বিশ্বের – সর্বাপেক্ষা সামরিক ও প্রযুক্তি শক্তিধর এবং রাজনীতি ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রক; চিনের পর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি (২৯.১৭ ট্রিলিয়ন বা লক্ষ কোটি ডলার); তৃতীয় বৃহত্তম (৯.৮ লক্ষ বর্গ কিমি) ও জনবহুল (> ৩৪০ মিলিয়ন বা ৩৪ কোটি); মাথা পিছু আয়ে অষ্টম (বার্ষিক ০.৮৭ মিলিয়ন ডলার); জীবনযাত্রার মানে ২০ তম (এইচ.ডি.আই ৯.২৭) রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা দ্য ইউনাইটেড স্টেট্স অফ আমেরিকা (দ্য ইউএস)। শিল্প বিপ্লবোত্তর ইংল্যান্ডের বাণিজ্য অর্থনীতির হাত ধরে তার উপনিবেশ আমেরিকায় যে পুঁজিবাদের সূচনা ১৭৭৬ এর স্বাধীনতার পর অপার প্রাকৃতিক সম্পদকে ধরে, ফ্রাঙ্কলিন – এডিশন – টেসলা প্রমুখ বিজ্ঞান সাধকদের যুগান্তকারী আবিষ্কারের উপর আধুনিক শিল্প গড়ে তার বিকাশ। গত শতাব্দীর দু দুটি বিশ্বযুদ্ধে নিজ ভূখণ্ডে যুদ্ধ না হতে দিয়ে, সবচাইতে দেরিতে যোগ দিয়ে, সবচাইতে কম ক্ষয়ক্ষতি অথচ সবচাইতে লাভবান হয়ে এবং বিজয়ী পক্ষে থেকে সে বিশ্বের যাবতীয় সম্পদের দখলদারি ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করে। সেইসঙ্গে বিশ্বের সেরা মগজগুলি ও দক্ষ শ্রমকে জড়ো করে (Brain and Labour Drain) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কার ও উল্লম্ফন ঘটিয়ে মহামন্দার (Great Depression) সংকটকে কাটিয়ে পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির রমরমা সৃষ্টি করে। ১৯৯১ তে প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ভাঙ্গনের পর বিশ্বের একেমাদ্বিতীয়ম শক্তি হিসাবে উঠে আসে এবং আবিশ্ব তার নবউদারবাদী অর্থনীতির বিশ্বায়ন (Neoliberal Globalization) ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ ঘটায়। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বের কৌতূহল থাকবে। তার উপর যদি ১৩১ বছর আগের প্রেসিডেন্ট গ্রোভার কিভল্যান্ডের সময়কার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আবার ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন ৭৮ বছর বয়সী ধনকুবের ব্যাবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প তাহলে তো আলোড়ন সৃষ্টি হবেই। যিনি কিনা ইতিমধ্যে আলটপকা মন্তব্য, খামখেয়ালি কার্যকলাপ, উগ্র স্বভাব, রক্ষণশীলতা, অশ্বেতাঙ্গ ও নারী বিদ্বেষ, পরিবেশ বিরোধিতা প্রভৃতির জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। অপরাধী সাব্যাস্ত হয়েছেন যৌন কেলেঙ্কারি, আর্থিক কারচুপি, নিয়মভঙ্গ, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে। এমনকি নজিরবিহীনভাবে আইনসভায় কঠোরভাবে নিন্দিত (Impeached) হয়েছেন।
