ভূদেব ছিল অসম্ভব দুষ্টু। ওর মাথা ছিল দুষ্টুমির ফ্যাকটরি। যতরাজ্যের বদমাইশি খুঁজে বের করে কাজে লাগানোর ব্যাপারে ওর জুড়ি মেলা ছিল ভার। তাই একদিন যখন বলল, “আচ্ছা, কাল উল্টোরথ না? আমাদের স্কুলে ছুটি নেই কেন?” আমরা বুঝলাম মাথায় কিছু এসেছে।
ভূদেব বলে চলল, “রথের দিন রথ টেনেছি। উল্টোরথের দিন জগন্নাথ মাসির–বাড়ি থেকে ফিরবে না? কাল রথ না টানলে পাপ হবে!”
ওরে বাবা! ভূদেবের পাপ নিয়ে চিন্তা? আমরা খুব হাসলাম। কিন্তু ভূদেব তাতে থামল না। বলে চলল, “কালও রথ টানতে হবে।”
টান! কে বারণ করেছে?
ভূদেব দমবার পাত্র নয়। “কী করে? কাল স্কুল ছুটি দেয়নি।”
স্কুল ছুটি না দিলে রথ টানা যাবে না? রথ তো সন্ধেবেলা টানা হয়। চিরকালই সারাদিন রথ সাজিয়ে বিকেলবেলা টানতে বেরিয়েছি।
ভূদেব বলল, “কিন্তু ছুটি থাকে তো। কাল ছুটি নেই। স্কুলেই রথ টানব।”
আমরা হতভম্ব! স্কুলে রথ! ইয়ার্কি নাকি? না–হয় বড়ো হয়েছি। ক্লাস নাইন বলে কথা! কিন্তু তাই বলে স্কুলে রথ – বা অন্য কিছু…
কে যেন বলল, “আমি ওর মধ্যে নেই। দোলের আগের দিন কী হয়েছিল মনে নেই?”
মনে নেই আবার! দোলের আগের দিন, ক্লাসের মেয়েরা প্ল্যান করে আবির নিয়ে এসেছিল। যেই আমরা ক্লাসে ঢুকেছি, ওমনি খপাখপ ধরে আবির মাখানো। আজকাল যারা দোলের দু’ দিন আগে থেকেই স্কুল কলেজ থেকে বাঁদুরে রং মেখে বেরোয়, তারা এই ব্যাপারটা বুঝবে না, যে আমাদের সময়ে দোলের আগে রং খেলত কেবল উত্তর কলকাতার আর ভবানীপুরের ‘অবাঙালি’ এলাকার ‘অভদ্ররা’। আমরা দোল খেলতাম কেবল দোলের দিন – সকালে।
সে যা হোক, অতর্কিতে আবিরাক্রান্ত হয়ে আমরাও ছেড়ে দেবার পাত্র নই – ওই আবিরই কেড়েকুড়ে নিয়ে মেয়েদেরও মাখান হল। ফলে আবির শেষ হল অচিরেই। বেঞ্চে–ডেস্কে যা পড়েছিল সেও শেষ হতে সময় লাগল না। ক্রমে দেখা গেল ক্লাসে গোটা চল্লিশেক ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র দশ–বারোজন ছেলেমেয়ে গোলাপি আবির মাখা, বাকিদের ইউনিফর্ম ধবধবে সাদা।
ক্লাসে এসে টিচার যারপরনাই বিরক্ত হলেন। কিন্তু তখন তো আর কিছু করার নেই, তাই পড়াতেও দ্বিধা করলেন না। কিন্তু খানিকক্ষণ যেতে না যেতেই ডাক এল রঙিন ছাত্রদের। প্রিনসিপ্যালের ঘরে। শুধু ছেলেরা। মেয়েদের ডাকা হল না। তারা যেমন গোলাপি ছিল তেমনই রয়ে গেল ক্লাসে। আমরা জনা সাতেক গেলাম।
প্রিনসিপ্যালের অফিসে বোর্ড বসল। রয়েছেন ভাইস প্রিনসিপ্যাল, অঙ্কের হেড, ইত্যাদি। কে তাঁদের খবর দিয়েছিল আমরা আজও জানি না। আমাদের বলা হল একটাই প্রশ্নের উত্তর দিতে। কে এনেছে আবির?
