দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ২৮
রতন সমাদ্দার আর সৌমেন্দু মহলানবিসের মধ্যে এমনিতে কোনো মিল নেই। রতন ক্লাস টেন ফেল, সৌমেন্দু মাস্টার্স করেছে ইনফর্মেশন টেকনোলজিতে। রতনের বেড়ে ওঠা আনন্দ কলোনির বস্তিতে বিধবা মায়ের কাছে আর সৌমেন্দুর বাবা মা দুজনেই মাস্টার, বৈভব না থাকলেও, অভাব সে কোনোদিন দেখেনি । রতন ক্রেডিট ডেবিট কার্ডের ঠগবাজিতে ওস্তাদ জালিয়াত আর সৌমেন্দু খুব অল্প বয়েস থেকেই কোডিং আর প্রোগ্রামিংয়ের ইয়ং অ্যাচিভার, কয়েকবছর আগেই গুগলের একটা ‘বাগ’ আবিষ্কার করে সে খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছিলো। দুজনেরই বয়েস পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে,
এটা ছাড়া আর কোনো সাযুজ্য নেই, দুজনের কস্মিনকালেও দেখা হওয়ার কথা নয়, তবু ডিজিটাল দুনিয়ায় কী না হতে পারে। রতন আর সৌমেন্দুর নাম যে এরকম একসাথে জড়িয়ে যাবে, ওরাও কি কোনোদিন ভেবেছিলো!
রতনের কথা
ক্রেডিট কার্ডের ভারতের জালিয়াতরা মোটামুটি একই পন্থা অবলম্বন করে। ডার্ক ওয়েবে তারা রাশিয়ান হ্যাকারদের থেকে কার্ডের সব তথ্য কেনে, তারপর সুযোগ বুঝে ইন্টারনেটে রেইকি করে ঠিক করে কখন তার মালিক অসতর্ক। মাঝরাতে সাফ হয়ে যায় কার্ডের ভাঁড়ার, তবে সরাসরি টাকা ট্রান্সফার করে না প্রায় কেউই।
সেই টাকা দিয়ে কোনো দামী জিনিস কিনে নেয়, তারপর সেই জিনিসটি বেচে দেয় কমদামে অন্য কোনো আই পি অ্যাড্রেস দিয়ে। এভাবে করলে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট প্রায় থাকেই না, সুতরাং ধরাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মধ্যে এতে বাধ সেধেছিলো গ্রাহকের মোবাইলে ও টি পি আসার বাধ্যবাধকতা, কিন্তু এখন সেই সব ক্লোনিং করা সহজ, তথ্যগুলো কিনতেও পাওয়া যায়।
উপভোক্তারাও নানান ভাবে ফোনে বা এস এম এসে সাড়া দিয়ে কাজ সহজ করে দেন, সে যতই ব্যাঙ্ক থেকে কাউকে বলতে নিষেধ করুক।
রতন এই জালিয়াতদের থেকে আরেককাঠি এগিয়ে। স্রেফ রাশিয়ান হ্যাকারদের ওপর নির্ভর না করে, কিভাবে ব্যাঙ্কের ফায়ারওয়ালে জল ঢালতে হয়, সেইদিকে হাত পাকিয়েছে সে। এইসব শেখানোর অনলাইন সাইটের অভাব নেই ডার্ক ওয়েবে,
অদ্ভুতভাবে রতনের মাথা খোলে এই হ্যাকিংয়ে, যা শেখে সেটা সে ভোলে না, একটার সাথে আরেকটা সূত্র জুড়ে ক্রমশ সে ধরে ফেললো বিশ্বের প্রায় সবকটা ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি অ্যালগরিদম।
প্রায় বলছি, কারণ বহু ব্যাঙ্কে সে হ্যাকিংয়ের চেষ্টা করেনি বলে, নয়তো যে কটা চেনাজানা ব্যাঙ্ক আছে, তাদের ভেতরে ঢোকার চাবিকাঠি রতন সমাদ্দারের হাতের মুঠোয়।