নির্বাচনের অন্তরালেঃ কোন কোন মহলে ট্রাম্পকে এক হাস্যকর ক্ষ্যাপাটে চরিত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়। এর জন্য অবশ্য ট্রাম্পের অপরিশীলিত, অশালীন, আগ্রাসী ও আবোলতাবোল কথাবার্তা ও আচরণ দায়ী। আসলে ট্রাম্প একজন ধূর্ত, শঠ, দুর্নীতিপরায়ণ, সফল ব্যাবসায়ী যিনি পিতার বিষয় সম্পত্তি ও গৃহ নির্মাণের (Real Estate) বিশাল ব্যাবসাকে বৈধ অবৈধ নানা প্রক্রিয়ায় বহুগুণ বাড়িয়েছেন। তার সঙ্গে হোটেল, ক্যাসিনো, ক্লাব, বিউটি পাজেন্ট, রিয়েলিটি শো, মেডিয়া প্রভৃতি লাভজনক ব্যাবসায়ে দুহাতে অর্থ উপার্জন করেছেন। সঙ্গে চালিয়ে গেছেন স্বেচ্ছাচারী, আইনবিরুদ্ধ ও ব্যাভিচারমূলক কাজকর্ম। অন্যদিকে তিনি একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, স্বার্থপর, উগ্র জাত্যাভিমানী, ডাকাবুকো ব্যাক্তিত্ব। অভিবাসীর চাপ, অর্থনীতির সমস্যা, বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা, ইউক্রেন – পালেস্টাইন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিবিধ যুদ্ধ ও সমস্যার ভার বহন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিস্পর্ধী চিনা ড্রাগনের উত্থান, দেশের অভ্যন্তরে শ্বেতাঙ্গ শিল্প শ্রমিক ও খামার মালিকদের পড়ন্ত অবস্থা, কর্মহীন ও গৃহহীনদের সংখ্যা বৃদ্ধি, বন্দুক সংস্কৃতি, ড্রাগের নেশা প্রভৃতি মোকাবিলার জন্য পারকিনসন্স ডিজিজ আক্রান্ত বৃদ্ধ জো বাইডেন কিংবা সৌম্য পরিশীলিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী কমলা হ্যারিসের পরিবর্তে মার্কিন সমাজ – অর্থনীতিতে, নির্দিষ্টভাবে বাহুল্য হ্রাস পাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ তুলনামূলক কম প্রতিষ্ঠিত শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যার স্বার্থরক্ষায়, মার্কিন স্বার্থবিরোধীদের মারকাটারি হুমকি দেওয়া, দাপুটে, চাছাছোলা ভাষায় উগ্র জাতীয়তাবাদী কথাবার্তা এবং জনবাদী (Populist) প্রকল্পের ইঙ্গিত দেওয়া ট্রাম্পের মত এক ব্যাক্তিত্বর আবাহনের পথ প্রস্তুতই ছিল।
যদি নিরীক্ষণ করা হয় দেখা যাবে যে মার্কিনীদের পূর্বসূরি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা ভারতীয় উপনিবেশে এমন সব আগ্রাসী গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়দের পাঠাতন যারা ছলে বলে কৌশলে প্রয়োজনে রক্তগঙ্গা বইয়ে একের পর এক নতুন ভূখণ্ড দখল করে, যাবতীয় সম্পদ লুঠ করে, প্রসিদ্ধ স্থানীয় শিল্পগুলিকে ধ্বংস করে, সেখানকার জনসাধারণকে অত্যাচার ও শোষণ করে, শ্রম নিংড়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতেন। পরের পর্বে পাঠানো হত কিছুটা পরিশীলিত এমন একজনকে যিনি কিছুটা সংযম দেখিয়ে, কিছু সংস্কার করে ভারতবাসীর ক্ষোভকে কিছুটা প্রশমিত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সংহত করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সেরকম। আমরা ফ্রাঙ্কলিন রজভেল্টের বিস্তৃত সংকট প্রশমনের কাল থেকেই দেখি। তারপর অ্যাটম বোমা ফেলা হ্যারি ট্রুম্যান ও দাপুটে ডুইট আইসেনহাওয়ার। তারপর মডারেট জন কেনেডি ও লিন্ডন জনসন। তারপর ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া যুদ্ধখ্যাত ‘হকিশ’ রিচার্ড নিক্সন। তারপর নরমপন্থী জেরাল্ড ফোর্ড ও জিমি কার্টার। তারপর প্রবল আক্রমণাত্মক রোনাল্ড রেগন ও জর্জ হারবারট বুশ। এই পর্বেই গ্রানাডা, পানামা, লিবিয়া ইত্যাদি আক্রমণ, উপসাগরীয় যুদ্ধ। এরপর নরমপন্থী বিল ক্লিনটন। আবার আক্রমণাত্মক জর্জ ওয়াকার বুশ, ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণ। এরপর পরিশীলিত বারাক ওবামা। তারপর ট্রাম্প।
