‘কাগচ’ না ‘কাগজ’ তফাৎটা বোঝার আগে থেকেই বাড়িতে খবরের কাগজ দেখছি। রোববার দুপুরে খানদুয়েক দৈনিক চেবানোর পর আজ হঠাৎ মনে হল চার দশক ধরে কাগজ পড়ছি। এবার সময় এসেছে কাগজ পড়ার অভিজ্ঞতা বদলেছে কি না একটু ভেবে দেখার। বিশেষজ্ঞের মতামত নয়। একজন সাধারণ পাঠকের স্বভাবসিদ্ধ বাচালতা আর একবার প্রমাণ করা ছাড়া এই লেখার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
ছোট থেকেই বাড়িতে ‘আমোদবাজার’ আসতো। হ্যাঁ, মা এই নামটাই ব্যবহার করতেন এবং এখনও করেন। আমার ঠাকুরদার নাম ছিল আনন্দ। তিনি এখন স্বর্গে। তবে মা তাঁর শ্রদ্ধেয় শ্বশুরমশায়ের নাম এখনও উচ্চারণ করেন না।
টিভি-হীন, নেট-হীন যুগে এবং সাতাশ-পাতের যৌথ পরিবারে একটি মাত্র খবরের কাগজ নিলে যা হওয়ার তাই হতো আমাদের বাড়িতে। প্রথমেই পাতা ভাগাভাগি। প্রভাবশালীরা(!) প্রথমেই প্রথম পাতা এবং খেলার পাতা নিয়ে নিতেন। আমরা পেতাম সম্পাদকীয়। দৈনন্দিন এই যুদ্ধের বাইরে থেকে ন’কাকা কাগজটি পড়তেন দ্বিপ্রাহরিক ভাতঘুমটি দেওয়ার ঠিক আগে। এমনিতে কাকা ছিলেন ভীষণ প্রগতিশীল। তবে শিশুশ্রম নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। দুপুরে কাগজ পড়াকালীন একটি চিমটে নিয়ে আমাকে তাঁর পাকা চুল তুলে দিতে হত। প্রতিটি সাদা চুলে দু’পয়সা আর ভুল করে কালো চুল তুলে ফেললে পাঁচ পয়সা জরিমানা। পুজোর আগে অবশ্য রেটটা একটু বাড়তো। হিসাবের স্বচ্ছতা নিয়ে আমার কিছু অভিযোগ ছিল। তবে তা জানানোর আগেই ন’কাকা চলে গেলেন দাদুর কাছে।
আমার ঁপিতৃদেব কাগজটি চাইতেন সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে। বেশির ভাগ দিনেই ততক্ষণে সেটি যেত হারিয়ে। এটা নিয়ে বাবা প্রথমে একপ্রস্থ গজগজ করে নিতেন। খাটের তলা বা আলমারির মাথা কোথাও থেকে উদ্ধার হলেও পাতাগুলো সব লুচি হয়ে থাকতো। আর সেটা হতো বাবার রাগের দ্বিতীয় কারণ। যাইহোক কাগজ হাতে পেয়ে তিনি সোজা চলে যেতেন “আপনার আজকের দিনটি” কলামে। নিজের কাটানো দিনটির সাথে ছাপানো রাশিফল না মিললে তিনি আরও রেগে যেতেন। মাঝে মাঝে সেই ‘অকাজের কাগজ’ বন্ধ করে দেবার হুমকিও দিতেন। কিন্তু মা যে ছিলেন ‘আমোদবাজার’ এর ভক্ত!