কিন্তু হ্যাকিং একটা নেশার মতো, ওই যারা সুদোকু না করে থাকতে পারে না, তাদের যেমন রোজ মগজ সুড়সুড় করে, সেরকম। রতন হাত পাকালো এইবার মোবাইল হ্যাকিংয়ে। ব্যাঙ্ক যে হ্যাক করে, মোবাইল তার কাছে ছেলেখেলা, এমন যারা ভাবে তারা বোকা। মোবাইলের নিজস্ব সিকিউরিটি, অ্যান্টিভাইরাল অ্যাপের নজরদারি, নেটওয়ার্কের চোখরাঙানি, গুগলের সতর্কতা এতগুলো ধাপ পেরোতে হয়, তার সাথে ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি তো আছেই। তবে কম্পিউটারের ভাষা যে জানে, তাকে এইসব দিয়ে আটকানো সম্ভব নয়, সে কথা বহুবার প্রমাণিত। রতন সেই ক্ষণজন্মাদের একজন, যারা মাতৃভাষার থেকে পাইথন আর সি প্লাস প্লাসে বেশি সড়গড়। কাজেই, এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ডিজিটাল তস্কর।
তবে এই হ্যাকিং করতে গিয়ে রতন এক বিচিত্র জগতের মুখোমুখি হয়েছে। ও দেখেছে, কত লোকের কি অসম্ভব বিপুল পরিমাণ টাকা নানা খাতে জমানো আছে এবং কত অদ্ভুত উপায়ে লোকে সেগুলো বেনামে রাখতে চেষ্টা করে। মুশকিল হলো, কোথাও না কোথাও টাকার মালিক তার সিন্দুকে উঁকি মারবেই, আর যে যতই লুকাক, আই পি অ্যাড্রেস মিলিয়ে খুঁজলে তার কাছে পোঁছানো ডিজিটাল ওস্তাদদের কাছে জলবৎ সহজ। তবুও কেন ব্ল্যাকমানি ধরা পড়ে না, কারণটা রতন জানলেও, পাঠকদের এই শর্মা ভয়ে জানাচ্ছে না।
এরই সাথে উল্টোদিকের জগৎটাও চিনেছে রতন। কত লোকের মাসের মাইনে চলে যায় ক্রেডিট কার্ডের ঋণ শোধে,
কত লোক সুদের চক্কোরে পড়ে যা ধার নেয় কার দ্বিগুণ পয়সা শোধ করে, তা রোজ দেখতে পায় রতন। ওর বাবা শিবেন সমাদ্দার সেই কুখ্যাত রামকৃষ্ণ কোম্পানির এজেন্ট ছিলেন, সব ধসে পড়ার পর বাড়িতে গ্রাহকদের হামলা মনে আছে রতনের। ভোররাতে বাবার ঝুলন্ত শরীরটা ওই তো আবিষ্কার করেছিলো!
রতন চোর বটে, তবে ওর পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম। সরাসরি অ্যাকাউন্ট বা কার্ড হ্যাক করে টাকা বের করে নিয়ে তার বেশ কিছুটা দিয়ে ও সম্পূর্ণ অচেনা লোকের ধার শোধ করে দেয়। কোত্থাও ওর ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট না থাকায়, দুপক্ষই হতভম্ব হয়ে যায়। বলা যেতে পারে রতন এক ডিজিটাল রবিনহুড। অদ্ভুত কৃতিত্বে, কোনোদিন পুলিশ ওকে ছোঁয়া দূরে থাকুক, ওর অস্তিত্বই টের পায়নি।
সৌমেন্দুর কথা
সৌমেন্দু মহলানবিস আইটি সেক্টরে এক অতি পরিচিত নাম।ওর মেধাকে হিংসে করে না, এমন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ বিরল, ওর সাফল্য পরবর্তী ডিজিটাল প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। পনেরো বছর বয়েসে গুগলের বাগ বের করা বিস্ময়বালক আজ আঠাশে মরটন অ্যান্টিভাইরাস কোম্পানির সর্বভারতীয় কর্তা। অন্তত গোটা তিরিশ পেটেন্ট আছে ওর নামে, ভারতের প্রায় সমস্ত ব্যাঙ্কের ডিজিটাল সিকিউরিটির বিশেষজ্ঞ হিসেবে ওর জায়গা আছে।
ওই অদ্ভুত চুরিগুলো স্বভাবতই ব্যাঙ্কগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে।