২০২৪ এর নির্বাচনঃ এবার নির্দিষ্টভাবে ঐ নির্বাচনটির দিকে তাকাই। ২০২২ থেকে ট্রাম্প এই নির্বাচনটিকে পাখির চোখ করে এগিয়েছেন। তার পেছনে সামিল হয়েছেন মার্কিন মুলুক এবং তার বিশ্ব নীতি যারা নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করেন সেই তথ্য প্রযুক্তি, ই – বানিজ্য, ব্যাঙ্কিং, মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণা, মিসাইল ড্রোন সহ বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পেট্রোলিয়াম, ফার্মাসিউটিকাল, সার, বীজ, নির্মাণ, বীমা, অটোমোবাইল, বিষয় সম্পত্তি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যাবসা, বিনোদন, বিমান পরিবহন প্রভৃতি শিল্পের মার্কিন কেন্দ্রিক বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলির অতি ধনী মালিকদের একটি বড় অংশ তাদের অফুরন্ত ডলারের ঝুলি নিয়ে। এরা বিভিন্নভাবে জনমতকে প্রভাবিত করে থাকেন। যেমন স্পেস এক্স, টেসলা, এক্স করপ, ওপেন এআই প্রভৃতি সংস্থার কর্ণধার দক্ষিণ আফ্রিকায় জাত কানাডা হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা বিশ্বের সবচাইতে ধনী ইলন মাস্ক। ট্রাম্পের প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে মাস্ক ইতিমধ্যেই ট্রাম্প সরকারের একটি বিশেষ দফতরের দায়িত্ব পেয়েছেন। ট্রাম্পের মত এই মাস্ক, ম্যাট গেটজ, পিটার হেগসেথ প্রমুখ ট্রাম্প বাহিনীর অনেকের বিরুদ্ধে মহিলাদের যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ প্রভৃতি জনপ্রিয় শ্লোগান, কঠোর অভিবাসন ও বাণিজ্য নীতি, রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ পারিবারিক মূল্যবোধ, গর্ভপাত বিরোধিতা, সমকাম ও তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে বাড়াবাড়ির বিরোধিতা, পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে বাড়াবাড়ির বিরোধিতা, যুদ্ধগুলি থেকে সরে আসা, গৃহহীনদের গৃহ ও কর্মহীনদের কর্মসংস্থান সহ অর্থনীতির উন্নতি সাধন, কর কাঠামো ও স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার সংস্কার ইত্যাদি দাবিতে ট্রাম্প প্রচারের ঝড় তোলেন। মনোনয়নের প্রাথমিক পর্বে অপর রিপাবলিকান মনোনয়নকারী রন ডি স্যান্তিস ও পরবর্তী পর্বে নিকি হ্যালিকে পরাজিত করেন। বিবেক রামস্বামী এবং তুলসি গডারডকে প্রার্থী পদ তুলে নিতে রাজি করান। অন্যদিকে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন প্রাইমারিতে ডিন ফিলিপকে পরাজিত করে নিজেই প্রার্থী হলে বার্ধক্য ও অসুস্থতার কারণে দলের মধ্যেই বিরোধিতার সম্মুখীন হন। শেষে ২১ জুলাই তিনি যখন সরে