মুখময় চ্যাটচ্যাটে ঘাম। চয়ন ভিড়ের মধ্যে মিশে লুকিয়ে লুকিয়ে চলেছে। হঠাৎ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। একটা লাইট পোস্ট– তার তলায় তিন চারটে মানুষ। একজন চয়নের দিকে তাকালো। চয়ন ওদের কথা আবছা শুনতে পেলো “আরেকটু কাছে আসুক …. আরেকটু….।” চয়ন ছিটকে ডানহাতি গলিটায় ঢুকে পড়লো।
সামনে একটা মাঠ। জলসা হচ্ছে। ভিড়ে ভিড়াক্কার। চয়ন ভিড়ে মিশে যাবে। তাহলে আপাততঃ নিরাপদ। ভিড় ঠেলে ঠেলে চয়ন সামনে এগিয়ে যায়। চারপাশে উন্মাদের মতো মানুষ নাচছে – শিষ দিচ্ছে- লাফাচ্ছে। জামা খুলে হাতে নিয়ে ওড়াচ্ছে। শব্দের তীব্র অভিঘাতে চয়ন চমকে ওঠে। মঞ্চে একটা ছেলে– একমাথা ঝাঁকড়া চুল– মুখে রং মাখা – ঝুঁকে পড়ে গীটার বাজাচ্ছে- একই সুরে বাজিয়েই যাচ্ছে। বাকি দুজন মুঠোয় চেপে মাউথপীস মুখের সামনে ধরে দুর্বোধ্য ভাষায় অদ্ভুত অচেনা সুরে কিছু বলছে। একজন ড্রাম বাজাচ্ছে– ড্রামের শব্দ ধ্বক ধ্বক করে বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। চয়ন আবার শুনতে পায় সেই অমোঘ অচেনা কন্ঠ “অপেক্ষা করছি আমরা অপেক্ষা করছি …. বাইরে এলেই….”চয়ন সব বাধা অগ্রাহ্য করে মঞ্চের পেছন দিয়ে ছিটকে বাইরে বেরোয়। এপাশে একটা বাজার। ও ঘামতে ঘামতে বাজার পার করে বাড়ির রাস্তা ধরে … “ওফফফফফফ বাড়িতে পৌঁছে গেলে নিশ্চিন্ত” ঘরে টিভি চলছে। চয়ন বেল বাজিয়েই যাচ্ছে।
“এ্যাতোক্ষণ লাগে খুলতে? একটা লোক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আর সব ফূর্তিতে টিভি দেখছেন” চয়ন ঘরে ঢুকে কলঘরে যায়। অনেকটা সময় নিয়ে চান করে। খেয়ে নিজের ঘরে এসে শোয়। ওর বৌ সুতপা কী যেন বলতে আসে। চয়ন মাছি তাড়ানোর মতো করে ওকে অন্য ঘরে পাঠায়। ওঘরে মেয়েটা পড়ছে। “ঈস আর কয়েকটা মাত্র দিন– তার মধ্যেই ওরা ওকে ধরে ফেলবে।”
চয়নের মনে হয় – মাঝে মাঝে- সুতপাও এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত। সব্বাই জেনে গেছে চয়ন ব্যানার্জী ভুল করে– জাস্ট বাই মিসটেক ওর কোম্পানির সমস্ত গোপন তথ্য বিদেশী একটা কোম্পানিকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কে বুঝবে এটা জাস্ট একটা সিলি মিসটেক? অফিসে সবাই এমন বিহেভ করে য্যানো কিচ্ছু ঘটেনি– কেউ কিচ্ছু জানে না– অথচ চয়ন জানে– কোম্পানির সমস্ত কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে “ফিনিশ চয়ন ব্যানার্জী।” চয়নের ঘুম আসে না। স্তব্ধ বসে বসে সিগারেট ধরায়। দরজায় খুট করে একটা শব্দ “কে? কে ওখানে?” চয়ন হাতে একটা ফুলদানি তুলে নেয়। সুতপা।
“তুমি শোবে না?” চয়ন সবটাই বুঝতে পারে। হিসহিসিয়ে বলে “ন্না – তুমি ওঘরে যাও।” সুতপা চলে যায়। কখন য্যানো চয়নের চোখে একটু পাতলা ঘুমের প্রলেপ লেগে আসে। একটা তীব্র কর্কশ চিৎকার আর খটখট শব্দে চমকে ওর ঘুম ভাঙে। জানালা থেকে শব্দটা আসছে।
ফুলদানিটা শক্ত মুঠোয় ধরে চয়ন শিকারী বিড়ালের মতো নিঃশব্দে এগোয়। সঙ্গমরত দুটো টিকটিকি। চয়ন দুহাতের ভেতর নিজের মুখটা গুঁজে বসে থাকে। “অসম্ভব – এভাবে বাঁচা যায় না…” মাথায় অসম্ভব ব্যথা করে…….