সৌমেন্দুর কাছে এই মুহুর্তে কম্পিউটার স্ক্রিনে গত একবছরের ক্লায়েন্টদের চুরি যাওয়ার লিস্ট। ভীষণ খেয়াল করলে ওর মধ্যে একটা প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে। চোর স্বাভাবিকভাবে টারগেট করেছে উচ্চবিত্তদের, কিন্তু অদ্ভুতভাবে বেশির ভাগ অ্যাকাউন্ট ‘পিগিব্যাক’, মানে যার নামে খোলা, পয়সাটা তার নয়। সাধারণভাবে এটা কারোর চোখে না পড়ার কথা, কিন্তু সৌমেন্দুর ধুরন্দর কম্পিউটারজ্ঞান এবং অ্যাকাউন্টগুলোর আরো ভেতর অবধি তল্লাসির অধিকার এই তথ্যটা জলের মতো স্পষ্ট করে দিয়েছে তার কাছে। অ্যাকাউন্টে যার নাম, খোঁজ নিতে নিতে দেখা যাচ্ছে সে সামান্য কর্মচারী, দারোয়ান, ড্রাইভার বা মালি, যার কাছে অত লক্ষ বা কোটি থাকার কথাই না। বেশির ভাগ অ্যাকাউন্টের ট্রান্সঅ্যাকশনও বেশ রহস্যময়, এককালীন দশ বা কুড়ি লক্ষ টাকা জমা কোনো ব্যাপারই নয় আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই কে সেটা জমা দিলো সেটা ধোঁয়াশা। সৌমেন্দু পরিষ্কার বুঝতে পারছে, কেউ বা কোনো দল ধরে ফেলছে এই অ্যাকাউন্টগুলো ব্ল্যাক মানি স্ট্যাশিংয়ের, এবং এখান থেকে সরালে থানা পুলিশের সম্ভাবনা কম। ব্যাঙ্কগুলো তাই সৌমেন্দুকে ডিজিটাল ডিটেকটিভের দায়িত্ব দিয়েছে, মহামান্য ক্লায়েন্টরা তাঁদের কনফিডেন্সিয়ালিটি বজায় রাখতে চান।
নেহাতই খেয়ালের বশে সৌমেন্দু ওই চুরিগুলোর কাছাকাছি তারিখে জমার হিসেব চেক করতে থাকে । একটু বাদেই সে সোজা হয়ে উঠে বসে। প্রতিটা চুরির ঠিক পরের সপ্তাহে বেশ কিছু লোকের ধার দুম করে শোধ হয়ে গেছে, অথচ সেই ঋণগ্রস্তদের অ্যাকাউন্টে তার আগের মুহূর্ত অবধি ট্রান্সঅ্যাকশনের কোনো আভাস নেই। যেন হঠাৎ করে অ্যাকাউন্টে কোনো লটারির টাকা ঢুকে পড়েছে, এবং সেই প্রদীপের জ্বিন দায়িত্ব নিয়ে তাদের ধার চুকিয়ে দিয়েছে।
সৌমেন্দু খেয়াল করলো, যার ঠিক যতটা ধার, ততটুকু টাকাই জমা পড়েছে এবং সটান চালান হয়ে গেছে শোধ দিতে। সৌমেন্দু ব্যাঙ্ক মারফত খোঁজ করে দেখলো, এদের কেউই বিন্দুবিসর্গও জানতো না এই ঋণশোধের সম্পর্কে। এদের মধ্যে কোনো চেনা জানা নেই, এক ব্যাঙ্ক নয়, বয়েস বা লিঙ্গের প্যাটার্ন নেই, শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া। সকলেরই ঋণভার রোজগারের সাধ্যাতীত ছিলো ।
সৌমেন্দু বুঝতে পারে, কে বা কারা ডিজিটাল মানির জগতে এমনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন সেটা পাড়ার পার্ক। প্রতিটি অ্যাকাউন্ট তারা ইচ্ছেমতো ছুঁচ্ছে, ঘাঁটছে, এদিক থেকে খাবলাচ্ছে ওদিকে ছড়াচ্ছে, এই পুরো ব্যাপারটাতে ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি সফ্টওয়্যার সিনেমার পুলিশের মতোই দর্শক। কোথায় যাচ্ছে টাকাগুলো সেই পথ ধরে এগোতে এগোতে একটা জায়গায় গিয়ে সৌমেন্দুকে থামতে হচ্ছে। ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট তারপরে ঝাপসা।