দাঁড়ালেন তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। ডেমোক্রাটদের তরফে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী করা হয়। প্রথম থেকে প্রচারে পেছিয়ে পরেও হ্যারিস অনেকটা সামলে নেন এবং নির্বাচনের আগে প্রায় সমানে সমানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার সভায় বন্দুকবাজ কর্তৃক ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা তার দিকে অনেকখানি সহানুভূতির ঢেউ নিয়ে আসে।
নির্বাচনী ফলাফলঃ শেষদিকে হ্যারিসের সম্ভবনার গ্রাফ ঊর্ধ্বগামী দেখালেও এবং বিশেষজ্ঞরা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এর কথা ঘোষণা করলেও ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর দেখা গেল মোট ৫৩৮ টি সম্মিলিত ভোটের (Electoral Votes) মধ্যে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ২৭০ টি সম্মিলিত ভোট প্রয়োজন সেখানে ৩১২ টি পেয়ে ট্রাম্প বিপুলভাবে জয়লাভ করলেন। হ্যারিস পেলেন তার চাইতে বেশ কম ২২৬ টি সম্মিলিত ভোট। ব্যাক্তিগত ভোটের (Individual Votes) হারঃ ট্রাম্প (৪৯.৯%) এবং হ্যারিস (৪৮.৪%)। অন্যান্য পদপ্রার্থীদের মধ্যে জিল স্টোন (গ্রিন পার্টি) ০.৫%, রবার্ট কেনেডি (নির্দল) ০.৫%, চেজ অলিভার (লিবারটিয়ান পার্টি) ০.৪%, অন্যান্যরা ০.৩% ভোট পান। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৬৩.৯% ভোটার।
ব্যাক্তিগত ভোটদানের হারে ট্রাম্প ও হ্যারিসের পার্থক্য অল্প হলেও ইলেকটরাল ভোটের ক্ষেত্রে অনেকটা পার্থক্য হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন নির্বাচনের সম্মিলিত নির্বাচক মণ্ডলীর (Electoral Collegiums or College) বিশেষ ভুমিকা রয়েছে। দেশের ৫০ টি রাজ্যের জনসংখ্যা অনুযায়ী ইলেকটোরাল ভোট নির্ধারিত। সেই মত বিভিন্ন রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা। ১০ বা তার বেশি সংখ্যক ইলেকটোরাল ভোট বিশিষ্ট রাজ্যগুলি হলঃ ক্যালিফোর্নিয়া (৫৪), টেক্সাস (৪০), ফ্লোরিডা (৩০), নিউ ইয়র্ক (২৮), পেনসিলভানিয়া (১৯), ইলিনয়স (১৯), ওহাও (১৭), নর্থ ক্যারোলিনা (১৬), জর্জিয়া (১৬), মিশিগান (১৫), নিউ জার্সি (১৪), ভার্জিনিয়া (১৩), ওয়াশিংটন (১২), টেনেসি (১১), অ্যারিজোনা (১১), ম্যাসাচুসেটস (১১), কলরাডো (১০), মেরিল্যান্ড (১০), মিনসেটা (১০), মিসেসিপি (১০), মিজরি (১০), উইসকন্সিন (১০)।
মেইন ও নেব্রাস্কা বাদ দিয়ে অন্য রাজ্যগুলিতে যে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেকটরাল ভোট পান তিনি সেই রাজ্যের সব কটি ইলেকটরাল ভোট লাভ করেন। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প রিপাবলিকান দের ঘাঁটি টেক্সাস, ফ্লোরিডা, আয়মিং, ইউটা, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওকলাহোমা প্রমুখ ‘রেড ওয়াল স্টেট্স’ গুলি তো বটেই বেশ কিছু ডেমোক্রাটদের ঘাঁটি ‘ডিপ ব্লু’ স্টেট্স জিতে নেন। ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, মেরিল্যান্ড, ওয়াশিংটন, ইলিনয়স, ম্যাসাচুসেটস প্রমুখ কয়েকটি সমর্থনকারী রাজ্যে ডেমোক্রাটরা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হন। এছাড়াও নর্থ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া, নেভাডা, অ্যারিজোনা, উইসকন্সিন ও মিশিগান – এই সাতটি দোদুল্যমান ‘সুইং স্টেট্স’ বা ‘পার্পল স্টেট্স’ও ট্রাম্প জিতে নেন। ট্রাম্পের ঝুলিতে যায় ৩১ টি এবং হ্যারিসের ১৯ টি রাজ্য। মিনসেটা, ইলিনয়স, কলরাডো ও নিউ মেক্সিকো বাদ দিয়ে সমগ্র উত্তর, মধ্য, মধ্য পশ্চিম, মধ্য পূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব রাজ্যগুলি জুড়ে রিপাবলিকানদের লাল ঝড়। উত্তর পূর্বের মেইন থেকে পূর্বের ভারজিনিয়া অবধি অতলান্তিক মহাসাগরের এবং পশ্চিমের প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় রাজ্যগুলির মধ্যে এবার ডেমোক্রাটরা সীমাবদ্ধ থাকলেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একইসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন নির্ধারক কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সেনেট ও নিম্ন কক্ষ হাউস অফ রেপ্রেজেন্টেটিভস এর নির্বাচন হল। ১০০ আসন বিশিষ্ট সেনেটে (সংখ্যাগরিষ্ঠতা ৫১) রিপাবলিকানরা ৫৪ টি ও ডেমোক্রাটরা ৪২ টি আসন এবং হাউস অফ রেপ্রেজেন্টেটিভস এর ৪৩৫ টি আসনের (সংখ্যাগরিষ্ঠতা ২১৮) মধ্যে রিপাবলিকানরা ২০৪ টি ও ডেমোক্রাটরা ১৮২ টি আসন লাভ করেন। সুতরাং কংগ্রেসের দুটি কক্ষে এগিয়ে থাকায় ট্রাম্পের এবার আইন প্রণয়নে খুব সুবিধা হবে। ঐ সময়েই ১১ টি রাজ্যের গভর্নর নির্বাচনে রিপাবলিকানরা আটটি রাজ্যে ও ডেমোক্রাটরা তিনটি রাজ্যে জয়লাভ করেন। এছাড়াও স্টেট, কাউন্টি ও স্থানীয় স্তরের নির্বাচনেও রিপাবলিকানরা ভাল ফল করেন। ১০ টি রাজ্যে গর্ভপাত বিষয়েও ভোট হয়। ট্রাম্পের বিরোধিতা সত্ত্বেও নেভাডা, অ্যারিজোনা, মন্টানা, কলরাডো, মিজুরি, নিউ ইয়র্ক ও মেরিল্যান্ড গর্ভপাতের পক্ষে রায় দেয়। ২০২২ এর পর থেকে এখন অবধি ১৩ টি রাজ্য গর্ভপাত কে স্বীকৃতি দিল।
কারা কাকে ভোট দিলেন?
ক) লিঙ্গ ও জাতিগত ভোট বিন্যাসঃ
লিঙ্গ ও জাতি মোট জনসংখ্যার অনুপাত (%) ট্রাম্প (%) হ্যারিস (%)
পুরুষ ৪৭ ৫৫ ৪৩
নারী ৫৩ ৪৫ ৫৩
শ্বেতাঙ্গ ৭১ ৫৭ ৪২
কৃষ্ণাঙ্গ ১২ ১৩ ৮৬
লাতিনো বা হিস্প্যানিক ১১ ৪৬ ৫১
এশিয় ০৩ ৪০ ৫৫
জনজাতি ০১ ৬৮ ৩৮
অন্যান্য ০২ ৫২ ৪৪
[ শ্বেতাঙ্গ পুরুষরা (৩৪%) ৬০% ট্রাম্পকে ও শ্বেতাঙ্গ নারীরা (৩৭%) ৫৩% ট্রাম্পকে; কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষরা (৫%) ৭৭% হ্যারিসকে ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা (৭%) ৯২% হ্যারিসকে; লাতিনো পুরুষরা (৫%) ৫৪% ট্রাম্পকে ও লাতিনো নারীরা (৬%) ৫৮% হ্যারিসকে এবং এশিয় সহ অন্যান্যরা ৪৯% হ্যারিসকে ও ৪৭% ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।]
খ) শিক্ষাগত যোগ্যতা ভিত্তিক ভোট বিন্যাসঃ
শিক্ষাগত যোগ্যতা মোট জনসংখ্যার অনুপাত (%) ট্রাম্প (%) হ্যারিস (%)
