গতকাল আমার জন্মদিন ছিল।
ছাপ্পান্ন বছর আগে চৈত্রশেষের এক ধুলোটে বিকেলে পড়ন্ত রোদ্দুর মেখে যে কন্যাটি জন্ম নিয়েছিল, তার কৃষ্ণচূড়ার ললাটিকা কবেই গিয়েছে ফিকে হয়ে — রুক্ষ, লাবণ্যহীন কপালে এখন শুধু ভাঙা চন্দনের মতো শ্রান্ত বলিরেখার রূপটান।
পালন করার কিছু ছিল না, থাকার কথাও নয়। তবু, দিনের শেষে অচিন্ত্যনীয় উপহার পেলাম। মানবিকতার উপর শাসকের কোটাল-শান্ত্রীদের দৃপ্ত, অলজ্জ পদাঘাতে চিরকালের জন্য কালিমালিপ্ত হয়ে গেল আমার জন্মদিন, ৯ই এপ্রিল।
সেই থেকে কেবলই অভিনয় করে চলেছি। বন্ধুস্বজনের শুভেচ্ছার উত্তরে হাসিমুখ ইমোজি দিয়ে লিখেছি — ভাল থেকো।
অথচ নির্ভুল জানি, কেউ ভাল নেই।
সুদূর নিউ জার্সি থেকে যে বাঙালি বন্ধুটি শুভকামনা জানিয়ে ফোন করেছিল, ইথার তরঙ্গে কয়েক হাজার মাইল পেরিয়ে আসা তার কণ্ঠস্বরে বেদনার তীব্র আভাসটি চিনতে ভুল হয়নি আমার।
শহুরে বন্ধু, দূর জেলার বান্ধব, যিনিই ফোন করেছেন, কথায় ঝরে পড়েছে হতাশা, গ্লানি, নিরুপায় অসহায়তার ক্ষোভ।
কেউ ভাল নেই।
আমি, তুমি, সে — কেউ না।
তবু কেক, মিষ্টি আর তরল হাস্যপরিহাসের সুনিপুণ মেকি উদযাপনে পার করে দিতে হয় দিনটা। দিয়েওছি।
সহকর্মীরা ‘ট্রিট’ চাইলে, ব্যাগ থেকে খাবার আনানোর জন্য টাকা বার করতে গিয়ে যখন নোটগুলো ছুঁয়েছি, মনে পড়েছে, এটাই আমার বছরের ৩৬৪ দিন মাথা নত করে ঘাড় গুঁজে অপমান সয়ে যাওয়ার যন্ত্রণার মূল্য। খুব দামি। এগুলো দিয়ে আমি চাল, আনাজ কিনি, ওষুধ কিনি, ইলেকট্রিক বিল দিই, গাড়িতে পেট্রল ভরি। আমার উপর নির্ভরশীল আরও দুটো পরিবারের অন্নের সংস্থান করে নোটগুলো।
তাই অস্ফুটে বলেছি, ক্ষমা করো নোট — তোমাকে আমি পোড়াতে পারি না, পদাঘাত করতে পারি না, মুখ ফিরিয়েও থাকতে পারি না।
আমার অন্তর নিঃশেষে জ্বলে খাক গেলেও নিঃসীম নৈরাজ্যের প্রতিকার খুঁজে পাই না কোত্থাও। তাই মাথা নত করে, ঘাড় গুঁজে তোমাকে মুঠোয় ভ’রে কাজ করি। নিজেকেই নিজে ক্ষমা করতে পারি না আজকাল আর।
নৈর্ব্যক্তিক হতে শিখেছি অনেকদিন। কোনও ঘটনার অভিঘাতেই মনে আর তেমন করে তরঙ্গ ওঠে না। ক্লান্ত হৃদয় আন্দোলন ভুলে গিয়েছে, এখনো ভোলেনি স্তিমিত লাব-ডুপ — হয়তো অভ্যাসবশতই।
২০২৫এ এক উদাসীন, স্বনির্বাসিতা, নির্মোহ মৃত্যুপিপাসিতার জন্মদিন পালন করলাম — জীবন যার কাছে তামাদি হয়ে যাওয়া মূল্যহীন এক তমসুক, রাখাও যায়, আবার ছাড়াও যায়।
ছবি : আন্তর্জাল