তপ্পন বৈদ্যকে মনে আছে? সেই মানদাসুন্দরীর চুল্লুর ঠেকের নিত্য খরিদ্দার? করোনায় মানদা তার ঝুপড়ি বন্ধ করে’ চলে গেছে কোন দেশে। ডাক্তারও নেশা ছেড়ে এসেছে দেশের বাড়ি। তপ্পন বদ্যির দেশের বাড়ির সামনে দে’ গেছে গঙ্গা। মাটি বোঝাই ডুবুডুবু নৌকো, খড় বোঝাই ফুরফুরাইল নৌকো, যাত্রীহীনা হতাশমুখো ভটভটি সবই বয়ে’ যায়। সান্ডেল চরে দু’টো কুমির রোদ পোহায় তাই ঘাট জনশূন্য। কেবল দুচারজন জোলো বালক বালিকা জল ছিটিয়ে আঘাটা তোলপাড় করে। এই গঙ্গা উথাল পাথাল করা নির্মেদ মানুষদের দেখে তপ্পনের স্মৃতিও তোলপাড় হয়।
বাঙালি প্রচুর জানে, প্রচুর বোঝে, তাই এরকম একজন আইভুরু করা, ছেলেছাঁটের চুল, পৃথুলা মহিলার কথা মনে পড়ে যায়। ফোনে তিনি জানালেন তাঁর অ্যালার্জি হয়েছে। অবশ্যই ওনার রোগ নির্ণয় নিশ্চিত। কেননা উনি বাঙালি। কিছুদিন পরেই তিনি এলেন। মুখ ভর্তি হার্পিস জস্টার। নাম বলার পরে ওনার বিষ্ময়সূচক উক্তি “সেটা আবার কি?”
তপ্পন বলেন “চিকেন পক্সের ছোটো ভাই”
উপপাদ্য প্রমাণিত :-বাঙালি হার্পিস জস্টার জানে না।
এক এক করে’ জলপাগল মানুষ ঘাট ছেড়ে চলে যায়। দিদির চায়ের দোকানে দিদি আর দিদির নাতি বসে ভাত খায়। কয়েকটা লেজনাড়া, পাঁজরাসম্বল কুকুর সামনে বসে’ থাকে। ঘাটপারের ভাতের দোকান থেকে বদ্যিবুড়োর ভাত, ডিমের ঝোল আর কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে যায়। সদ্যবিধবা বৌটি। স্বামীর মৃত্যুর পরে মেয়েটা এসে শক্ত হাতে দোকানের হাল ধরেছে। করোনার পরে, ঘাটে লোক নেই, শূন্য খেয়া, পুণ্য স্নানেও লোকের ভয়। তবু দুটো বাচ্চা নিয়ে শুকনো চোখে সে দোকান চালায়। কন্ঠা বেরিয়ে আসে, চোয়াল শক্ত হয়, কোমল গালের হনু উঠে আসে। তার মানুষটাকেও করোনা নিয়েছে।
হ্যাঁ, তাকে করোনা পরীক্ষার কথা বলা হয়েছিলো, লেখাও হয়েছিলো।”দ্ধুর ডাক্তার অমন কতো বলে, র্যাখ তো দিনি ওসব, দুদিন সাগু, বার্লি খ্যালেই ঠিক হবে নে”
পরীক্ষা করানো হয় নি, কারণটা বাঙালির সেই তীব্র স্বাস্থ্য সচেতনতা আর চিকিৎসকে ভরসা না থাকা। যখন শ্বাসকষ্ট অনুভব করলো সেই সা’ জোয়ান মানুষটা, তখন তার প্রাণবায়ু গঙ্গা বাতাসে বয়ে’ গেছে।
অনুলোম, বিলোম করা বাঙালি রামদেববাবুর শুগারের ওষুধ খায়- অথচ জানেনা মহান হঠযোগীর ফেসিয়াল নার্ভের প্যারালাইসিস আছে। শেষে আটশো পিপি শুগার নিয়ে আবার তপ্পনের কাছে ফিরে আসে।
ক্যামেরা (মোবাইল) জুম করে। নদীর পারঘাটার ভাঙা চরে একটা ফ্লুরোসেন্ট সবুজ গেঞ্জি পরা বালিকা ফিল্মি কায়দায় জল ছিটিয়ে, আস্তে আস্তে করে পাড় দিয়ে উঠতে থাকে। ক্যামেরা হাতে কিশোরী দিদি, ক্যামেরায় চোখ রেখে পিছোতে পিছোতে পা পিছলে কুমড়োগড়ান। মোবাইল কিন্তু হাত ছাড়া করে নি। সব সমেত গঙ্গাজ্জলে স্নান। তপ্পন নারকেল তেল মাখতে মাখতে হেসেই খুন। যদিও ঘটনাটা পরম শোকাবহ।
এটা যেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কুমড়োপটাশ গল্প। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়িয়ে গড়িয়ে নদীতে ডুবে গেছে। গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে।অথবা সলিলসমাধিও বলা যায়।
শুরু হয়েছিলো এক গজাখিচুড়ি ধর্মনিরপেক্ষ (ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের আবার ধর্মনিরপেক্ষতা!),পুঁজিবাদী সমাজতন্ত্র দিয়ে।সঙ্গে ছিলো ব্রিটিশদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, রাশিয়ার সমাজতন্ত্র আর আমেরিকার গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি।
পৌঁছনো গেলো সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবীতে। এখন?
