বাউড়িয়া থেকে চেঙ্গাইল হয়ে ফুলেশ্বর-উলুবেড়িয়া অবধি গঙ্গার ধার বরাবর কারখানার সারি—পাঁচটা জুটমিল, দুটো কটনমিল।
২৫ বছর আগে কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র। শ্রমিকরা মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগী হিসেবে আসা শুরু করলেন। জুট ও কটন মিলের শ্রমিকদের শ্বাসকষ্ট দেখতে লাগলাম, অনেকটা হাঁপানির মত কাশি-সাঁইসাঁই শব্দ…। ধূমপায়ী-অধূমপায়ী নির্বিশেষে এই ধরনের সমস্যা পাওয়া যেতে লাগল।
সত্যি কথা বলতে কি আমাদের ডাক্তারী পাঠক্রমে পেশাগত রোগ কোন গুরুত্বই পায় না—রোগগুলোকে চেনা বা রোগগুলোর চিকিৎসা করা কিছুই শেখানো হয় না আমাদের। আমাদের সময়কার প্রিভেন্টিভ ও সোশাল মেডিসিন, বর্তমানের কমিউনিটি মেডিসিনের ৭১১ পাতার বইয়ে পেশাগত রোগগুলোর ভাগে জোটে ১৬টা পাতা। সেখানে কটনমিলের শ্রমিকদের পেশাগত রোগ ‘বিসিনোসিস’-এর কথা দেখেছি, জুট শ্রমিকদের শ্বাসরোগের কথা সেখানে অনুল্লিখিত বলা চলে। আসলে আমাদের ডাক্তারীর পাঠ্যবই লেখা হয় পাশ্চাত্যের পাঠ্যবই-এর অনুকরণে। সে সব দেশে জুটশিল্প কোথায়? জুটশিল্প তো কেবল বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানে।
আমরা বছর কুড়ি আগে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসা জুটশ্রমিকদের শতাধিককে নিয়ে একটা পাইলট সার্ভে করি। প্রশ্নের উত্তর নথিভুক্ত করার পাশাপাশি আমরা তাঁদের ওজন, উচ্চতা এবং পিক ফ্লো-মেট্রি (ফুসফুসের কর্মক্ষমতা মাপার একটা সহজ পরীক্ষা, যার জন্য পিক ফ্লো-মিটার নামের একটা কমদামী যন্ত্র লাগে)। সার্ভের ফলাফল ঈঙ্গিত দেয়—কটনশ্রমিকদের বিসিনোসিসের মত জুটশ্রমিকদেরও এক বিশেষ পেশাগত শ্বাসরোগ হয়।
পেশাগত শ্বাসরোগ ইংরেজীতে বলে Occupational Dust Diseases। ধূলিবহুল পরিবেশে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের এই ধরনের রোগ হয়।
Dust বা ধুলো হল ০.১ থেকে ১৫০ মাইক্রনের কঠিন পদার্থকণা। কঠিন পদার্থকে গুঁড়ো করা (crushing), পেষা (grinding), ঘষা (abrading), মাল ভরা (loading), মাল খালাস (unloading) ইত্যাদির সময় পরিবেশে ধুলো ছড়ায়। ১০ মাইক্রনের বড় মাপের ধূলিকণা দ্রুত বাতাস থেকে থিতিয়ে পড়ে, কিন্তু তার চেয়ে ছোট মাপের ধূলিকণাগুলো অনির্দিষ্ট কাল বাতাসে ভাসতে থাকে।
ধূলিবহুল পরিবেশে আমরা যখন শ্বাস নিতে বাধ্য হই তখন বাতাসে ভাসমান ধুলো আমাদের শ্বাসতন্ত্রে ঢোকে। শরীরেরও প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা আছে। একটু বড় ধুলোগুলো নাকের লোমের ছাঁকনিতে আটকা পড়ে। তার চেয়ে একটু ছোট ধুলোগুলো নাক পেরিয়ে স্বাসনালীতে ঢুকলে শ্বাসনালীর ভিতরের দেওয়ালের সূক্ষ্ণ লোমের মত সিলিয়া কিছু ধুলোকে ঝেঁটিয়ে বার করে। কিন্তু ৫ মাইক্রনের চেয়ে ছোট ধূলিকণাগুলো সোজা ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোতে ঢুকে থেকে যায়। ধূলিকণা থেকে যে রোগগুলো হয়, একসাথে সেগুলোকে বলা হয়—নিউমোকোনিয়োসিস (pneumoconiosis)।
যেসব ধূলিকণা ফুসফুসের ভেতর ঢোকে সেগুলো জৈব হতে পারে বা অজৈব, দ্রাব্য হতে পারে বা অদ্রাব্য। দ্রাব্য পদার্থ ধীরে ধীরে রক্তে মেশে তারপর শরীরের নিকাশী ব্যবস্থা দিয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। অদ্রাব্য পদার্থগুলো মোটামুটি স্থায়ীভাবে ফুসফুসে থেকে যায়। নিউমোকোনিয়োসিস হওয়ার প্রধান কারণ এই অদ্রাব্য পদার্থগুলোই।
সব ধূলিকণায় এক রকম ক্ষতি হয় না। ধূলিকণা থেকে ফুসফুসের কতটা ক্ষতি হবে তা নির্ভর করে কতগুলো বিষয়ের ওপর—ধূলিকণার রাসায়নিক গঠন, কতটা সূক্ষ্ণ—যত সূক্ষ্ণ ক্ষতি তত বেশী, কর্ম পরিবেশের বাতাসে ধূলিকণার ঘনত্ব কতটা, ঘনত্ব যত বেশী ক্ষতি তত বেশী, কত দিন ধরে ধূলিবহুল পরিবেশে কাজ করা হচ্ছে এবং শ্রমিকের স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন।