থাকতাম কলকাতা থেকে ট্রেনে ঘণ্টা চারেকের দূরে। বাড়িতে কাগজ দিতেন বাদলদা। বয়সে বাবার চেয়েও বড়। কিন্তু কিছু কিছু সম্বোধন যে সর্বজনীনতা পায় হয়তো তাকে স্বীকৃতি দিতেই আমরাও তাঁকে দাদা বলেই ডাকতাম। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, মিটিং-মিছিল-অবরোধ-হরতাল পার করে বাদলদা ঠিক হাজির হয়ে যেতেন। প্রচণ্ড গরমে মাথা ঢাকা থাকতেন মিনি ছাতার সাইজে একটা তাল পাতার টুপিতে। বাহন বলতে ছিল দু’ চাকার একটি ক্রিং ক্রিং সাইকেল। রোদে পোড়া মুখটা দেখে মায়া হত। অনেকে খাবার জল অফার করতেন। পালে-পরবে নাড়ু মিষ্টিও। কিন্তু পাঁচ বাড়ি জল খাবার পর যেটা দরকার হয় সেই সুযোগটা কেউ কোনদিন দিয়েছেন বলে জানা নেই। তবে সেকালে “স্বচ্ছ ভারত মিশন” টাইপের কোনো চাপ ছিল না। ওনারও নয় আমারও নয়। যাকগে সে সব কুঅভ্যাসের কথা। বরং এখন আমার বাড়িতে যে ছেলেটি কাগজ দেয় তার সাথে পরিচয় করাই। দুঃখিত, আমি তার নাম জানি না। জিগ্যেস করার সুযোগও পাই না। সকাল সকাল একটা মস্ত বড় মোটরসাইকেল চড়ে আসে। পড়নে হাতকাটা গেন্জী। কানে গোঁজা ইয়ারফোন। কাগজটা লেটারবক্সের মাথায় রেখেই উধাও।
প্রথম পাতা আর তার হেডলাইনসের ওজনই আলাদা। তবে আজকাল প্রায় দিনই আমি বুঝতে পারিনা কোনটা প্রথম পাতা। আগে কয়েক পাতা বিজ্ঞাপন। ধমাকা অফারের দিনে আরও বেশি। অবশ্য সবগুলোকে বিজ্ঞাপন বললে আমার মাথা কাটা যাবে। বোধহয় বলা উচিত বিজ্ঞপ্তি। করের টাকায় বিশিষ্টদের বিশাল বিশাল ছবিসহ যে সব নয়া প্রকল্প বা গুচ্ছ গুচ্ছ উদ্বোধনের ফিরিস্তি থাকে সেগুলোকে কি বিজ্ঞাপন বলা যায়! যাই হোক এরকম এক বা একাধিক লেয়ার টপকে শেষমেশ যখন আসল খবরে ল্যান্ড করি, দেখি ল্যাজ কাটা টিকটিকির মত পাতাটি লম্বালম্বি কাটা। এই অবধি পৌঁছনোর আগেই অবশ্য একটা না একটা হলুদ বা গোলাপি ফিনফিনে কাগজের হ্যান্ডবিল খসে পড়ে। ক্লাউড কিচেন থেকে ফেসিয়াল/ফলস/ পিকো বা পায়খানা সাফের আবেদন কি না থাকে সেখানে! এমনিতে পয়সাকড়ি মেঝেয় পড়ে গেলে আমি নগদের পরিমাণ না দেখে হেঁট হই না। কিন্তু ঘর নোংরা করার দায়ে ফাঁসি হতে পারে ভেবে তাড়াতাড়ি এইসব ছুটকো ছাটকা চিরকুট তুলে আগে বিনবন্দী করি।
এবার বলি আনাড়ি পাঠককে বিভ্রান্ত করার একটা ছোট্ট গল্প। দেখবেন ছুটির দিনেও এখন “ছুটি নয়” নোটিশ দেওয়া হয়। কারণ অনলাইন ভার্সন খোলা থাকে যে! আগে বাপু লেখালিখি হতো অনেক সোজাসাপটা। এত কথার মারপ্যাঁচ ছিল না। তাছাড়া, না পড়লে পিছিয়ে পড়ার হুমকি অথবা ভগবান ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না পাবার মুচলেকাও কোন খবরের কাগজ দিত না। খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা বা সত্যাসত্য নিয়ে আজ আর কথা তুললাম না।
ছোটবেলায় দেখতাম মাস শেষ হলে মা বাদলদাকে পয়সা মেটাতেন। আর এখন থাকে বছরের শুরুতেই আগামী বারো মাসের দাম চোকানোর লোভনীয় হাতছানি। ইলেক্ট্রিসিটি বিলের মতো এই হিসেবটাগুলোও আমি বুঝে উঠতে পারি না। কখনও কম্বো অফার। কখনও বা দীর্ঘদিনের গ্রাহকদের প্রতি লয়ালটির পারিতোষিক। সবই আছে, শুধু সত্যের প্রতি কেমন যেন একটা লয়ালটির অভাব!