দীপ জ্বেলে যাও, বইটির নাম চোখে পড়লে, আমি নিশ্চিত, আপনার মস্তিস্ক চোখকে বলবে, দীপ জ্বেলে যাই পড়। নাহ, এই বই প্রেমের বই নয়। এখানে কোনও উত্তম বা সুচিত্রা নেই। এই বই হল, এক সময়ের বাস্তব দলিল।
আমার দ্বারা বিশেষ একটা পাঠ প্রতিক্রিয়া করা হয়ে ওঠে না। তবে কাল বইটি কিনে আজকেই বইটা সম্পর্কে দুটো তিনটে কথা লিখতে ইচ্ছে করছে। না, এটা প্রবন্ধের বই নয়। একটা উপন্যাস, তবে ভীষণ বাস্তব দলিল।
এই গল্পের মূল চরিত্র একজন ডাক্তার, সে শুধু ডাক্তার নয়, একজন রক্তমাংসের মানুষ। এই যে রক্তমাংসের মানুষটি তার মধ্যে দয়া, মায়া, সব ছিল। সেই সঙ্গে ছিল তাঁর উচ্চারণের সমস্যা, যাকে চলতি ভাষায় তোতলা বলা হয়। এজন্য তাকে নানা স্তরে যেভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে। বা, রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র হয়েও তাকে মহান শিক্ষক নামক সাধুদের দ্বারা অপমানিত হতে হয়েছে। এই বই তার দলিল।
নাহ, শুধু ব্যক্তি শুভ মজুমদার ভিত্তিক গল্প নয় এই বই। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, উপন্যাসের মূল চরিত্র ডাক্তারবাবুর নাম শুভ মজুমদার। এই ডাক্তারের চোখেই আমরা নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষের বারোমাসি পড়ার সুযোগ পাব।
লেখক রুমঝুম ম্যাডামের সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয় নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, আশির দশকের সমাজজীবন জানতে হলে, এই বই পড়ে দেখতে পারেন। এই বইয়ের মুখবন্ধে বলা হয়েছে।
আশির দশকে, পশ্চিমবঙ্গের এক তরুণ চিকিৎসক, শুভব্রত মজুমদার এক অন্যরকম ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করার পর ছত্তিশগড়ের দল্লী রাজহারা অঞ্চলের শহীদ হাসপাতালে যোগ দেন। সেখানকার খনির শ্রমিকরা নিজেদের অর্থে ও শ্রমে গড়ে তুলেছিল এই হাসপাতাল। লোহা খনিজে সমৃদ্ধ দল্লী রাজহারার খনি শ্রমিকরা ছিল নিপীড়িত, শোষিত। মানুষের ন্যূনতম অধিকারটুকু তাঁরা পেতেন না। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চা গড়ে উঠেছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী। শুভব্রত হাসপাতালটিতে চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন কিন্তু খুব শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারেন, এই স্থান শুধু চিকিৎসা নয়, একটি আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। শঙ্করের নেতৃত্বে, শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে সংগ্রাম করছিল। শুভ, তার চিকিৎসার মাধ্যমে এই সংগ্রামে যুক্ত হন, মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি তাদের অধিকার রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু বিপ্লবের পথে বাধা ছিল বড়। শঙ্কর গুহ নিয়োগীর নির্মম হত্যাকাণ্ড, আন্দোলনের ভেঙে পড়া, নিপীড়িত শ্রমিকদের জন্য লড়াই করতে গিয়ে, শুভ গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েন। বিশ্বাস, আনুগত্য, সংগ্রাম, সংঘর্ষ ও নির্মাণের বুনোটে লেখা একটি হৃদয়গ্রাহী স্মৃতিচারণা, যেখানে এক তরুণ চিকিৎসকের চোখ দিয়ে দেখা দল্লী রাজহারা অঞ্চলের শ্রমিকদের সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামে হারানো আদর্শ, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ত্যাগের গল্প।
পড়ুন, বইটা, বিশেষ দামও নয়। প্রণতি প্রকাশনীর এই বইটার দাম মাত্র ১৫০টাকা
✍️রুদ্রাণী