১৩ই অক্টোবর, ১৩০৭, শুক্রবার, আজকের দিনেই। প্যারিস শহরের পশ্চিমপ্রান্তে আজকে মানুষের ভীড়, না আজকে তারা কোন উৎসব উদযাপন করার জন্য জড়ো হয়নি, কারোর মনে আনন্দ নেই। চোখে মিশে আছে ভয়, হতাশা আর রাজা চতুর্থ ফিলিপের জন্য ঘৃণা। ওই তো নিরাপদ দুরত্বে রাজা বসে আছেন, ল্যুভরের প্রাসাদের বাইরেই তার জন্য তৈরি করা উঁচু পোডিয়ামে। রাজার মন কিন্ত খুব ফুরফুরে আজ, এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেছে। খুব বার বেড়েছিল এরা, মরুক এবারে।
মরছে কারা?
ওই তো যে জায়গাটা ঘিরে সাধারণ মানুষের জটলা। সেখানেই কাঠের খুঁটির ওপরে বাঁধা শ দুয়েক লোক। আর তাদের গ্রাস করছে আগুনের লেলিহান শিখা। সেই শিখার কালো ধোঁয়া ঘুরপাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে প্যারিসের আকাশে, চামড়া পোড়ার গন্ধ মিশে রয়েছে বাতাসে। আর দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে জীবন্ত পুড়তে থাকা মানুষ গুলোর আর্তনাদ।
কারা পুড়ছে?
এরা নাইট টেম্পলার।
কিন্তু ওদের মরতে হল কেন? এরাই না ক্রুসেড জিতিয়েছে? এরাই তো মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে যীশুর জেরুজালেমকে।
এদেরকে তো মাথায় তুলে রাখার কথা। তাহলে?
ফ্রান্সের রাজার উদ্যোগে টেম্পলারদের তৈরি করা হয় ১১১৯ এ, কিছু রোগা ভোগা অতি সাধারণ খ্রীষ্টান সন্ন্যাসীদের নিয়ে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এই নড়বড়ে দলটাই বদলে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোড়সওয়ারের দলে। ইউরোপের সব খ্রীষ্ঠধর্মী দেশগুলো থেকে তখন কাঁড়িকাঁড়ি স্বর্ণমুদ্রা আসছে টেম্পলারদের জন্য। দল বাড়তে বাড়তে কয়েক হাজারে এসে দাঁড়াল। ক্রুসেডের যুদ্ধগুলোতে তখন তারাই সামনে থেকে লড়াই করছে। মুসলিমদের সেনা বাহিনী খড় কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছে টেম্পলারদের সামনে।
এই ক্রুসেড চলেছিল আরো দু’শো বছর। কিন্ত টেম্পলারদের কার্যকলাপ ধীরে ধীরে বদলে গেল। তারা সন্ন্যাসী, পার্থিব কোন বস্তুতে তাদের কোন মায়া নেই। তাই যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাদের কাছেই সবাই নিজেদের মূল্যবান ধন জমা করে রেখে যেতে লাগল, যাদের অধিকাংশই আর ফিরে আসেনি। অন্যদিকে ‘ভগবানের সৈনিক’ এই টেম্পলারদের জন্য তখনো চারপাশের দেশ গুলো থেকে অর্থ সাহায্য আসা বন্ধ হয়নি। এই বিশাল ঐশ্বর্য হাতে পেয়ে বুদ্ধিমান টেম্পলাররা যুদ্ধ ছেড়ে ব্যবসা ফেঁদে বসল।
তৈরি হল প্রথম ব্যাঙ্ক, টেম্পলাররা তখন রাজাকেও অর্থ ধার দেয়। ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যে প্রচুর জমি জায়গা তাদের নামে। অন্যান্য দেশগুলোর সাথেও ব্যবসা শুরু করে ফেলেছে তারা। একটা বড়সড় মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনের সাথে কোন তফাত নেই।
এদিকে ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ ফিলিপ একদম গলা পর্যন্ত দেনায় ডুবে আছেন। তাঁর এই দেনা টেম্পলারদের কাছেই, যাদেরকে তাঁর পূর্বপুরুষরাই বানিয়েছিলেন! যে পরিমাণের অর্থ ধার করেছেন তা কোন কালেই মেটানো সম্ভব নয়। দেশের সাধারণ মানুষও সেটা বুঝতে পারছে এখন। কাল যদি তাদের রাজাকে আর পাত্তা না দেয়?!
