সে বছর, ১৮৯৭ তে বর্ষা নামতে দেরি হচ্ছিল। গরমও ছিল তেমনি অসহ্য। ডাঃ রস, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের মাদ্রাজ শাখার কমিশন্ড অফিসারের কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে, হাত দুটো ঘামে ভিজে। সেই ঘামে ভিজে মাইক্রোস্কোপের স্ক্রুগুলোতে মরচে ধরে যাচ্ছে। শেষ পড়ে থাকা আইপিসটার মধ্যে গরমে ধরেছে ফাটল।
বেগমপেটের সেই আধা অন্ধকার, ঘুপচি, ভ্যাপসা অফিস ঘরে রস একের পর এক মশার ব্যবচ্ছেদ করে চলেছেন। পাখা চালানো যাবে না কারণ হাওয়ার ঝড়ে উড়ে যাবে তাঁর অখণ্ড মনোযোগের সেই পুঁচকি লক্ষ্যবস্তু।
সবসময়ে, ক্রমাগত রসকে বিরক্ত করে যাচ্ছে ক্ষুদে সব পোকা। বারান্দা থেকে ঘরে আসা আলোর পথ ধরে এসে ওরা ঢুকে পড়তে চাইছে রসের নাকে কানে, চোখের কোনে।
তখন আগস্ট মাসের মাঝামাঝি, বহু কষ্টে কয়েকটা (২০ খানা) মশা পাওয়া গেল যারা হুসেইন খান নামে এক ম্যালেরিয়া রুগীকে কামড়িয়েছে। বলা ভালো, খান সাহেব আট আনা পয়সার বিনিময়ে (প্রতিবার কামড়ের জন্য এক আনা) কামড় খেতে রাজি হয়েছেন। বার কয়েক ব্যর্থতার পরে রস শেষ পর্য্যন্ত খুঁজে পেলেন। স্রেফ দুটি মশার পাকস্থলীতে দেখতে পেলেন।
ডায়রির পাতায় লিখছেন “…I saw a clear and almost perfectly circular outline before me of about 12 microns diameter. The outline was much too sharp, the cell too small to be an ordinary stomach-cell of a mosquito. I looked a little further. Here was another, and another exactly similar cell,”
এককালের অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ যুগ্ম ছবি আঁকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান পাওয়া রস পরম মমতায় তাঁর ল্যাবরেটরি নোটবুকের পাতায় এঁকে রাখলেন সেই গোল গোল “pigmented bodies”, যেগুলি আসলে মশার শরীরে ম্যালেরিয়া জীবাণু প্লাসমডিয়াম নামের পরোজীবীর জীবন চক্রের বিভিন্ন দশা।
পেপারটা লিখতে ডাঃ রসের দশদিন মতো লেগেছিল। “On some peculiar pigmented cells found in two mosquitoes fed on malarial blood” ছিল পেপারটার নাম। ওই গবেষণাপত্রটা ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশ পায় ১৮৯৭ এর ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখে।
প্রমাণিত হল হাজার মাইল দূরে ইংল্যান্ডে বসে থাকা তাঁর মেন্টর ডাঃ প্যাট্রিক ম্যানশনের হাইপোথিসিস, যাঁর সাথে রস বিনিময় করেছিলেন ১৭৩ খান চিঠি।
ডাঃ রসকে তাঁর কর্মজীবনে নানা প্রতিকূলতা সামাল দিতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় অসুবিধে ছিল বদলি। এমন সব জায়গায় বদলি যেখানে ম্যালেরিয়ার মশা পাওয়া যায় না। কলকাতার পরে রসকে বদলি করা হয় আসামে। সারা জীবন ম্যালেরিয়া নিয়ে কাজ করা মানুষটিকে বলা হল, এবার কালা জ্বর নিয়ে কাজ করুন।
রসের নিজের ভাষায়, “Columbus having sighted America was ordered off to discover the North Pole. No, the man who can do is not allowed to do, because the man who cannot do is put in authority over him.”
অসুখী, হতমান রস ঠিক করলেন চাকরি ছেড়ে দেবেন। কলকাতার ল্যাবরেটরিতে এতদিনের সযত্নে পোষা পাখিগুলোকে খাঁচার দরজা খুলে উড়িয়ে দিলেন, জারগুলো থেকে ফেলে দিলেন মশার ডিম, লার্ভা। এতদিনের বিশ্বস্ত সহচর মহম্মদ বক্সকে বিষণ্ণ মুখে বিদায় দিয়ে শহর কলকাতা ছেড়ে বিদায় নিলেন রস। তারিখ টা ১৩ই আগস্ট, ১৮৯৮, কেউ তখনও জানে না ভবিষ্যতের কথা।
বাবার জোরাজুরিতে ডাক্তারি পড়তে ঢোকা ডাঃ রস মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ পান ১৯০২ সালে।
এর পর থেকে এটা প্রমাণিত, সারা পৃথিবীর মানুষ মেনে নিয়েছে যে ওসব “খারাপ বাতাস টাতাস নয়, ম্যালেরিয়া ছড়ায় এমন স্ত্রী মশার কামড় থেকে যার পেটে ম্যালেরিয়া রোগের পরজীবী আছে।”
রোগ, ব্যাধির কারণ হিসেবে হাজার বছর ধরে চলে আসা নানান ভ্রান্ত ধারণা যেমন, পাপের ফল, ডাইনির অভিশাপ ইত্যাদিকে মানুষের মন থেকে সরিয়ে দিতে বিজ্ঞানের প্রতিটা ছোট বড় পদক্ষেপ তাই অসীম গুরুত্বের, আনন্দের।
অন্ধকার থেকে আলোর পথে চলা অভিযাত্রীদের একজন ডাঃ রোনাল্ড রস। সেকেন্দ্রাবাদ থেকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালের কানিংহ্যাম ল্যাবরেটরি তাঁর পদচিহ্নে উজ্জ্বল।
১৩ই মে রসের জন্মদিন।
সূত্র:
(১) ম্যালেরিয়া, মসকুইট, এন্ড দ্যা লিগ্যাসি অফ রোনাল্ড রস; রবার্ট সিনডেন, WHO
(২) ব্রিটিশ জার্নাল অফ ইমিউনলোজি, রোনাল্ড রস।