সৌমেন্দুর ইদানিংকার সখ ক্রিপ্টোকারেন্সি। এই ব্যাপারটা অদ্ভুত আকর্ষণীয় লাগে ওর । সাধারণ ব্যাঙ্কের সমস্ত টাকার একটা বাস্তবিক কাগুজে উপস্থিতি থাকে, যাকে ফিকাট মানি বলে। এর মানে, আজ যদি কোনো ব্যাঙ্কের সব গ্রাহক লাইন দিয়ে দাঁড়ায় তাদের সমস্ত টাকা তুলে নেওয়ার জন্য, সেই টাকা দেওয়ার মতো নোট ব্যাঙ্কের কাছে থাকার কথা। কিন্তু ঋণখেলাপী অতি ধনী এবং ডিজিটালাইজেশনের চক্কোরে প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই এখন সেটা নেই, সুতরাং সেরকম চাপ পড়লে জমানো টাকা সহ ব্যাঙ্ক লাটে উঠতে পারে। সৌমেন্দু এই বিপদটা খুব কাছ থেকে চেনে। কোডিংয়ের অবিশ্বাস্য দক্ষতায় সৌমেন্দুর ব্লকচেন শিখতে সময় লাগে নি, পি টু পি কনসেপ্টটা আয়ত্ত্ব করতে ওর মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় লেগেছিলো। এখন ও নিজস্ব একটা ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি করেছে, নাম সোমকয়েন। ইদানিং এই চোরের উপদ্রবে সৌমেন্দু আরো সতর্ক, সোমকয়েনে প্রায় সমস্ত সঞ্চয় কনভার্ট করে নিয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট মোছা অসম্ভব, তাই এই টাকা নিরাপদ।
হঠাৎই বিদ্যুতের মতো ধারণাটা খেলে গেলো সৌমেন্দুর মগজে। ওই চোরের দলও পয়সাটাকে এখানেই সরিয়ে রাখছে না তো!
ব্রেকিং নিউজ!
সমস্ত ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলোতে একটা রহস্যময় ইমেইল এসেছে ঠিক রাত বারোটায়। ভারতের যে কোনো ব্যাঙ্কের সমস্ত টাকা চুরি করে নেওয়ার হুমকি দিয়ে তাতে পরিষ্কার লেখা আছে, ব্যাঙ্ক পিছু এক মিলিয়ন ডলার তার ক্রিপ্টোকারেন্সিতে চাই। ট্রান্সফারের জন্য কিউ আর কোড দেওয়া আছে। নানান সূত্র ধরে সাইবার ক্রাইম সেল বের করেছেন, চিঠিটা উত্তর কোরিয়ার আই পি অ্যাড্রেস। আর বি আই য়ের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ব্যাপারটাকে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করলেও, এক্ষুণি ভয়ের কোনো কারণ নেই। নাগরিকের গচ্ছিত ধন নিরাপদ আছে।
সৌমেন্দুকে জরুরি তলব করেছেন হোম মিনিস্ট্রি।সিকিউরিটির ব্যাপারে ওর থেকে খোলতাই মগজ এদেশে আর নেই. ডিজিটাল রবিনহুডের ব্যাপারটা ওই তো ধরেছে, ওর নির্দেশমতো ফায়ারওয়াল মেরামতির পরে বেশ কিছু মাস ভি আই পিদের কালো টাকা কেউ হাওয়া করেনি, যদিও চেষ্টা যে হয়েছে তার প্রমাণ সৌমেন্দু প্রত্যেক বোর্ডকে দিয়েছে। উত্তর কোরিয়াটা যে একটা বিভ্রম, সেটা বের করতে সৌমেন্দুর আধঘন্টাও লাগেনি, ইমেলটা করা হয়েছে ভারতের ভেতর থেকে। ওতেই একটা লাইন ছিলো, Any attempt of identify the sender is in vain. এই লাইনটা