পকেট ফুটো হলেও রাজার হাতে কিন্তু এমন একটা কিছু ছিল যার শক্তি সবার ওপরে, সেটা হল ধর্ম। পোপের সাথে সাথে খ্রীষ্ঠ ধর্মের ধারক বলে এখনও তো সবাই রাজাকেই মানে। তাহলে এই ধর্মের দোহাই দিয়ে টেম্পলারগুলোকে শায়েস্তা করা যায় না?
১৩০৭ সালের ১১ই অক্টোবর ফ্রান্সের শহর গুলোতে ছড়িয়ে পড়ল রাজার লোকেরা। দিকে দিকে যে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হল তার মর্মার্থ হল এই যে টেম্পলাররা খ্রীষ্ঠ ধর্মের পরিপন্থী। যীশুকে মানে না, যীশুর ক্রশে থুতু ফেললে তবেই নাকি টেম্পলার হওয়া যায়। এরা পুজো করে বাফোমেত নামের এক শয়তানকে। এরা আবার পায়ুকামীও বটে। অতএব এদের সব্বাইকে এখনি গ্রেফতার করে বিচার করা হোক।
অবশ্য বিচারের নামে যেটা হল সেটাকে নাটক বলা চলে। টেম্পলারদের শহরের মাঝখানে বেঁধে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হল। জোর করে আদায় করা হল স্বীকারোক্তি। তারপরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল তাদের শরীরে। ঈশ্বরকে বাঁচাতে যাঁরা রক্ত দিয়েছিলেন তাঁদেরকেই মেরে ফেলা হল সেই ঈশ্বরেরই দোহাই দিয়ে।
ঠিক যেমনটা রাজা ফিলিপ চেয়েছিলেন।
এই ঘটনার কয়েকশো বছর পরে ক্যাথলিক চার্চ নিজের ভুল স্বীকার করে। তাতে যদিও ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের ক্ষতে কোন প্রলেপ পড়েনি। শুক্রবারের ১৩ তারিখ তাই আজও অশুভ।
ড্যান ব্রাউনের বই যারা পড়েছেন তারা এতটা পড়ে ভাববেন এ আর নতুন কি কথা, ব্রাউনই তো লিখেছেন যে ফ্রাইডে দা থার্টিন্থের অপসংস্কারটা এই ঘটনা থেকেই এসেছে। কিন্তু এই তথ্য যে ভুল। ১৩০৭ সালের অনেক অনেক আগে থেকেই মানুষের মনে এই দিনটা নিয়ে ভয় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আসুন এবারে সেই গভীরে ডুব দেওয়া যাক। যেটা পাবেন তাতে অবাক হওয়ার মতো অনেক কিছু আছে।
সপ্তাহের এই দিনটার ফ্রাইডে নামটা এসেছিল নর্স দেবী ফ্রিগ-এর থেকে। রোমানরা এরই পুজো করত ভেনাস নামে। ইনি বুদ্ধি, সৌন্দর্য, বল, ধনের দেবী। আমরা হিন্দুরা এই দিনটাকে শুক্রবার বলি। এই শুক্র গ্রহও কিন্তু আসলে ভেনাস। দেবী ভেনাসের থেকে যার নামকরণ। শুক্রবার হিন্দুরা শক্তির পুজো করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার পুজো হয় দুর্গা,কালী,সন্তোষীমা নামে। এদের কাছেও আমরা প্রার্থনা করি ধনং দেহী, যশ দেহী, বল দেহী… ঠিক যেমন ভাবে নর্সরা ফ্রিগের পুজো করত, রোমানরা ডাকত ভেনাসকে। কয়েক হাজার বছর আগের তিনটে সভ্যতা, তাদের নিজেদের মধ্যে দুরত্বও কয়েক হাজার মাইলের। কিন্তু তাদের আরাধ্যা দেবীদের কি অদ্ভুত মিল তাই না!