শ্বেতাঙ্গ কলেজ ডিগ্রিহীন ৩৮ ৬৬ ৩২
শ্বেতাঙ্গ স্নাতক ৩৩ ৪৫ ৫৩
অশ্বেতাঙ্গ কলেজ ডিগ্রিহীন ১৮ ৩৪ ৬৪
অশ্বেতাঙ্গ স্নাতক ১০ ৩২ ৬৫
[রোজগার যাদের ৩০ হাজার ডলারের কম (১১%) তাদের ৫০% হ্যারিসকে, রোজগার যাদের ৩০ থেকে <৫০ হাজার ডলার (১৬%) তাদের ৫২% ট্রাম্পকে, রোজগার যাদের ৫০ হাজার ডলার থেকে < এক লক্ষ ডলার (৩২%) তাদের ৫২% ট্রাম্পকে, রোজগার যাদের এক থেকে < দু লক্ষ ডলার তাদের ৫১% হ্যারিসকে এবং রোজগার যাদের দু লক্ষ ডলার বা তার বেশি তাদের ৫২% হ্যারিসকে ভোট দেন। ]
কেন এমন হল? প্রথমত অর্থনীতি। মার্কিন অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী ও এখনও বিশ্ব নিয়ন্ত্রক হলেও পুঁজিবাদের নিজস্ব সমস্যায় ২০০৮ – ’০৯ এর ওয়াল স্ট্রিট ধ্বস (ব্যাঙ্ক, ফাইনান্স সংস্থা, শেয়ার বাজার ইত্যাদি), ধারাবাহিক মন্দা (Recession), স্থিতিস্ফীতি (Stagflation) প্রভৃতি সমস্যা এবং বিশ্ব জুড়ে চিনের প্রবল বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। বিশ্বায়নের ফলে কিছু বহুজাতিক সংস্থা এবং তাদের কিছু অতি ধনী মালিকেরা লাভবান হলেও গড়পড়তা মার্কিনীদের আয় বিশেষ বাড়েনি। অন্যদিকে খরচ বেড়ে গেছে। বিপরীতে মার্কিনীদের ঐতিহ্যশালী অনেকটাই শ্রমনিবিড় লৌহ ও ইস্পাত, ইঞ্জিনিয়ারিং, অটোমোবাইল, এরোপ্লেন প্রভৃতি বৃহৎ শিল্পগুলি জাপান, কোরিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এবং ভোগ্য পণ্য শিল্প চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছু হটেছে। বহু শ্রমিক কর্মচারী যাদের বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ কাজ হারিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্র কোন রক্ষা কবচ বা পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করেনি। উদীয়মান মেধা ও কৃত্তিম মেধা নিবিড় তথ্য প্রযুক্তি, টেলে যোগাযোগ, পরিষেবা শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। যেটুকু আছে সেটা উচ্চশিক্ষিত দক্ষ ভারতীয়, পূর্ব ইউরোপীয় ও চিনাদের দখলে। শ্রমের বাজারেও লাতিনো, হিস্প্যানিক, অ্যাফ্রিকান, ক্যারিবিয়ান, এশিয়দের পাল্লা ভারী। এই ক্ষোভ শ্বেতাঙ্গ ও আমেরিকান জ্যাত্যাভিমানে পর্যবসিত হয়ে দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের এবং জনসংখ্যার এই বিশাল অংশটির সামনে স্বপ্ন ফেরি করা ট্রাম্পের ভোট বাক্সে পড়েছে। শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, রুচিশীল, ধনী মানুষরা তাদের পছন্দের প্রার্থী হ্যারিসকে ভোট দিলেও সব কিছু গুছিয়ে নেওয়া এই এলিটদের বিরুদ্ধে পড়ন্ত অর্থনীতির শ্বেতাঙ্গরা ছাড়াও শ্রমজীবী কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ তাদের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। এর সঙ্গে ব্যায়বহুল স্বাস্থ্য বীমা, ওবামাকেয়ার, খরচ সাপেক্ষ শিক্ষা, ইলেকট্রিক যান নিয়ে বিতর্ক, পরিবেশ নিয়ে কড়াকড়ি, বন্দুকবাজি, ইউক্রেন ও মধ্য প্রাচ্যের যুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের যুক্ত হয়ে পড়া ইস্যু গুলি যুক্ত হয়েছে।