ভাইস–প্রিনসিপ্যাল বললেন, “আমরা বুঝতে পারছি, ছেলেদের মধ্যেই কেউ এনেছে। যে এনেছে সে নিজে হয়ত রং মাখেনি। হয়ত সে এখানে নেই–ও। সুতরাং কে এনেছে আবির আমাদের বলে দাও। আমরা তোমাদের ছেড়ে তাকেই শাস্তি দেব।”
ছেলেরা কেউ আনেনি। মেয়েদের মধ্যেই কেউ এনেছিল। কিন্তু সে কথা বলার জন্য কেউ তৈরি না। প্রথমত, বন্ধুদের / বন্ধুকে ঝোলালে কী হতে পারে সবই আমরা জানি। দ্বিতীয়ত, ভাইস–প্রিনসিপ্যালকে আমরা মোটেই বিশ্বাস করতাম না। দেবদত্তর দাদা আমাদের বলে রেখেছিল – মনে রাখিস – হি ইজ আ স্নেক ইন দ্য গ্রাস। এক্কেবারে বিশ্বাস করবি না। তৃতীয়ত, সত্যিই মেয়েদের মধ্যে কে আবির এনেছিল, আমরা জানতাম না।
আমরা চুপ করে রইলাম। আমাদের নানারকম জোরাজুরি করা হল। মিষ্টি কথায়, কড়া কথায় কাজ হল না। বলা হল আমাদের তাহলে সাসপেন্ড করে দেওয়া হবে।
ভয় পেলাম, তবু কেউ ভাঙল না। শেষে বলা হল, যাও বাইরে যাও। অফিসের বাইরে বেঞ্চ আছে, সেখানে বসো গিয়ে। এখানে তোমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার মিটিং হবে।
বসলাম। সেখানে ক্লার্করা এসে বলে গেল, “সাবধানে বসবে। এই সবে প্ল্যাস্টিক পেন্ট করা হয়েছে দেওয়ালে। সেখানে রং লাগলে কিন্তু…”
সত্যিই নতুন রং। প্রিনসিপ্যাল, ভাইস–প্রিনসিপ্যালের অফিসের সামনে বসার বেঞ্চে নতুন বার্নিশ, নতুন রেক্সিনের গদি। আমরা বসলাম সাবধানে।
বসে আছি, বসেই আছি। হঠাৎ ভূদেব বলে, “নতুন গদিগুলোর স্পঞ্জগুলো খুব ভালো রে!”
ভালো তো বটেই। বসে আছি তো তারই ওপরে! ভূদেব বুঝিয়ে বলল, “না, এই দেখ ঝকঝকে সাদা স্পঞ্জ।”
আড়চোখে তাকিয়ে চোখ চড়কগাছ! হাতে ইয়াব্বড়ো একমুঠো স্পঞ্জ। “কোথায় পেলি?”
হাতে ধরা একটা আধখানা ব্লেড। বলল, “দু আঙুলের ফাঁকে রেখে রেক্সিনটা কেটে ছিঁড়ে ছিঁড়ে বের করলাম!”
আমি কোনদিকে তাকাব বুঝতে পারছি না। আরে ব্যাটা লুকো, লুকো! কে কোত্থেকে দেখে ফেলবে! ভূদেব নির্বিকারভাবে স্পঞ্জের তালটা পকেটে ভরে ফেলল।
খানিক বাদে অফিস থেকে ডেকে আমাদের হাতে হাতে সাতদিনের সাসপেনশন নোটিস দেওয়া হল। সাত দিনের সাসপেনশন ফর গ্রস মিসকন্ডাক্ট।
ন’বছর স্কুলে আছি। কোনও দিন এত বড়ো শাস্তি পাইনি। আজও নিজের দোষে নয় – পেলাম। ভূদেবের খুব আনন্দ। সাত দিন পড়াশোনা না করলেও চলবে। বললাম, “বাড়িতে বকা খাবি।”
ভূদেব বলল, “কেন খাব? আমি তো রোজ বই ব্যাগ নিয়ে স্কুলে বেরিয়ে যাব।”
“কোথায় যাবি?”
“যাব কোথাও… বন্ধুর বাড়ি…”
ভূদেবের বাড়ি চেতলায়। ওর চেতলা বয়েজের বন্ধুরা প্রায়ই স্কুল যায় না। কিন্তু সে সুখ তো আমার জীবনে নেই। সাত দিন বাড়িতে না–জানিয়ে স্কুলের নাম করে বেরিয়ে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে ঢাকুরিয়া লেকে বসে থাকাও আমার দ্বারা হবে না।
তবে?
ক্লাসে পৌঁছলাম। সবাই জানতে পারল শাস্তির কথা। কেউ বলল, “বা রে! মেয়েরা বেঁচে গেল কেন?”
ভূদেবের খুব আনন্দ। হাঃ হাঃ, ওরা ভাবতেই পারেনি মেয়েরা আবির এনেছে। খালি বলে চলেছে – আমরা জানি তোমাদেরই কেউ এনেছ। বা অন্য কোনও ছেলে!
