করোনা দূর করতে আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় থালাবাটি বাজানো তৃতীয় বর্ষপূর্তির দিনে রাজস্থান সরকার স্বাস্থ্যের অধিকার বিল চালু করেছেন!মানুষের ভরসা ও স্ফূর্তির জন্যই যে এই পদক্ষেপ সেটা বলাই যায়!
যেহেতু ঘটনাটি ঘটছে ‘রাজস্থান কে পটভূমিকা মে’ তাই ভূমিকাতে লালমোহন বাবুর সেই নিষ্পাপ প্রশ্নটা মনে পড়ছে – রাজস্থান মে ডাকু হ্যায় ইয়া নেহি হ্যায়!
না হলে এই স্বাস্থ্যের এই অভূতপূর্ব আধিকারিক মান্যতা শুধু যে রাজস্থানেই স্থিত হবে তা তো নয়! বরং স্থানাঙ্ক পরিবর্তন করে অন্যান্য গণস্থানে/গণরাজ্যে পৌঁছে যেতেই পারে!
জটায়ুর চরিত্রাভিনেতা শ্রদ্ধেয় শ্রী সন্তোষ দত্ত ছিলেন একজন স্বনামধন্য আইনজীবীও! তাই রাজস্থান সরকারের এই Right to Health বা স্বাস্থ্যের অধিকার বিল নিয়ে কিছু আইনের আলোচনা করা যেতেই পারে!
ছাত্র রাজনীতির সময় থেকে সকলের জন্য স্বাস্থ্যের দাবীতে গলা ফাটিয়েছি।স্বাস্থ্যের অধিকার মৌলিক অধিকার নয় কেন, এই প্রশ্ন তুলেছি বিভিন্ন মঞ্চে।
সম্প্রতি রাজস্থান সরকার স্বাস্থ্যের অধিকার বিল এনেছেন। কিন্তু চিকিৎসক সমাজ তার বিরোধিতা করছেন!
কেন?
সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা বা Universal Health Care (UHC) তো আমাদেরই দাবী!
তবে?
এক্ষেত্রে আমাদের আপত্তিটা কোথায়?
এককথায় বললে, বলতে হয়, আপত্তিটা গোড়া কেটে আগায় জল দেবার বা কোনো সঠিক প্রস্তুতি বা সরকারী নীতি নির্ধারণ না করেই এই আলগা রাজনৈতিক হাততালি প্রবণতার জন্য!
মনে রাখতে হবে, এই বঙ্গের দুয়ারে ডাক্তার আর রাজস্থান সরকারের এই ঘোষণা সব একটা নিবিড় রাজনৈতিক নিরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়, অংশ! জল মাপা!
চিকিৎসার ব্যাপারে সার্বিক সরকারী ব্যর্থতাকে ঢেকে দেবার মোক্ষম অস্ত্র হলো সমাজটাকে চিকিৎসক আর অচিকিৎসক এই দুই ভাগে ভেঙ্গে ফেলা!
লড়িয়ে দেওয়া!
আজ রাজস্থান যা করেছে, কাল পশ্চিমবঙ্গ, পরশু অসম তারপর উড়িষ্যা, দিল্লী, মহারাষ্ট্র, ত্রিপুরা হিমাচল, কর্ণাটক, উঃ প্রঃ, গোয়া… এটা একটা খেলা!
এদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যয় অপ্রতুল (মাথাপিছু ৫৪ ডলার) যা এমনকি অনেক অনুন্নত দেশের থেকেও কম। ২০২০ সালের হিসেব মত প্রতি ১০ হাজার ভারতীয়ের জন্য হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা আছে মাত্র ৫ টি, পৃথিবীর ১৬৭ টি দেশের মধ্যে এই সংখ্যা ভারতকে লজ্জাজনক ১৫৫ তম স্থানে নিয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২.১ শতাংশ। সরকারী পরিকাঠামোর রোগী-চিকিৎসক সাক্ষাতের গড় সময় ১ মিনিট মাত্র। স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নের জন্য যে উপযুক্ত পরিকাঠামো প্রয়োজন তার অভাবের কথা চিন্তা করে সরকার শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশন গঠন করেন, যা সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা বলে বিবেচিত হয়। শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশনের সুপারিশ সরকার গ্রহন করেন নি। সে রিপোর্টে বলা হয়েছিল ২০২২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ৩ শতাংশ করতে হবে, ব্যক্তিগত খরচ কমিয়ে ৩৫% করতে হবে ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
সে সব কিচ্ছু করা হলো না! কিন্তু জনসাধারণের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো স্বাস্থ্যের অধিকারের অর্ধভুক্ত গাজর!
আজও আমাদের দেশের (এবং প্রদেশের) প্রতিটি প্রান্তে প্রাথমিক এবং আপদকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে থাকেন প্রথাগত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ বিহীন কিছু মানুষ, যাঁদের আমরা ‘হাতুড়ে’ বলে থাকি। এঁদের মধ্যে কিছু প্রশিক্ষণবিহীন স্বশিক্ষিত মানুষ আছেন, যাঁরা সত্যি মানুষের উপকার করেন, বা অন্তত করতে চান, নিজেদের সীমিত বিচার বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
আর আছেন প্রচুর ভন্ড, ঠগ, শঠ, ভেকধারী নকল চিকিৎসক, যাঁরা প্রতিনিয়ত মানুষকে ঠকিয়ে চলেছেন। আছেন, হোমিও,আয়ুর্বেদ, ইউনানী, ম্যাগনেটোথেরাপি বা আয়ুষ চিকিৎসকেরা। তাঁদের সিংহভাগই কিন্তু বেসরকারি। তবে সরকারী ভাবে স্বীকৃত? তাঁরা সুনিশ্চিত করবেন স্বাস্থ্যের অধিকার?
এই একশ চল্লিশ কোটির দেশে প্রতি দেড় হাজার মানুষ পিছু মাত্র একজন চিকিৎসক! তার জন্য কি একজন চিকিৎসক দায়ী?
দেশে চিকিৎসা খাতে বাজেটের যে শতাংশ ব্যয় হয় সেটা আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশগুলির সমকক্ষ। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা মেলায় সরকারী হাসপাতালে রোগী সংখ্যা বেড়ে গেছে চতুর্গুণ। অথচ চিকিৎসক সংখ্যা বাড়ে নি এতটুকুও। ফলে শিকাগোর সেই আট ঘন্টা শ্রমের আইন ভুলে গিয়ে একজন চিকিৎসককে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়, প্রায়শই ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা। কোথাও বা আরো বেশি। এই করতে গিয়ে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গাফিলতির দায়ভার প্রায়শই এসে পড়ে পরিষেবার মুখ সেই চিকিৎসকের ঘাড়েই। অপমানিত,নিগৃহীত হন সেই মানুষটিই। সেই মানুষটিই, যিনি অন্য গ্রহের প্রাণী নন, যিনি আর পাঁচজন পেশাদারের মতো এই সমাজ থেকেই উঠে আসেন। আসেন, আমার আপনার বাড়ি থেকেই। যিনি ছোটো বেলা থেকে মনোযোগী ছাত্র বা ছাত্রী ছিলেন, মেধাবীও। পাড়ায় , ইস্কুলে কলেজে যাঁকে ভালো ছেলে বা মেয়ে বলা হতো, কৈশোর আর যৌবনের প্রায় পুরোটাই যিনি মনোনিবেশ করেছেন বইয়ের পাতায়, জয়েন্ট এন্ট্রান্সের দুর্লঙ্ঘ্য পর্বতারোহণ করে ফের পাড়ি দিয়েছেন অজস্র পার্ট, সেমেস্টারের ঢেউ পেরিয়ে MBBS এর অকূল পাথার, তারপর আবার পোস্ট গ্রাজুয়েশনের যুদ্ধে জয়ী কিংবা পরাজিত হয়ে নেমেছেন জীবন যুদ্ধে!
