প্রশ্নঃ আমরা আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত মানুষ দেখতে পাই। কোন মানুষকে কখন আমরা নেশায় আসক্ত বলব?
উত্তরঃ মদ, গাঁজা, আফিম, কোকেইন, ডেনড্রাইট, সিগারেট, তামাক, বিভিন্ন ঔষধ ইত্যাদির নেশার সাথে সাথে মোবাইল, ইন্টারনেট ও এখন নেশার বস্তু। কোন ব্যক্তি নেশার জালে জড়িয়ে পড়লে তাঁর আগের ভাল লাগার কাজগুলি না করে, নিজের কাজকর্মের ক্ষতি করে, টাকা পয়সা নষ্ট করে, শরীরের ক্ষতি হচ্ছে জেনেও তিনি নেশা করেই যান। ক্রমশ নেশাদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অর্থাৎ একই পরিমাণে নেশাদ্রব্য গ্রহণ করলে তাঁর আর নেশা হয় না। তাঁকে বেশী পরিমাণে নেশাদ্রব্য গ্রহণ করতে হয়। এই ঘটনাকে বলে “টলারেন্স”। আর এর পরে দীর্ঘক্ষণ নেশা না করলে তাঁর অস্বস্তি হতে থাকে। ঘুম হয় না, গা -হাত-পা যন্ত্রণা, উদ্বিগ্নতা ও বিভিন্ন অস্বস্তি হতে থাকে যা আবার নতুন করে নেশা করা অব্দি চলতে থাকে। এই লক্ষণগুলিকে বলে “উইথড্রয়াল সিম্পটমস “। এই ভাবে ওই ব্যক্তি ক্রমশ নেশার দুষ্টচক্রের মধ্যে তলিয়ে যান অর্থাৎ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন।
প্রশ্নঃ নেশার সাথে অন্যান্য মানসিক রোগগুলির কী সম্পর্ক আছে?
উত্তরঃ গবেষণায় দেখা গেছে যে সব মানুষ নেশায় আক্রান্ত তাঁদের ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই কোন না কোন অন্য মানসিক রোগও আছে। যে সমস্ত মানুষ দীর্ঘদিন নেশা করেন তিনি ক্রমশ অন্য মানসিক সমস্যা যেমন” সাইকোসিস ” রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। আবার অনেকে মানসিক অবসাদ, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি কাটানোর জন্য নেশার আশ্রয় নেন। “সিজোফ্রেনিয়া”-র রোগীরা অনেক সময় রোগের উপসর্গগুলি কমাতে নেশার আশ্রয় নেন।যদিও এতে রোগীর রোগ উল্টে বেড়ে যেতে পারে। আবার “বাইপোলার ডিসঅর্ডার” নামক রোগে আক্রান্ত রোগীরা “ম্যানিক” পর্যায়ে মাত্রাতিরিক্ত নেশা করে ফেলেন।
প্রশ্নঃ ভারতবর্ষে নেশায় আক্রান্ত মানুষদের পরিসংখ্যানটা কেমন?
উত্তরঃ সাধারণত নেশার সূত্রপাত হয় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সে।তামাকের নেশা আরো আগে শুরু হয়। ২০০৪ সালের তথ্য অনুযায়ী ১২ থেকে ৬০ বছরের পুরুষদের মধ্যে তথ্য সংগ্রহের একমাসের মধ্যে ২১ শতাংশ ক্ষেত্রে মদ্যপান, ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে গাঁজা, ০.৭ শতাংশ ক্ষেত্রে আফিং জাতীয় নেশা, ৩.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে অন্যান্য নেশা, ২২.৩ শতাংশ ক্ষেত্রে অনেকগুলি নেশা একসাথে পাওয়া গিয়েছিল।
প্রশ্নঃ মানুষ কেন নেশা করে ?