★★★ ★★★
একটা ঝকঝকে ঘরে চয়ন বসে আছে। পাশে সুতপা। টেবিলের উল্টো দিকে একজন বয়স্ক মানুষ। দেখে বোঝা যায় ডাক্তার।
“কপাল খুব ভালো যে ম্যাডাম আপনি জেগে ছিলেন… আপনি খেয়াল না রাখলে ওনাকে বাঁচানো যেতো না … জাস্ট ঝুলে পড়ার মুহূর্তেই আপনি পৌঁছেছেন…” ডাক্তার হাসেন। দু আঙ্গুলে একটা গোল কাগজচাপা বা পেপারওয়েটকে বনবন করে ঘোরান। সুতপা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে।
“কিন্তু ডাক্তারবাবু ওর অফিসে আমি খোঁজ নিয়েছি … কোনও অসুবিধে নেই … টাকা পয়সা …. মানে আমি তো একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াই … মেয়েটাও তো মানে আমাদের মেয়ে কাজরীও তো … একদম ইয়ে। আর ওর তো অন্য কোনও…. মানে নেশা বা আর কেউ .. নেশার মধ্যে ঐ এক সিগারেট .. আমি তো … আমার দিক থেকেও তো কিছু ….” সুতপার চোখ জলে ভিজে আসে “আমরা তো প্রেম করে… চার বছরের আলাপ.. কোনও ধার দেনা… কিচ্ছু না”
ডাক্তার হাসেন “এই রোগটার নাম সিজোফ্রেনিয়া। এটাকে দ্বৈত ব্যক্তিত্বের রোগও বলা যায়।”
“বুঝলাম না“ সুতপার অকপট স্বীকারোক্তি।
বুড়ো ডাক্তার হাসেন। “বড়ো জটিল ব্যাপার … বুঝতে চেষ্টা করুন।”
সুতপা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে । চয়ন মাথা নিচু করে বসা।
“একটা মানুষ হঠাৎ করে নিজের মনের মধ্যে দু’রকম চিন্তা ভাবনা খুঁজে পেতে থাকে। কেউ ভাবে সে সম্রাট বা ঈশ্বর সে নিজে গোটা পৃথিবীটা চালাচ্ছে। কেউ ভাবে ভয়ানক দোষী এবং সবাই তার ক্ষতি করতে চাইছে। কেউ অকারণে তার জীবনসঙ্গীকে ঈর্ষা সঞ্জাত অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করতে থাকে। আবার কেউ বিশেষ একজনকে ভেবে ন্যায় যে ওই মানুষটি আমার প্রেমে পাগল। এবং তীব্র অধিকারবোধে অহৈতুকী অশান্তি সৃষ্টি করে। এগুলো সব ডিলিউশন। এছাড়া আছে হ্যালুসিনেশন। আকাশ থেকে দৈববাণী শুনতে পাওয়া- অন্য লোকদের কল্পিত কথা শুনতে পাওয়া। বিশেষতঃ সবাই রোগীকে খুনের পরিকল্পনা করছে এটা ভেবে নেওয়া খুব সাধারণ লক্ষণ।”
চয়ন বলে “ঐ চিন্তা … ওগুলো সব অনেকটা কমে গেছে। আমি ভাবতাম আমি ভয়ঙ্কর কিছু ভুল করেছি আর সবাই তাই আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে…. এমনকি আমি ওদের সব কথাই শুনতে পেতাম।”
সুতপা বোতল থেকে আলগোছে জল খায় “এটা কেন হয়? এতো ভয়াবহ কষ্টের অসুখ….”
চয়ন সুতপার বাহুমূল চেপে ধরে। মুখে তৃপ্তির ছাপ। সে আবার তার পুরোনো ভালবাসার আভাস ফিরে পাচ্ছে।
ডাক্তার অন্যমনে বেল বাজান। জিজ্ঞাষু চোখে একজন নার্স উঁকি দেয়।
ডাক্তার হেসে বলেন “চা… হবে নাকি এককাপ করে?”
নার্স যান্ত্রিক হাসি হেসে একটা ফ্লাস্ক নিয়ে কাগজের কাপে চা ঢেলে দ্যায়।
চা ঠোঁটে ঠেকিয়ে ডাক্তার বলতে থাকে “খুব কমই আমরা জানি তবে বংশগত ভাবে এক শতাংশ লোকের হতে পারে। এটা আসলে মাথার ভেতরে দুটো রাসায়নিক পদার্থ কমে যায়। ডোপামিন আর সেরেটোনিন। খুব সহজ ভাষায় এটাই এই রোগের জন্য দায়ী। তবে হঠাৎ যদি কারো ব্যক্তিত্ব বদলে যায়– অন্তর্মুখী হয়ে যায়– কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ে– অকারণে কথা বলে বা ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠতে থাকে– তাহলে তার বাড়ির লোকদের একটু পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এছাড়াও একটা সিজয়েড ব্যক্তিত্ব আছে– এরা সাধারণভাবে অসম্ভব খুঁৎখুঁতে হয়– আগে থেকে ঠিক না করে কিছু ঘটলে মেনে নিতে পারে না– বিশেষতঃ কারু আসা বা কোথাও যাওয়া নিয়ে। এদের জন্যে বিশেষ ধরনের কাউন্সেলিং করতে হয়” বলে বুড়ো ডাক্তার চেয়ার থেকে উঠে পড়েন “তবে এই সিজোফ্রেনিয়া রোগীকে সারা জীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয় …”
সুতপা চয়নের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় “আবার কবে আসতে হবে ডাক্তার বাবু …”
“প্রথম প্রথম একটু তাড়াতাড়ি আসতে হবে পরে ছমাসে একবার এলেই হবে … এবারে পনেরো দিন পরে আসবেন …চলুন চয়নবাবু, এগিয়ে চলি….”
ছবি সৌজন্যে: দীপঙ্কর ঘোষ।