কেউ কেউ আবার সাধ্যবিত্ত পরিবারের নানা রকম পিছুটান পেরিয়ে শুধুমাত্র মেধার ওপর ভিত্তি করে পাড়ি দিয়েছেন বিলেতে, উচ্চশিক্ষিত হয়েছেন, নিয়েছেন সর্বোচ্চ মানের প্রশিক্ষণ এবং তার পর ফিরে এসেছেন নিজের দেশে, হয় বাধ্য হয়ে, অথবা, আদর্শের টানে।
সেই দেশে, যেখানে, পঞ্চায়েত প্রধান, কাউন্সিলর, এমএল এ, এম পি, প্রাক্তন মন্ত্রী এমনকি প্রাক্তন কয়েদি পর্যন্ত চিকিৎসকদের বা সংস্থা কে হুমকি দিয়ে থাকেন প্রায় জন্মগত অধিকার বশতঃ!
তবে কি যত দোষের ভাগী শুধুমাত্র চিকিৎসকরাই?
এই আইনে সঠিক ভাবেই সাধারণ মানুষের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, চিকিৎসক সুরক্ষিত থাকবেন কিসের ভরসায়?
দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে একজন মানুষ এই সমস্ত জায়গায় যেতে পারেন, যান ও।
১. পুলিশ, ২. সিএমওএইচ, ৩.কমিশন, ৪.উপভোক্তা ফোরাম, ৫. রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল, ৬. স্বাস্থ্য ভবন, ৭.সংবাদমাধ্যম
একজন আক্রান্ত চিকিৎসক কোথায় যাবেন?
করপোরেট হাসপাতাল জনসেবার চেয়ে ধনসেবা যে বেশি করবেন, সেটা জানা কথাই। ওই স্তরের পরিষেবার খাতিরে চিকিৎসা বহুমূল্য হবে এটাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যেটা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না, সেটা অসততা, নীতিহীনতা। সেটা বরদাস্ত করা উচিৎ নয়।
মনে রাখতে হবে, বেসরকারি হাসপাতালের উপার্জনের মাত্র ৬ থেকে ১০ শতাংশ জোটে একজন চিকিৎসকের বরাতে।
কেবলমাত্র একজন চিকিৎসক কেন, কোন হাতুড়ে ডাক্তারও কখনওই চাইবেন না তাঁর চিকিৎসায় কারো ক্ষতি হোক। মৃত্যু তো আদৌ কাম্য হতে পারে না! অধীত বিদ্যায় ভর করে অসুস্থ মানুষটিকে সারিয়ে তোলা ছাড়া একজন চিকিৎসক কি ই বা চাইতে পারেন!
চিকিৎসায় গাফিলতি মাত্রই অনিচ্ছাকৃত, কিন্তু তার জন্য কোন চিকিৎসককে কি খুনের মামলায় অভিযুক্ত করা যায়?
স্বাস্থ্যের অধিকারের আলখাল্লা পরিয়ে কি নন্দ ঘোষ চিকিৎসকের মাথায় বন্দুক ধরা যায়? এই ভাবে কি সত্যিই সুনিশ্চিত হয় স্বাস্থ্যের অধিকার?
একজন অসুস্থ মানুষের যেমন চিকিৎসার অধিকার আছে, একজন ক্ষুধার্ত মানুষের তেমনি খাদ্যের অধিকার আছে! বা একজন প্রতারিত মানুষের বিচারের অধিকার!
তা, এই একই যুক্তি দেখিয়ে একজন নিরন্ন মানুষ কি পাঁচতারা রেস্তোরাঁ বা নিদেনপক্ষে পাড়ার হোটেলে বিনামূল্যে খাবার দাবী করতে পারেন?
