ইরানের মোল্লাতন্ত্রে মেয়েদের যেভাবে দেখা হয় সেটা মনুষ্যত্বের চরম অপমান। ওখানে মেয়েরা এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে কোনো চরম পরিণতি। কারাগারের অন্ধকার কিংবা ফাঁসি। তবু সকল ভয় আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস উপেক্ষা করে ওখানকার মেয়েরা যেভাবে শেকল ছেঁড়ার চেষ্টা করছেন তা দেখে শ্রদ্ধা জাগে আর জাগে এই মৌলবাদের প্রতি ঘৃণা।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমেরিকা সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিকে উপেক্ষা করে যেভাবে ইরানের সার্বভৌমত্ব বোমার আঘাতে তছনছ করে দিচ্ছে সেই কুৎসিত দাদাগিরিকে সমর্থন করতে হবে।
ইজরায়েল স্রেফ গায়ের জোরে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের মুছে দিতে চাইছে। নির্বিচারে শিশুদের কীভাবে হত্যা করছে, হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তা দেখলে অন্তরাত্মা হু হু করে ওঠে। মাসের পর মাস গাজাকে অবরুদ্ধ রেখে অবিশ্রান্ত বোমাবর্ষণ করে চলেছে। খাবার, ওষুধ, পানীয় ইত্যাদি নিয়ে আসা আন্তর্জাতিক সাহায্যটুকুও তাঁরা ঢুকতে দিতে নারাজ, যাতে বোমার হাত এড়িয়ে যদি কিছু মানুষ বেঁচেও থাকেন তাঁরা যেন অনাহারে বা বিনা চিকিৎসায় মরে যায়। সারা পৃথিবী চুপ, কারণ একটাই, আমেরিকা!
হামাসের হামলা ও অপহরণের পাল্টা এই আক্রমণ এমন যুক্তি দেখিয়ে, যারা ঘোরতর মুসলমান বিরোধী তাদের অনেকেই ইজরায়েলকে সমর্থন করছেন। হামাসের সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করার অবশ্যই যুক্তি নেই। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বলতেই হয় হামাসের উৎপত্তির কারণ ইসরায়েলের পক্ষ থেকে প্যালেস্টাইনের আরও আরো ভূমি দখলের ক্রমাগত গাজোয়ারি চেষ্টা আর নির্বিচার দাদাগিরি। ইসরায়েলের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী একটু নরমপন্থী রাবিন প্যালেস্তাইন লিবারেশন আর্মির প্রধান ইয়াসের আরাফতের সঙ্গে অসলো শান্তি চুক্তি করেছিলেন ১৯৯৩-তে। দুজনেই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু ইজরায়েলের চরমপন্থী জায়ানিস্টরা রবিনকে হত্যা করে, আজকের কট্টর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উত্থান হয় এবং ইসরায়েল শান্তি চুক্তি উড়িয়ে দেয়। আরাফাতেরও মৃত্যু হয় আচমকা, রহস্যজনকভাবে। ইজরায়েলের দাদাগিরির রথ চলতে থাকে গড়গড়িয়ে, আজ গাজাতে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূখণ্ডেই দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক, তাদের কথায় এ যেন আসলে একটা জেলখানা যার মাথার ওপরটুকুই শুধু খোলা। সবকিছুই ইজারায়েলীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ওখানে। আর এখন লক্ষ্য যেন তেন প্রকারেন গাজা থেকে, ফিলিস্তিনিদের পুরো নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। বেঁচে থাকার এরকম পরিমন্ডলে সন্ত্রাসবাদের উত্থান অনিবার্য, ফলে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া আরাফাতের পিএলওর জায়গায় এসেছে হামাস। আর এর জন্য দায়ী ইসরায়েল নিজে।
কিন্তু এসব ইতিহাস না ঘেঁটেও বলা যায়, হামাসের সন্ত্রাসবাদ ও কিছু ইজরায়েলিদের পণবন্দি করার জন্য লাখ খানেক নিরীহ নাগরিককে নির্বিচারে হত্যাকে বোধহয় একমাত্র হিটলারের নৃশংসতার সঙ্গেই তুলনা করা যায়।
দশকের পর দশক জুড়ে ইজরায়েলের এই বেপরোয়া মনোভাব শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে আমেরিকার প্রশ্রয়ে। কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক অন্যায়, অপরাধ করে গেছে ইসরায়েল ক্ষমতার জোরে, আর এই ক্ষমতায় উৎসে রয়েছে আমেরিকা যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পৃথিবীর দাদা হয়ে বসেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের তৈল ভূখণ্ডে শকুনের মত দৃষ্টি মেলে রয়েছে যাতে এমন কোনো শক্তির উদ্ভব না হয় যে তাকে অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস দেখায় এবং ওই অঞ্চলের দাদা হয়ে বসে। এর আগে ইরাকে গণবিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র মজুত আছে এই অজুহাত দেখিয়ে ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে মেরেছিল আমেরিকা (যার দোসর ছিল ব্রিটেন)। আর এবার পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের কারণ দেখিয়ে ইরানকে সবক শেখাতে চাইছে ইজরায়েলের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে।
ইরাক যুদ্ধের পর দেখা গেল আমেরিকার অভিযোগ ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। এবারও হয়ত তাই হবে। কিন্তু এই ভয়াবহ অন্যায় কিংবা অপরাধের বিচার করবে কে? রাষ্টপুঞ্জ? আমেরিকার মত বৃহৎ শক্তির কাছে নতজানু হয়ে থাকা একটা সংগঠনের মূল্য এই প্রেক্ষিতে কতটুকু?
২০০৩ সালে আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করেছিল তখন সাদ্দাম রাষ্ট্রপুঞ্জের সহায়তা চেয়েছিলেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধানরা একবার মিন মিন করে আমেরিকাকে, ‘এ্যাই দুষ্টু, যুদ্ধু করে না সোনা’ বলতে গিয়েছিল। কিন্তু তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের এক দাবড়ানিতে সবাই চেপে যায়।
এসব নিয়ে সেসময় একটা গান বানিয়েছিলাম। সেটা খুঁজে পেলাম হঠাৎ। একেবারে ঘরোয়া প্রচেষ্টা, তবে মনে হল এখনও বিষয়টা একইরকম আছে। তাই পোস্ট করছি। শুনে দেখুন।