অন্যান্য কারণঃ সারা বিশ্ব থেকে ভালো ও নিরাপদে থাকার আশা ও বেশি উপার্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে যেভাবে মানুষ বৈধ ও অবৈধ উপায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসছেন, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার টালমাটাল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভেঙ্গে পড়া আইন শৃঙ্খলার আবহে যেভাবে অসংখ্য মানুষ সুড়ঙ্গ, স্থল, জল ও আকাশ পথে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ছেন, তাতে মার্কিন নাগরিক এবং বৈধ আভিবাসীরাও ত্রস্ত। এক্ষেত্রে বাইডেনের সহনশীল নীতির সঙ্গে ট্রাম্পের কঠোর নীতি বিগত নির্বাচনে অনেকটা পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গ মার্কিন সমাজে কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসী বিদ্বেষ এবং পিতৃতন্ত্র (Patriarchy) ছিলই। হাজারো বাধা কাটিয়ে সব ক্ষেত্রে মহিলারা এবং কৃষ্ণাঙ্গদের একটি অংশ উন্নতি করেছেন। বর্তমানে গড়পড়তা কম শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের পড়ন্ত অবস্থায় বিদ্বেষ আরও প্রকট হয়েছে। সামগ্রিকভাবে শ্বেতাঙ্গ সমাজের একটি বড় অংশ (সাবেকী ও গৃহকর্ম করা মহিলারা সহ) কৃষ্ণাঙ্গ, অভিবাসী ও মহিলাদের এগিয়ে যাওয়াকে নিজেদের পতনের কারণ মনে করেছেন। তাদের ধারণা ট্রাম্প এদের টাইট দিয়ে রাখতে পারবেন। তাই মহিলাদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এত অপরাধ তার নির্বাচিত হতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।
এছাড়াও ট্রাম্পের গর্ভপাত ও তৃতীয় লিঙ্গ বিরোধিতা, মার্কিন খ্রিস্টান পরিবারের মূল্যবোধ রক্ষার ডাক ইত্যাদি প্রভাব ফেলেছে। উত্তর, মধ্য ও মধ্য পশ্চিমের শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত সাবেকী শিল্প পতনের রাজ্যগুলিতে (Rust States) এবং দক্ষিণের পুরনো তুলো চাষ, দাস ব্যাবসা ও রোমান ক্যাথলিকদের ঘাঁটি রাজ্যগুলিতে (Dixieland) ট্রাম্প ঢালাও ভোট পেয়েছেন। তাই যথেষ্ট যোগ্য ও দক্ষ হয়েও প্রাক্তন ‘ইউনাইটেড স্টেট্স সেক্রেটারি অফ স্টেট’ শ্বেতাঙ্গিনী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন ২০১৬ র নির্বাচনে পিতৃতন্ত্রের এবং ২০২৪ র নির্বাচনে ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেট্স’ কমলা হ্যারিস শ্বেতাঙ্গ ও পিতৃতন্ত্রের দুর্গে ফাটল ধরাতে পারেননি। অ্যাফ্রো – এশিয় বংশোদ্ভূত আইনজ্ঞ কমলা দেবী হ্যারিস জার্মান – স্কট বংশোদ্ভূত ব্যাবসায়ী ডোনাল্ড জন ট্রাম্পের আগ্রাসী প্রচারের সঙ্গে সমানে সমানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও পরাজিত হলেন। পরাজিত হয়েও তিনি গতবারের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ট্রাম্পের ক্যাপিটল হিল আক্রমণ সহ ধুন্ধুমার আচরণের বিপরীতে বিনম্রভাবে জানালেনঃ “জনাদেশ মেনে নেওয়াই গণতন্ত্র”।
১৩.০১.২০২৫