উত্তরঃ এক্ষেত্রে অনেকগুলি বিষয় কাজ করে। যেমন-
বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর-
আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে থাকা স্ট্রায়াটাম (বিশেষত এর অন্তর্গত নিউক্লিয়াস একামবেন্স নামক জায়গাটি) নামক এক জায়গায় ডোপামিন নামক একটি রাসায়নিকের বৃদ্ধি আমাদের ভাল লাগাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের পছন্দের খাবার খেলে যেমন ওই জায়গায় ডোপামিন বাড়ে, তেমনি নেশা করলেও ওই বিশেষ জায়গায় ডোপামিন বাড়ে। কিন্তু নেশা করার পরে ওই জায়গায় ডোপামিনের পরিমাণ অল্প সময়ে অনেকখানি বাড়ে। তাই খাবার খাওয়ার থেকে নেশা করা অনেক বেশী আনন্দদায়ক হয় এবং ঐ আনন্দ লাভের আশায় আমরা নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ি।মদ, গাঁজা, আফিম, সিগারেটের মত ইন্টারনেটের নেশাতেও একই ঘটনা ঘটে। নেশায় আসক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্ট্রায়াটামে ডোপামিন রিসেপ্টারগুলি কম পরিমাণে থাকে।তাই এদের ক্ষেত্রে বেশী মাত্রায় নেশা করলে তবেই যথোপযুক্ত ডোপামিন বৃদ্ধি ঘটে এবং ভালো লাগার অনুভূতি তৈরী হয়।
এ ছাড়া মস্তিষ্কের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল ‘এন্টেরিওর সিঙ্গুলেট কর্টেক্স’। এই অংশটি আমাদের সামাজিক আচরণ ও ন্যায়-অন্যায় বোধ নিয়ন্ত্রণ করে। নেশাসক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের এই অংশটি ঠিক মত কাজ করে না এবং এঁরা সহজেই অনিয়ন্ত্রিত, উৎশৃঙ্খল জীবনযাপন ও নেশায় জড়িয়ে পড়েন।
সোশ্যাল ফ্যাক্টর-
অনেকে আবার নিজের মন খারাপ, উদ্বিগ্নতা কাটানোর জন্য বিভিন্ন নেশাতে জড়িয়ে পড়েন এবং সেখান থেকে আর বেরোতে পারেন না।
সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টর–
অনেক সময় দেখা যায় যে সমস্ত ব্যক্তির মন খারাপ, উদ্বিগ্নতা, এটেনসন ডেফিসিট হাইপার কাইনেটিক ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার ইত্যাদি সমস্যা আছে, তাঁরা সহজেই এই নেশার শিকার হন।
প্রশ্নঃ নেশার চিকিৎসা কি ভাবে সম্ভব?
উত্তরঃ অনেক সময় বিভিন্ন মানসিক রোগের সাথে নেশার সমস্যা জড়িয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সেই মানসিক রোগ ও নেশা -উভয়েরই চিকিৎসা প্রয়োজন। যে ব্যক্তি নেশা করে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তাঁর সেই মুহূর্তে কিছু চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।আবার নেশার ইচ্ছে কমানোর জন্যও কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। নেশা থেকে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমন লিভারের সমস্যা, পেটে জল জমা, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ ইত্যাদি হলে সেগুলিরও চিকিৎসা প্রয়োজন। সাধারণ ভাবে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারবাবুরাই নেশার চিকিৎসা করে থাকেন। এছাড়া কিছু সাইকোথেরাপি, গ্রুপ থেরাপি ইত্যাদির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোন ব্যক্তি কিছুদিন নেশামুক্ত থাকার পরে আবার নেশা শুরু করছেন। তাই নেশা করার বন্ধু-বান্ধব ও নেশা করার জায়গাগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। হঠাৎ নেশা করার ইচ্ছে হলে নিজেকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। সাধারণত প্রথম ৩০ মিনিট এই ইচ্ছা তীব্র হয়। তার পরে ইচ্ছা ক্রমশ কমতে থাকে।
রোগীর বাড়ির লোকজনকে নেশার লক্ষণগুলো সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করা গেলে তাঁরা চিকিৎসা শুরু করার ক্ষেত্রে বিশেষ সহযোগিতা করতে পারেন।