ফার্মাসিস্টদের দুর্বোধ্য হাতের লেখা পাঠোদ্ধার করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। আমার সেই ক্ষমতা না থাকায় রোগীকে ওষুধ নিয়ে আসতে বলি। তবে ডাক্তারবাবুদের হাতের লেখা নিয়ে যেমন মিথ চালু আছে, সেটা মোটেও সত্যি নয়। অনেক ডাক্তারবাবুই যত্ন নিয়ে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় প্রেসক্রিপশন লেখেন।
বাঙালিদের কাছে আরেকটি প্রেসক্রিপশন খুব বিখ্যাত। সেটা হল ভেলোরের সুদীর্ঘ প্রেসক্রিপশন। বেশিরভাগ মানুষ এই প্রেসক্রিপশনটি অত্যন্ত যত্ন করে রেখে দেন। যেকোনো কারণে ডাক্তার দেখাতে গেলে ওটি নিয়ে যান। ডাক্তারবাবু সেটি খুঁটিয়ে না দেখলে অত্যন্ত মন ক্ষুন্ন হন।
ভেলোরের প্রেসক্রিপশন নিয়ে আমার বেশ কিছু বিচিত্র গল্প আছে। তবে আজ নয়, অন্য দিন বলব। আপাতত নিজের প্রেসক্রিপশনের গল্প শোনাই।
চারিদিকে যে এত পকেটমারি, ছিনতাই চলছে; ডাক্তার না হলে জানতেই পারতাম না। অনেকেই পুরনো প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসেন না। জিজ্ঞেস করলে অধিকাংশ রোগী জবাব দেন, ‘ডাক্তারবাবু চুরি হয়ে গেছে’।
প্রথম প্রথম একইসাথে বিচলিত ও পুলকিত দুটোই হতাম। আমার প্রেসক্রিপশন এমনকি মহার্ঘ বস্তু যে চুরি হয়ে যাবে?
বললাম, ‘এতো কিছু থাকতে প্রেসক্রিপশন চুরি হলো?’
‘আজ্ঞে ডাক্তার বাবু, ভ্যানিটি ব্যাগে রেখেছিলাম। ব্যাগ সমেত ছিনতাই হয়ে গেছে।’
প্রেসক্রিপশন কেউ ভ্যানিটি ব্যাগে রাখেন। কেউ পার্সে রাখেন। কেউ আবার ফাইলে পুরে অফিসে নিয়ে যান। অতএব চুরি হতেই পারে।
আমফান ঝড়ের পর প্রেসক্রিপশন চুরি হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে জবাব পেতাম, ‘আর প্রেস্ক্রিপশন ডাক্তারবাবু। ঝড়ে পুরো বাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কে জানে কোথায় উড়ে গেছে!!’
লকডাউনের সময় আরেক সমস্যা। সকলে জামা কাপড় ঘনঘন কাচতে শুরু করলেন। প্রত্যেকবার কি কাচার আগে জামা প্যান্টের পকেটে থাবড়ে দেখা সম্ভব? ফলে মাঝে মাঝেই প্রেসক্রিপশনের বদলে কাচা ও তার পরে রোদে শুকানো প্রেসক্রিপশনের ছিবড়ে পেতে শুরু করলাম।
এছাড়াও পেলাম একাধিক জীবাণু মুক্ত সফেদ প্রেসক্রিপশন। অনেকেই বাড়ি ফিরে প্রেসক্রিপশন স্যানিটাইজ করেন। কিছু কিছু স্যানিটাইজারে কি থাকে কে জানে? ছেটানো মাত্রই কালির দাগ টাগ হাওয়া। প্রেসক্রিপশন একদম ঝকঝকে নতুন পাতা।
সেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে রোগীর বাড়ির লোক দৌড়ে আসছেন। ‘ডাক্তার বাবু, কি লিখেছিলেন আরেকবার লিখে দিন। ওষুধ কেনা হয়নি।’
আমার ততক্ষণে আরো তেতাল্লিশ জন রোগী দেখা হয়ে গেছে। বললাম, ‘কি লিখেছিলাম, সবই তো ভুলে গেছি।’