সান্টা বান্টার এরকম গল্প আছে। লোকে সান্টার ওপর খুব খ্যাপা। সবাই মিলে গ্রামছাড়া করেছে – ফিরলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে প্রতিজ্ঞা করে। সান্টা চলে গেছে, কিন্তু কিছুদিন পরে গ্রামে ফিরেছে সান্টার জমজ ভাই বান্টা। লোকে তাকেই ধরে মারতে লেগেছে মার–সান্টাকে, মার–সান্টাকে বলে। সে মার খায় আর হাসে। যত হাসে তত আরও মার খায় – আর আরও জোরে হাসে। শেষে লোকে রেগে জিজ্ঞেস করেছে, আরে এত হাসছ কেন? মার খেতে ভালো লাগছে? বান্টা কোনও রকমে হাসি থামিয়ে বলেছে, দূর তোমরা এত বোকা তাই হাসছি। আমি তো বান্টা!
ক্লাস ভণ্ডুল হল। পিরিয়ড শেষ হতে সকলে ঘিরে ধরল। বুঝলাম সকলেরই খুব আনন্দ আমরা ফোকটে সাতদিনের ছুটি পাচ্ছি বলে। এর মধ্যে কে আবার বলল, “আমি যদ্দূর জানি, সাসপেনশন মানে বাড়িতে থাকা নয়। সাসপেনশন হলে সকাল থেকে বিকেল অবধি এসে প্রিনসিপ্যালের ঘরের সামনে বসে থাকতে হবে ইউনিফর্ম পরে, ব্যাগ–পত্তর নিয়ে!”
কেলো করেছে!
পরের পিরিয়ড শুরু হল। জোর করে বসিয়ে পড়াতে শুরু করলেন স্যার। এমন সময় আবার প্রিনসিপ্যালের চামুণ্ডা হাজির। যাদের সাসপেন্ড করা হয়েছে, তারা আবার প্রিনসিপ্যালের অফিসে যাবে। সাসপেনশন নোটিস হাতে নিয়ে।
এ আবার কী! গেলাম আবার। এবারে সে ঘরে ঢুকে দেখি চোরের মত মুখ করে আমাদের ক্লাসের রঙিন মেয়েরা দাঁড়িয়ে। ওরা আবার কখন সমন পেল? ওদের তো কেউ ডেকেছে বলে দেখিনি… ক্লাস থেকে বেরোলই বা কখন? আচ্ছা, যখন আমাদের সবাই ঘিরে ধরে জানতে চাইছে কী হল, তখনই ওরা চলে গেছে।
প্রিনসিপ্যাল মুখ খোলা মাত্র বুঝলাম, ঠিক। ওদের ডেকে পাঠায়নি কেউ। ওরা নিজেরাই এসেছে।
প্রিনসিপ্যাল বললেন, “তোমাদের ক্লাসের মেয়েরা এসে বলেছে যে ওরাই নাকি আবির এনেছিল, ওরাই নাকি জোর করে তোমাদের আবির মাখিয়েছে, তোমাদের কোনও দোষ ছিল না। মেয়েরা আবির এনে মাখিয়েছে, এ কথা বিশ্বাস করতে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে। তবে ওরা যখন স্বীকার করেছে, তখন আর কিছু বলার নেই। তোমাদের সাসপেনশন তুলে নেওয়া হল। ক্লাসে যাও।” বলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের সাহস আছে। তাই তোমাদের শাস্তি দেওয়া হল না। কিন্তু ওয়ার্নিং দিলাম। এর পর কিন্তু আর ছাড়া পাবে না। যাও। এমন আর কোরো না।”
বেরোবার আগে ভাইস–প্রিনসিপ্যাল বললেন, “মনে রেখো, মেয়েদের আঁচলে মুখ ঢেকে বেঁচে গেলে। তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত। সারা জীবন মনে রাখবে…”
মোটেই লজ্জা হয়নি। কিন্তু এই স্কুলে উল্টোরথ টানা? সে–ও কি সম্ভব?
ভূদেব বলল, “পারমিশন নিতে হবে।”
আর কিছুই বলল না।
পরদিন ক্লাসে ঢুকে দেখি তিনতলা রথ রাখা পেছনে। শুইয়ে, যাতে টিচারের চোখে না পড়ে। ভূদেব গেটের কাছে ঘুরঘুর করছে। প্রিনসিপ্যাল আসলেই ঘরে যাবে। ভাইস–প্রিনসিপ্যাল বোঝার আগেই কাজটা করতে হবে। ভাইস–প্রিনসিপ্যাল জানতে পারলে…
প্রথম পিরিয়ড শুরু হবার কয়েক মিনিট পরেই ভূদেব ফিরল। টিচার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
ভূদেব বলল, “প্রিনসিপ্যালের ঘরে গিয়েছিলাম।”
এইরে! টিচারের মুখ শুকিয়ে গেল। “কেন? আবার কী করেছ?”
ভূদেব অভয় দিয়ে বলল, “না না, আমার কিছু কাজ ছিল।” সিটে ফিরল বিজয়গর্বে।
ঝুঁকে পড়লাম আমরা। “কী হল?”