আচ্ছা সেই সময়কার মানুষগুলো দিনক্ষণ জানত? জানত বইকি? যীশুর জন্মের ৮০০০ বছর আগে থেকেই জানত। তাদেরও ক্যালেন্ডার ছিল। আর তা দাঁড়িয়ে ছিল আকাশে চাঁদের দশার ওপরে। একে লুনার ক্যালেন্ডার বলে। সেই সময়কার প্রায় সব কটা সভ্যতাই মাতৃকেন্দ্রিক। যারা ফ্রিগ,ভেনাস, শক্তির পুজো করছে তাদের ক্যালেন্ডারও মেয়েদের কথা ভেবেই তো তৈরি হবে নাকি। মেয়েদের মাসিকচক্র হয় ২৮ দিনের। চাঁদেরও একটা পুর্নদশা ২৮ দিনের। তাই লুনার ক্যালেন্ডারে বছরে ১৩টা মাস। একবছরে মেয়েরা ঋতুমতীও হয় ১৩ বার।
১৩ ছিল নারীত্বের প্রতীক।
আমাদের বাঙালি দের বঙ্গাব্দেও কিন্তু লুনার ক্যালেন্ডারের ছাপ। সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ইসলামের হিজরি ক্যালেন্ডারের সাথে মিলিয়ে বাংলার নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করতে বলেন। তাই আমাদের বছর শুরু হয় এপ্রিলে, বৈশাখ মাস দিয়ে। এই হিজরি ক্যালেন্ডারও লুনার।
তাহলে যা বোঝা গেল তা হল ১৩ আর শুক্রবার দুটোই শুভ। তাহলে এটা চরম অশুভ দিন হয়ে গেল কি করে?
কারণটা আর কিছুই নয়, এর শুভ হওয়ার পিছনে যে লুকিয়ে আছে মেয়েরা। মানুষের নারীর আরাধনা। খ্রীষ্ট ধর্মকে যখন দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন এই ধর্মের বাহকরা সেটা সহ্য করতে পারেননি। তাই দেবী ফ্রিগ হয়ে গেলেন দানবী, ঠিক যেমনটা ঘটে ছিল এফেসুসের আর্টিমিসের ক্ষেত্রে। আর ১৩ নম্বর হয়ে গেল অশুভ। শয়তানের সংখ্যা। তাই বাড়ি ঘরের সংখ্যা ১২ র পরে রাখা হল ১৪, ১৩ তারিখে সন্তান জন্মালে তাকে শয়তানের হাত থেকে বাঁচাতে রাখা হল বাইবেলের ওপরে।
যে শুক্রবারের ১৩ তারিখ নারীশক্তির উদযাপন হওয়ার কথা সেই দিনকে আমরা এখন ভয় পাই, তা নিয়ে ভয়ের সিনেমা তৈরি হয়। মানুষ ফ্লাইটের টিকিট কাটতে ভয় পায়। নতুন ব্যবসা শুরু করে না। যদি খারাপ কিছু হয় যায় তো!
তাহলে দিনটা ভয়ের নয়, লজ্জার।
কি বলেন?
____________________________________________________________________
আজ আমার মেয়ে বেটুর জন্মদিন। আজ আবার ফ্রাইডে দা থার্টিন্থ ও! তাই আজকের দিনে এই লেখাটাকে এখানে রাখতেই হত।
দারুন লেখা।