সৌমেন্দুকে ভাবাচ্ছে। Attempt to না লিখে এভাবে ভুল ইংরাজি দুটো জিনিস প্রমাণ করছে। এক, প্রেরকের মাতৃভাষা ইংরাজি নয়। দুই, সে তেমন শিক্ষিত নয়, অন্তত প্রথাগত শিক্ষায়। কাজেই ব্যাপারটা Hoax বলে ধরে নেওয়াই উচিৎ। তবুও জুম মিটিংয়ে সৌমেন্দু একটা প্রস্তাব রাখলো। ওর বানানো একটা সিকিউরিটি সফ্টওয়্যার আছে, যা কোথাও কখনো ব্যবহার হয়নি এখন অবধি। নানান এথিক্যাল আর আনএথিক্যাল হ্যাকারদের দিয়ে টেস্ট করিয়ে সৌমেন্দু জানে, একে পেরোনোর ক্ষমতা এখনো কারোর নেই। চওড়া লাভে বেচবে ভেবেছিলো সেই প্রোগ্রামটা, আজ দেশের প্রয়োজনে ‘সোমসিক্যুরিটি’ ও বিনা পয়সায় ইনস্টল করতে রাজি। প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ার কোনো কারণ নেই, ‘ফ্রী’ কোনো কিছু ভারতীয়রা ছেড়েছেই বা কবে।
এসবের থেকে অনেক দূরে, রতন সমাদ্দার তার নতুন নেশা ক্রিপ্টোকারেন্সির ওপর থেকে ব্যস্ত মগজ সরিয়ে টুক করে জুম মিটিংয়ের সব কিছু দেখে নিলো এক বড়কর্তার ল্যাপটপ থেকে।
সৌমেন্দু জানতেও পারলো না, বাঘের ঘরেই একজন ঘোঘ হয়ে ওকে মাত দেওয়ার ছক কষছে। এতদিনে রতন একটা মনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছে।
ব্রেকিং নিউজ!
আবার ইমেল। এবার ব্যাঙ্কের সাথে প্রতিটা বিশিষ্ট খবরের কাগজের কাছে। ভারত সরকারকে রীতিমতো তাচ্ছিল্য করে বলা হয়েছে যে আগামী দুদিনের মধ্যেই একটা ব্যাঙ্ক ফাঁকা করে দেবে প্রেরক। এইবারে তার নাম লেখা আছে, ‘রবিনহুড’। সরাসরি সৌমেন্দু মহলানবিসকে সে চ্যালেঞ্জ করেছে, পারলে আটকে দেখাক। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ সবাইকে নিশ্চিন্তে থাকতে বলেছেন, কিন্তু এইবারে জনতার উদ্বেগ প্রশমিত হচ্ছে না। প্রতিটা ব্যাঙ্কের শাখার সামনে টাকা তোলার লম্বা লাইন। বহু শাখাতে নগদের অভাব, অনেক জায়গাতে ঝামেলা সামলাতে পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছে। স্বয়ং সৌমেন্দু মহলানবিস বলেছেন, ‘চ্যালেঞ্জ আ্যাক্সেপ্টেড’। সারা বিশ্বের সাইবার ক্রাইম শাখা রবিনহুডকে খুঁজছে। আই পি অ্যাড্রেস অনুযায়ী, এইবার তার ঠিকানা ফিজি আইল্যান্ডস।
চব্বিশ ঘন্টা পরে
সমস্ত ব্যাঙ্কে নিজস্ব ফায়ারওয়াল ছাড়াও সোমসিকিউরিটি অ্যাকটিভ। অর্থমন্ত্রকের নির্দেশ অনুযায়ী আজ কোনো ট্রান্সঅ্যাকশন হবে না। সব ব্যাঙ্কের সমস্ত কর্মীকে সামনের চব্বিশ ঘন্টা ডিউটিতে থাকতে নির্দেশ এসেছে। ইউনিয়নগুলো তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েও দেশের স্বার্থে মেনে নিয়েছেন। আর বি আইয়ের বড়কর্তারা ঘন ঘন মিটিংয়ে। সৌমেন্দু মহলানবিস সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করে ফোনেই জানিয়েছেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। এটা হোক্স ছাড়া আর কিছু নয়। বরং গত কয়েক মাসে ডিজিটাল চুরি প্রায় হযনি। এবারও হবে না। সারা দেশ সতর্ক হয়ে দিন গুনছে।