যে পেশাগত শ্বাসরোগগুলো সম্বন্ধে আমরা কম বেশী জানি তাদের মধ্যে অন্যতম সিলিকোসিস। এ রোগ হয় কর্মপরিবেশের বাতাসে সিলিকা থেকে। এন্থ্রাকোসিস হয় কয়লা খনি শ্রমিকদের। বিসিনোসিস হয় টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের ফুসফুসে দীর্ঘ দিন ধরে তুলোর রোঁয়া ঢুকে। চিনি-শিল্প ছাড়াও কাগজ, কার্ড বোর্ড, রেয়ন শিল্পে আখের গুঁড়ো ঢুকে হয় ব্যাগাসোসিস। এসবেস্টোসিস—এসবেস্টস শিল্প-শ্রমিকদের রোগ। সিডারোসিস হয় লোহার ধুলো থেকে। সিগারেট-বিড়ি শিল্পের শ্রমিকদের টোব্যাকোসিস হয়।ছত্রাকযুক্ত খড় বা শস্যকণা থেকে ফার্মার্স লাংগ হতে পারে কৃষির সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের।
ধূলিবহুল পরিবেশে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা পেশাগত শ্বাসরোগ দেখা দিচ্ছে সন্দেহ করবেন তখন, যখন ধূমপান না করা সত্ত্বেও কাশি লেগে থাকে, সর্দি-জ্বর নেই অথচ যদি কফ উঠতে থাকে এবং যদি হাঁফিয়ে পড়তে থাকেন। কিছু দিন ধূলিবহুল কর্মপরিপেশে কাজ করার পর কাজের সপ্তাহের প্রথম দিনে বুকে চাপ ভাব লাগে প্রথমে মাঝে-মধ্যে। তারপর নিয়মিত ভাবেই কাজের সপ্তাহের প্রথম দিনে বুকে চাপ ভাব লাগে বা শ্বাসকষ্ট হয়। তারপর প্রতি কাজের দিনেই বুকে চাপ ভাব লাগে বা শ্বাসকষ্ট হয়। শেষে সব সময়ই বুকে চাপ ভাব লাগে বা শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। সর্দি-জ্বর ছাড়াও বুকে সাঁই-সাঁই আওয়াজ হয়। বুকের কষ্টের জন্য মাঝে মাঝে ছুটি নিতে হয়।
কোন কোন পেশাগত শ্বাসরোগে বুকের এক্স-রে তে নির্দিষ্ট কিছু চিহ্ন দেখা যায় বটে কিন্তু বিশেষ প্রশিক্ষণ না থাকলে ডাক্তার তা চিনতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রেই। স্পাইরোমেট্রি পরীক্ষায় ফুসফুসের কর্মক্ষমতা মাপা হয়। কাজে যাওয়ার আগে এবং পরে পরীক্ষা করলে কাজের সঙ্গে কষ্টের সম্পর্ক নির্ধারণ করা যায়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মিত এই পরীক্ষা করলে বোঝা যায় কি ভাবে কর্মক্ষমতা কমছে।
এসব রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। ফুসফুসের বায়ুথলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে শ্বাসনালী প্রসারক (ব্রংকোডায়ালেটর)-এ কিছু লাভ পাওয়া যেতে পারে। পেশাগত শ্বাসরোগের রোগীদের জীবাণুসংক্রমণের প্রবণতা বেড়ে যায়। যেমন সিলিকোসিসের রোগীদের ফুসফুসের যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি বেশী। জীবাণুসংক্রমণ হলে তার চিকিৎসা করতে হয়।
তাই প্রতিরোধই উপায়। কর্মপরিবেশের ধুলো কমাতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার—যেখানে ধুলো উৎপন্ন হচ্ছে সে জায়গাটা আলাদা করে রাখা, সাধারণ বিস্ফোরণ (blasting)-এর বদলে জলের সাহায্যে বিস্ফোরণ (hydroblasting) ঘটানো-র মত প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, ইত্যাদি। যে পদার্থ বেশী ক্ষতিকর তার বদলে কম ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহার করলে ক্ষতি কম হয়। ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য মুখোশের মত কিছু ব্যবস্থায় সামান্য লাভ হয়। সবচেয়ে দরকার হল শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য-পরীক্ষা, যাতে পেশাগত শ্বাসরোগ শুরু হলেই শ্রমিককে নিরাপদ কোন কাজে পুনরবাসিত করা যায়।
পেশাগত রোগ নির্ণয়কেন্দ্র চাই,ডাক্তারদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ চাই।
শুরুতেই বলেছিলাম ডাক্তারী পাঠক্রমে পেশাগত রোগ গুরুত্ব পায় না। তার ফলে শ্রমিকের পেশাগত শ্বাসরোগ চিনতে ভুল হয় তাঁদের। তাছাড়া পেশাগত শ্বাসরোগ নির্ণয় করতে যে যন্ত্রের খুব প্রয়োজন সেই স্পাইরোমিটার নেই বেশীর ভাগ সরকারী হাসপাতালে। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে এই পরীক্ষা করাতে খরচ পড়ে অন্তত ৪০০ টাকা। দেশে ই এস আই হাসপাতাল আছে অনেকগুলো সেগুলোতেও পেশাগত রোগ নির্ণয়ের যথাযথ ব্যবস্থা নেই।
অন্য পেশাগত শ্বাসরোগগুলোর তবু আইনী স্বীকৃতি আছে, যদি প্রমাণ করতে পারেন তাহলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। জুট শ্রমিকদের শ্বাসরোগের তো স্বীকৃতিই নেই!