‘সে কি! এই তো খানিকক্ষণ আগেই লিখলেন। একটু মনে করার চেষ্টা করুন ডাক্তার বাবু। বললেন প্রেশার অনেকটা বেশি।’
চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনে পড়লো না। অপরাধী অপরাধী মুখ করে বললাম, ‘রোগীকে আরেক বার নিয়ে আসেন। আরেক বার দেখি।’
ভদ্রলোক ব্যাজার মুখে সম্ভবত দুর্বল স্মৃতি শক্তির ডাক্তারকে গাল দিতে দিতে রোগীকে আনতে গেলেন।
এম ডি পাশ করে প্রথম যখন চেম্বার শুরু করেছিলাম রোগী হত না। খুপরিতে বসে মশার কামড় খেতাম।
আমার প্রেসক্রিপশনের পাতাগুলো বেশ বড় সড়। একটা পাতা ছিড়ে কবিতা লিখতাম। প্রায় বছর খানেক এরকম কবিতা লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। এতটাই উৎসাহ পেয়ে গেছিলাম, যে ‘প্রণতি’ নামে একটি এক ফর্মার মাসিক কবিতা পত্রিকা বের করে ফেললাম। পত্রিকা বের করে অন্তত একটা লাভ হয়েছিল। সেই সূত্রে অনেকের সাথে আলাপ হয়েছিলো। ডা. অরুণাচল দত্ত চৌধুরী স্যারের সাথে আলাপ হওয়া আমার সারা জীবনের অন্যতম সম্পদ।
বছরখানেক বাদে রোগীর সংখ্যা গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়তে শুরু করল। আমার কবিতা লেখা, কবিতা পত্রিকা সব বন্ধ হয়ে গেল। আজকাল কবিতা লেখার চেষ্টা করলেও কবিতা আসে না। তাই আজে বাজে গদ্য লিখি।
যাই হোক আবার গল্পে ফিরি। রোগীকে একবার দেখার পর প্রেসক্রিপশনের পিছনের পাতাটা পুরোটাই ফাঁকা থাকে। দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার দেখার সময় এই জায়গা গুলো কাজে লাগাই।
তবে তার আগেই অনেক উৎসাহী রোগী ফাঁকা জায়গা কাজে লাগিয়ে দেন। সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে ফোন নাম্বার লিখতে। মুরারির বউয়ের ফোন নাম্বার, কাশীর শালার ফোন নাম্বার, মাংসের দোকানের ফোন নাম্বার…
এছাড়াও বাজারে ফর্দ পেয়েছি।
আলু- ১ কেজি
পেয়াজ- ৫০০
পটল- ৫০০
ঢেঁড়স- ২৫০
ক্যাপসিকাম- ২টো
তাছাড়াও অনেকেই ফাঁকা জায়গায় বাচ্চাকে অ আ বা A B C D লেখা শেখান।
একজন রোগিণী লজ্জা লজ্জা মুখে বললেন, ‘প্রেসক্রিপশনটা উলটাবেন না প্লিজ।’
তারপর আর না উলটে পারা যায়। দেখলাম পেছনে পদ্য লেখা। আবেগে জব জবে প্রেমের পদ্য।
উনি লাজুক হেসে বললেন, ‘কেমন হয়েছে?’
গোলাপের সাথে প্রলাপ মিলিয়েছেন। মাত্রাছাড়া মাত্রা। তবু হাসলাম। অনেকদিন বাদে খুপরিতে বসে প্রেসক্রিপশনে কবিতা লেখার স্মৃতি ফিরে এলো।
আপনার একটা লেখা পড়ার পর পরপর বেশ অনেকগুলো পরে ফেললাম ।সত্যি অনবদ্য। এত সাবলীল ও চলতি ভাষায় লেখা ,যেন মনে হচ্ছে লেখক নিজেই আমার সামনে বসে গদ্য টি আমাকে পরে শোনাচ্ছেন । এরম লেখা সত্যি খুব কম নজরে আসে। আজ ই প্রথম পড়লাম এবং আজ সন্ধের মধ্যেই প্রায় 7 তা গল্প পরে ফেললাম।খুব ভালো লেগেছে।