অথবা সরকারি চাকরির মেধাতালিকায় নাম থাকা স্বত্বেও শিক্ষিত যোগ্য কোনো তরুণ বা তরুণী বছরের পর বছর হকের চাকরি না পেয়ে প্রতারিত হন, তার জন্য তিনি বিনামূল্যে মামলা এবং বিচারের অধিকার দাবী করতে পারেন তো?
সংকটকাল পেরিয়ে এক মহাশূন্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে সমাজ। যে সমাজের চিকিৎসক প্রয়োজন নেই।
তা তো নয়!
১৯৪৮ সালে জেনেভায় বিশ্ব মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএমএ) এর দ্বিতীয় সাধারণ পরিষদ সভায় গৃহীত হয় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো হিপোক্রাটিক শপথবাক্যগুলির একটি আধুনিক এবং সংহত রূপ। সারা পৃথিবী জুড়ে চিকিৎসকরা যে তেরোটি শপথগুলিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকেন।
শিকাগোতে ১৪ ই অক্টোবর ২০১৭ তারিখে বিশ্ব মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএমএ) সাধারণ পরিষ্দে জেনেভা ঘোষণার নতুন সংশোধিত সংস্করণটি গৃহীত হয়েছে। এবং সত্তর বছর পর এই প্রথম তাতে সংযোজিত হয়েছে একটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ শপথ বাক্য–
· I WILL SHARE my medical knowledge for the benefit of the patient and the advancement of healthcare;
· I WILL NOT USE my medical knowledge to violate human rights and civil liberties, even under threat;
এই দুটি মাঝখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই কথাগুলি
· I WILL ATTEND TO my own health, well-being, and abilities in order to provide care of the highest standard;
নতুন কথা তো নয়, সেই চেনা কথা ” Physician, heal thyself ”
নিজের যত্ন নাও, ডাক্তার, নিজে সুস্থ থাকো,নিরাপদ থাকো, সুরক্ষিত থাকো।
তা এই যদি বিশ্ব-সংস্থার শপথ বাক্য হয়, তবে তো সমাজের দায়িত্ব চিকিৎসককে সুরক্ষা দেওয়া , সুস্থ কাজের পরিবেশ দেওয়া, যাতে একজন চিকিৎসক অন্ততঃ নিরাপদে মানুষের চিকিৎসা করতে পারেন!
এতো গেলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা। আমাদের দেশের সংবিধান কি বলছে ?
বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সংখ্যা ৬টি।
তার তৃতীয়টি হলো ৩. শোষণের বিরুদ্ধে অধিকারঃ (২৩-২৪ নং ধারা):
সেখানে পরিষ্কার লেখা আছে :
❐ কোন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করানো যাবে না।
❐ বিনা পারিশ্রমিকে কাউকে বেগার খাটানো যাবে না।
একজন চিকিৎসকও কিন্তু মানুষ এবং এই দেশেরই নাগরিক! তাই এই মৌলিক অধিকার তাঁরও প্রাপ্য ।
মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার ও চিকিৎসকের সুরক্ষার অধিকার কিন্তু কখনোই একে অপরের পরিপন্থী নয়!
আমরা যেন ভুলে না যাই মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করার প্রাথমিক শর্তই কিন্তু চিকিৎসকের সুরক্ষা!
1. https://pib.gov.in/PressReleasePage.aspx?PRID=1894902#:~:text=Overall%2C%20for%20FY19%2C%20Total%20Health,4%2C470%20per%20capita).
2. https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87_%E0%A6%AE%E0%A7%8C%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%95_%E0%A6%85%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0
3. https://www.wma.net/policies-post/wma-declaration-of-geneva/#:~:text=I%20WILL%20NOT%20USE%20my,freely%2C%20and%20upon%20my%20honour.
https://www.facebook.com/1232299418/posts/pfbid0H9bqHbE8TFrTS42V45n2c7bMVHqkwNN9s9v3a1WvQVA5FXhj4GRj2tLHv6RkshB5l/?d=w&mibextid=uc01c0