সাদা পোশাক পরে যেসব ‘বঙ্গবীর’ গত ৯ এপ্রিল ২০২৫ চাকরিহারা, নিরস্ত্র ও অসহায় ইস্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লাথি মারলো, আর মাটিতে ফেলে লাঠিপেটা করলো, তাদের কী শাস্তি হওয়া উচিত!
এনারা ‘পুলিশ’ নামক এক বিচিত্র গোত্রের সরকারি কর্মচারি। এদের কাজ সর্বদাই সরকারের যাবতীয় দুষ্কর্মের সময়ে প্রভুভক্ত ঠ্যাঙারে হিসাবে ভূমিকা পালন করা। সেই কাজে তেনারা কখনও অতি-সক্রিয়, আবার কখনও অতি-নিষ্ক্রিয়। তাই, কোটিকোটি টাকা ঘুষ নিয়ে যে বদমাশগুলো হাজার হাজার অশিক্ষিত লুম্পেনদের ‘শিক্ষক’ হিসেবে চাকরিতে ঢুকিয়ে ছিলো, তাদের একজনকেও চিহ্নিত করবার এবং টিঁকি ছোঁবার মুরোদ এইসব সরকারি উর্দিধারীর নেই। তা তিনি যতো উচ্চপদেই থাকুন, তার কাঁধে বা বুকে যতোই ‘সম্মান’-এর প্রতীক থাকুক। কিন্তু যাঁরা শিক্ষিত, নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করে বছরের পর বছর ইস্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা হিসাবে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেবার কাজ করছিলেন, ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ হয়ে গর্বের সামাজিক ভূমিকা পালন করছিলেন, তাঁরাই বিচিত্র ‘গণতন্ত্র’-র ঠ্যালায় আজ চাকরিহারা! বাবা-মা-ভাই/বোন-স্বামী/স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তাঁরা আজ দিশাহারা। তীব্র যন্ত্রণায় হাহাকার শুরু হয়েছে তাঁদের পরিবারে। কীভাবে খাবেন, কীভাবে সন্তানদের পড়াশুনা করাবেন, কীভাবে বাঁচবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁরা! যাঁরা ঋণ নিয়ে বাড়ি / ফ্ল্যাট ইত্যাদি মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু করেছেন, তাঁরা নিজেদের ঋণশোধ কীভাবে করবেন, তা নিয়ে পড়েছেন অকূল সমুদ্রে। এমনকি কেউকেউ ইতিমধ্যেই ‘আত্মহত্যা’-র মতো ভয়ঙ্কর শব্দও উচ্চারণ করেছেন!
রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী’ অবশ্য দার্শনিকের মতো মহান ভরসার কথা শুনিয়েছেন তাঁদের, “ধৈর্য ধরুন”! আর ঠিক তার পরেই, সরাসরি তাঁরই পরিচালনাধীন উর্দিধারী ঠ্যাঙারে বাহিনী এইসব চাকরিহারা শিক্ষকদের উপর বর্বর হামলা চালালো! সমগ্র শিক্ষক সমাজের সামাজিক মর্যাদাকে চরম অসম্মান করলো। সরকারি কোষাগার থেকে (অর্থাৎ এইসব ‘চাকরিহারা শিক্ষক’-দেরও ট্যাক্সের টাকা থেকে) কোটিকোটি টাকা খরচ করে, বছরের পর বছর মামলা চালিয়ে গেছেন যাঁরা, তাঁরাই এখন উল্টোসুরে গান গাইবার চেষ্টা করছেন– “আমরা আপনাদের পাশেই ছিলাম, আছি, থাকবো”! বছরের পর বছর সাপ হয়ে কেটেছেন, এখন ওঝা হয়ে ঝাড়ার নাটক শুরু হয়েছে। কথায় বলে, “সবকিছুরই সীমা থাকে।” কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে – সরকারপক্ষের নির্লজ্জতা, দ্বিচারিতা, বেহায়াপনা, চাটুকারিতা, মিথ্যাচারিতা, অমানুষতা, এসবের কোনও সীমা-পরিসীমা থাকে না। আগেও বহুবার তা প্রমাণিত হয়েছে। আবার প্রমাণিত হলো।
পুলিশ যখনতখন ইচ্ছে মতো যাকে খুশি লাথি মারবে আর লাঠিপেটা করবে, সেটা তাদের সাংবিধানিক ‘অধিকার’! আর সমাজকে শিক্ষিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত যোগ্য ইস্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিনা অপরাধে চাকরি হারাবেন, পুলিশের লাথি-লাঠি খাবেন এবং অসম্মানিত হবেন, এটা কী তাঁদের গণতান্ত্রিক ‘কর্তব্য’? কিছু শয়তানের চুরি-জোচ্চুরি-জালিয়াতির দায়ে কেন হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীরা চাকরিহারা হবেন?
যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিনা অপরাধে লাথি-লাঠি খেলেন, চক-ডাস্টার ছেড়ে প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও যাঁরা শান্তিপূর্ণ মিছিল-জমায়েত করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই এই বর্বর পুলিশ উল্টে মামলা করেছে! ‘নির্বাচিত সরকার’-এর কী বিচিত্র গণতান্ত্রিক রূপ!!
এইধরণের ‘গণতন্ত্র’ কার স্বার্থ রক্ষা করছে? আমরা দেখছি, সরকারি ঠ্যাঙারে বাহিনীর লাথি-লাঠি পর্বের পরে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মনোবল আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আজই হাজার হাজার যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীর দৃষ্টান্তমূলক জমায়েত দেখেছে সরকারি পক্ষ, – সল্টলেকে শিক্ষা দপ্তরের সামনে। শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীদের ১২ জন প্রতিনিধির সঙ্গে মিটিং হয়েছে শিক্ষামন্ত্রীর। আড়াই ঘন্টার মিটিংয়ে শিক্ষকদের সরাসরি দাবির সোজাসাপ্টা সমাধান কিছুই হয় নি! ‘আইন’, ‘এসএসসি’, ‘সিবিআই’, ‘ওএমআর শিট’, ‘মিরর ইমেজ’, ‘হার্ডডিস্ক’, ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দের গোলকধাঁধা তৈরি হয়েছে মাত্র! যে সরকারি মাতব্বরদের ভূমিকার জন্য এতকিছু জটিলতা এবং হাজার হাজার চাকরি হারানোর অনভিপ্রেত ঘটনাবলি ঘটলো, সেই সরকার নিজেদের দোষ স্বীকার করে নি বা ক্ষমাও চায় নি। এক অনিশ্চিত ‘সম্ভাবনা’-র কথা শুনিয়েই শেষ হয়েছে মিটিং!
অন্যদিকে যে পুলিশ বর্বরভাবে লাথি-লাঠি চালিয়েছিল সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষক সমাজের উপর এবং জানিয়েছিলো “মৃদু বলপ্রয়োগ” করা হয়েছে,তারা এবারে জানিয়েছে “আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগ” করা হয়েছিলো!
সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকেও এই নানারকম সরকারি অন্যায় ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, ছাত্রছাত্রী, গবেষক, অধ্যাপক, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে সমাজের নানা স্তরের মানুষ আবার পথে নামতে শুরু করেছেন। বোঝা যাচ্ছে, এক তরফা “খেলা হবে” না এবার। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।।
১১ এপ্রিল, ২০২৫