উঠে যাচ্ছে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা। আসছে ব্যবসায়ী কর্পোরেট হৌস তার বেতনভুক ডাক্তার কর্মচারীরা। কি সরকারি,কি বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যের মৌলিক চাহিদা কেউ পূরণ করছে না।
(১) প্রয়োজনে বাড়ি থেকে আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স। সঙ্গে ভেন্টিলেটর এবং ভেন্টিলেটর চালানোর উপযুক্ত কর্মী।
(২) ইমার্জেন্সির প্রত্যেক খারাপ রোগীর জন্য প্রাথমিক ভেন্টিলেটর, আলাদা আইসিইউ এবং সেই অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর্মী।
(৩) সব সময়ের জন্য সব বিষয়ের যথেষ্ট সংখ্যক বিশেষজ্ঞ, যারা প্রয়োজনীয় এবং যথেষ্ট বিশ্রাম পাবে।টানা আটচল্লিশ ঘন্টা কাজ করা ডাক্তারের ভুল (অবহেলা নয়, তফাৎ আছে) হওয়া স্বাভাবিক।[এবং এটা সব হাসপাতালের জন্য প্রযোজ্য]
(৪) বহু বহু ইন্টেন্সিভ করোনারি কেয়ারে ক্যাথ ল্যাব (অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টির) ব্যবস্থা নেই। পাশ করা স্বাস্থ্য কর্মী নেই।
এই সব না থাকার ঘাটতি ঢাকতেই কারণে অকারণে ডাক্তারকে অপরাধী বানানো হয়।
যাতে আপনি ভাবেন, চিকিৎসা মানে শুধুমাত্র ডাক্তার আর অবশ্যম্ভাবী ভাবেই মৃত্যু মানেই ঐ ব্যক্তি ডাক্তারের ভুল। যাতে আপনি জানতে না পারেন ঘাটতিটা কোথায়!
হ্যাঁ, হ্যাঁ ডাক্তাররা সব ধোয়া তুলসীপত্র। এদের কোনও দোষ নেই। কিছু ডাক্তার অবশ্যই অকারণে প্রচুর টেস্ট করতে দেয়।হয়তো ক্রেতা সুরক্ষা এর জন্য, “কিছুটা”হলেও, দায়ী।
আন্দাজে ভুল রিপোর্ট করে। গতকাল ভালো জায়গা থেকে করানো পরীক্ষা আজকে আবার করতে দেয় (দুটোই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা)। অনেকেই পছন্দের ল্যাবরেটরি বা নিজের ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করতে দেয়। নিশ্চয়ই স্বর্গীয় তূরীয়ানন্দ পাওয়ার জন্য নয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, পড়ে রইলো গুটিকতক ডাক্তার আর তাদের জেদ। কিন্তু তাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফাঁক ফোকর গুলোকেই ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। লাভ কি কিছু হয়?
পৃথিবীটা যেন ছোটো হতে হতে বোকা বাক্সতে বন্দী।
টিভি আর মোবাইলের আশ্চর্য জগতে ঢুকে আসলে আমি কী, আর আমার কী চাই, সেটা জানার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। তবে আসল দরকার মানুষের সচেতনতা। এইটুকু জানা, আমার কতোটুকু অধিকার আর বিনিময়ে কতোটুকুই বা পাচ্ছি। এতো বড়ো একটা হাসপাতালে কি একজন রোগীর মৃত্যুর জন্য একজন মাত্র ডাক্তার দায়ী? তাহলে এ্যাতো টাকা কেন নিচ্ছে?এ্যাতো কর্মচারী এ্যাতো বিল কেন?
এ্যাতো এ্যাতো মেডিক্যাল কলেজ খুলছে, আছে তো তাদের যথেষ্ট স্পেশালিস্ট? আছে তো ক্যাথ ল্যাব? আছে কি সব ওষুধ?
ডাক্তাররা, নার্সরা, কর্মীরা,কেবল মাত্র হাসপাতালে পড়ে থাকার জন্য, যথেষ্ট টাকা পায় কি?অবশ্যই, সক্কলে টাকার জন্য, পোড়া পেটের জন্য কাজ করে। টাকা না থাকলে, খেতে না পেলে, সন্তানের জন্য, অসুস্থ মা বাবার জন্য এরা হয়তো একদিন ডাকাতি করবে, অথবা সুযোগ পেলে….
ফেসবুকে দেখছি, কিডনি খারাপ, পরিবার সর্বস্বান্ত, বাবার ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য বিএসসি পাঠরতা কন্যা আকুল ভিক্ষা চাইছে….জনগণের কাছে…..বাবু আমি গরীব মানুষ, বন্যায় ভেসে গেছে ঘর, প্যাটে ভাত নেই, দুটো ফ্যানাভাত দেবা? বাবু ছোটবাচ্চাটা দুই দিন খাতি পায় নি, যদি কিছু…..সাহায্য আর ভিক্ষা.. সেই বাল্য থেকে এদের লাইন দেখেছি….অনটনে আর মন্বন্তরে। এখনও কেউ জানলো না এই গণতান্ত্রিক দেশে তার কতোটুকু অধিকার।
ঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে। এক বুড়ি, ভাঙা কালীমন্দিরের বন্ধ কোলাপ্সিবল দরজায় মাথা ঠুকছে। করোনায় তার সন্তান, স্বামী ভেসে গেছে। ভেসে গেছে আদরের নৌকো। পড়ে থাকে ভাঙা দেউলে সর্বহারা বৃদ্ধা।