আটচল্লিশ ঘন্টা পরে
বছরের সেরা ব্রেকিং নিউজ! সব সতর্কতা পেরিয়ে বেঙ্গল ব্যাঙ্কের সব টাকা হাওয়া হয়ে গেছে। মাথায় হাত আটচল্লিশ হাজার গ্রাহকের। ইমেইলে আবার রবিনহুড জানিয়েছে, দাবি না মিটলে এবার লক্ষ্য হবে স্টেট ব্যাঙ্ক। সৌমেন্দুর মোবাইল সুইচড অফ সাংবাদিকদের জন্য। ব্যক্তিগত মোবাইলে হোম মিনিস্ট্রি খটখটে সংলাপে তাদের অসন্তোষ গোপন রাখেননি। সৌমেন্দু জানিয়েছে, সে চেষ্টা করছে। কিন্তু আপাতত রবিনহুডের দাবী মেনে নেওয়াই ভালো। আটচল্লিশটা ব্যাঙ্ক ধরে আটচল্লিশ মিলিয়ন ডলার। হোম মিনিস্ট্রি সৌমেন্দুকেই এর ভার দিয়েছেন, ভবিষ্যতে ক্লু ধরে রবিনহুডকে ধরার আশায় । বিশ্বের বাজারে ভারতীয় রুপির ডলারের তুলনায় অনেকটা পতন হয়েছে।
রবিনহুড
মন ভালো নেই সৌমেন্দুর। রবিনহুড তাকে হারিয়ে দিয়েছে। আর বি আই আটচল্লিশ মিলিয়ন ডলার ক্রিপ্টোকারেন্সিতে দিয়েছেন ওরই হাত দিয়ে। এর থেকে বেশি চুনকালি আর কি লাগবে গায়ে!
কটা দিন দেশের বাইরে এসেছে সৌমেন্দু। ভানুআটু আইল্যান্ড। এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে কিছুদিন থাকবে সে। কিছুদিন কেন, সারাজীবন। আজ ওর কাছে আটচল্লিশ মিলিয়ন ডলার, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিটকয়েন থেকে সোমকয়েন করতে সময় লাগেনি ওর। এই ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট লুকানো যাবে না, তাই আপাতত ওর প্ল্যান ভানুআটুর নাগরিকত্ব। এই দেশের সাথে ভারতের প্রত্যার্পণ চুক্তি নেই। নিজেকে মৃদু পিঠ চাপড়ে সৌমেন্দু ওর ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেটটা ল্যাপটপে লাগালো। চুরির ভয়ে ও সোমকয়েনগুলো হার্ডড্রাইভে রাখে।
এ কি! অ্যাকাউন্ট যে শূন্য! একটি ডলার বা সোমকয়েন নেই ওর অ্যাকাউন্টৈ। কি ভাবে! ওর পাসওয়ার্ড আর কেউ জানে না, এর আগে শুধু একবার হার্ডড্রাইভটা লাগিয়েছিলো সে কয়েন ট্রান্সফারের জন্য। ওইটুকু সময়ে কে চুরি করবে!
একটা ইমেইল ঢুকলো সৌমেন্দুর। একটা লাইন লেখা। ‘ There is a difference between a thief and Robinhood’.
ব্রেকিং নিউজ!
রহস্যজনক ভাবে বেঙ্গল ব্যাঙ্কের সমস্ত অর্থ ফিরে এসেছে। আর বি আই ফেরত পেয়েছেন তার আটচল্লিশ মিলিয়ন ডলার। বিশিষ্ট ব্যাঙ্ক নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সৌমেন্দু মহলানবিসের বিরুদ্ধে প্রচুর তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সরকারি প্রচেষ্টা চলছে তাঁকে ভানুআটু থেকে নিয়ে আসার।
খবর দেখে মুচকি হাসলো রতন সমাদ্দার। রবিনহুড এইবারে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্ল্যাকমানি সাফ করবে। বাবার মালা ঝোলা ছবিটায় একবার প্রণাম করলো সে।