গভীর রাত।
কলকাতার উপকণ্ঠে এই নগরে রাত্তির নামে যেন তাড়াহুড়ো করে।
কিছু হাসপাতাল। সেখানে রাত্তির অন্যরকম। সামনে প্রতীক্ষারত উৎকণ্ঠিত কিছু মুখ। রাত ঘন হয়ে এলে সেখানেও ঘুম নামে। ঘুম না হোক, তন্দ্রা। ক্লান্তি আর আচ্ছন্নতা।
হাসপাতাল থেকে দূরে ছোট্ট অফিসঘর। গায়ের উপরে কোনও বাড়িঘর নেই। আশেপাশে ঝোপঝাড়। এখানে রাত নামে আরও তাড়াতাড়ি। অফিসে তালা পড়ে যায় ওই সাড়ে ছটা নাগাদ। তারপর শুধু একজন পাহারাদার। একতলায় তার ঘর থেকে ভেসে আসে গরম রুটির গন্ধ। কিন্তু সে সুবাস বুক ভরে টেনে নেওয়ার বাড়তি কেউ নেই।
সামনে সরু সার্ভিস রোড। ঝোপঝাড় গাছপালার ফাঁক গলে যেটুকু আলো আসে, তা অন্ধকারকেই যেন আরও গাঢ় করে।
তার পর চওড়া রাস্তা। হুহু করে ছুটে যায় গাড়ি। চাকার শব্দ শুধু। মাঝেমধ্যে কার স্টিরিওর গান। এ রাস্তায় হর্ন বাজানো নিষ্প্রয়োজন।
রাত আরও গাঢ় হয়।
ঝোপঝাড় আলো-আঁধারির মাঝে দু-চারটে ছায়ামূর্তি যেন আনাগোনা করে। সঠিক ঠাওর হয় না। খুঁটিয়ে দেখতেও যেন গা-ছমছম করে। পথচলতি গাড়ির জানালা দিয়ে ছায়ামূর্তি দেখতে চাইলে মনে হয়, চোখের ভুল।
একটু থমকে দাঁড়ালে যেন দেখা যায়, মুহূর্তে মিলিয়ে যাওয়া ছায়ামূর্তি আবার যেন ফিরে আসে। আলো-আঁধারির মধ্যে চলতে থাকে অনিয়মিত যাতায়াত।
আরও একটু থমকে দাঁড়ালে বোঝা যায়, গাড়ি। গাছের আড়ালে রাখা।
ছায়ামূর্তিরা অফিসের আশেপাশে জড়ো হতে থাকে।
ওরা অন্ধকার ভালোবাসে। অশরীরী নয়, তবু অন্ধকার হলে ওদের কাজের সুবিধে।
আলো ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর কিছু মানুষ আস্তে আস্তে জড়ো হয়। অন্ধকারের প্রাণীদের প্রতিরোধ করতে।
রাতের ঘুম, বিছানার আরাম – সব প্রলোভন ছেড়ে একজোট হয়ে এগোতে থাকে।
ছায়ারা পিছু হটে।
আলোর মানুষগুলোর ছায়া দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়।
অন্ধকার জেতে না। একটা বা দুটো ছোট লড়াইয়ে পিছোতে হলেও, শেষমেশ জেতে আলো-ই, এ কাহিনী ইতিহাসে বারবার পড়া হয়। পড়া হয়, তবু বিশ্বাস হয় না।
তার পরও কেউ কেউ বিশ্বাস করে। কেউ কেউ বিশ্বাস রাখে।
কেউ কেউ জেগে থাকে বলে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যেতে পারি।
যেমন, খবর পাওয়ামাত্র মেডিকেল কাউন্সিল অফিসের সামনে জড়ো হওয়া জয়েন্ট প্ল্যাটফর্মের ডাক্তাররা।
এঁদেরও বাড়ি-ঘরদোর পরিবার-পরিজন হাসপাতাল-প্র্যাক্টিস সবই আছে। গরমের রাত্তিরে পাখা-এসি চালিয়ে ঘুমোতে এঁদেরও ভালো লাগে।
তবু, এঁরা জেগে থাকেন। জেগে থাকেন, পাশে থাকেন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান আপনার জন্য, আপনাদের জন্য।
আপনি এঁদের পাশে রইলেন কিনা জানি না, কিন্তু এটুকু জানি, আপনার বিপদে-আপদে এঁরা আপনার পাশে থাকবেন। যেমন ছিলেন গতকাল বা পরশু, যেমন রয়েছেন আজ…