“পার্মিশন দিয়ে দিয়েছেন। এখন চেপে যা। পরে বলছি।”
সে কী! আমরা অবাক! উত্তেজনা চাপা দায়! কোনও রকমে শেষ হল ক্লাস। ঘণ্টা পড়ামাত্র সবাই ছেঁকে ধরল – “কী হল? কী হল?”
ভূদেব বলল, “তোদের যা বলেছিলাম, তা–ই বলেছি। বললাম, রথের দিন রথ টেনেছি, স্যার। উল্টোরথে না টানলে পাপ হবে। টিফিনের সময়ে চালাব। একটু পারমিশন দিয়ে দিন।”
“কী বললেন?”
“কিছু না। চিঠিতে সই করে দিয়েছেন। অ্যালাউড – লিখে!”
বাপরে!
ভূদেবকে দেখে বোঝা যেত বসুন্ধরা সত্যিই বীরভোগ্য। সাহস করে কতো কী করে ফেলত – কত কী নিজে নিজে হয়ে যেত! একবার লাইটহাউস না নিউ এম্পায়ারে গেছে ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ সিনেমা দেখতে। ব্রুস–লী, ব্রুস–লী করে কলকাতা তখন পাগল। ভূদেব ক্লাসের প্রায় পনেরোজনকে উদ্বুদ্ধ করে নিয়ে গেছে নুন শো দেখতে। টিকিট নেই।
সে ছিল টিকিট না–পাওয়া আর ব্ল্যাকে টিকিট কাটার যুগ। সস্তাতম টিকিট তখন সবে পঁচাত্তর পয়সা থেকে বেড়ে নব্বই পয়সা হয়েছে। সবচেয়ে দামী টিকিটের দাম দশ–বারো টাকাও হবে না। কিন্তু হাউস ফুল, কোত্থাও টিকিট নেই। দু’টাকা তিন টাকার টিকিট ব্ল্যাকাররা হই হই করে পঞ্চাশ ষাট টাকায় বিক্রি করছে। তেমন সিনেমা হলে টিকিটের দামের পঞ্চাশগুণও হাঁকত নাকি।
এর পরের ঘটনাটা চেষ্টা করি ভূদেবের জবানীতেই বলতে।
আমি অনেক সিনেমার টিকিট কেটেছি মাইরি – কিন্তু এমন ভীড় জীবনে দেখিনি। এক হাত চলা যাচ্ছে না। লোকে হাহাকার করছে। ভেবেছিলাম ফ্লাইং ধরে ঢুকে যাব… (এখানে প্যারেন্থিসিস–এ ভূদেবের ফ্লাইং ধরার গল্প বলি – সিনেমা হলে অনেক সময়েই এমন লোক পাওয়া যায় যারা অ্যাডভানস টিকিট কেটেছে কিন্তু দেখতে পারবে না। তারা এসে টিকিট বিক্রি করে দিয়ে যায় – দামের দাম দিয়েই। সেটাই ফ্লাইং টিকিট। ভূদেব একবার আমাদের জনা দশেককে নিয়ে মধ্য কলকাতার কোন সিনেমা হলে এক কোণে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, কেউ যদি এসে বলে টিকিট চাই? নিয়ে নিবি। বলে আধ ঘণ্টার মধ্যে সবাইয়ের শুধু টিকিট জোগাড় করেনি, হলে ঢোকার আগেই এক্সচেঞ্জ করে আমাদের সবার একসঙ্গে বসার ব্যবস্থা করেছিল। সেই ভূদেব এখন ফ্লাইং পাচ্ছে না… ফিরে যাই এন্টার দ্য ড্রাগনে)।
ফ্লাইং নেই দেখে সবে ভাবছি, এবারে আর হল না, এমন সময় পুলিশের রেড হয়েছে। ব্ল্যাকারগুলো এদিক ওদিক পালাচ্ছে, একটা ব্ল্যাকারকে পুলিশ ধরেছে, আর ও–ও, বমাল সমেত ধরা দেবে না বলে ওর টিকিটের বাণ্ডিলটা ছুঁড়ে দিয়েছে। হবি তো হ, বাণ্ডিলশুদ্ধু টিকিট আমার জামার – এই বুকের বোতামটা তো খোলা থাকে – ভেতর গলে আমার পেটে আটকে গেছে। ভাগ্যিস জামাটা গুঁজে পরেছিলাম!
তারপর?
তারপর আর কী! সবাই টিকিট পেলাম। আশেপাশে যারা টিকিট চাইছিল তাদের দিলাম, ওখানে কয়েকটা চাইনিজ ছেলে ছিল, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে এসেছিল, ওরাও টিকিট পাচ্ছিল না। ওদের দিলাম। এখন হেবি দোস্তি হয়েছে। ওরা হল যমুনা সিনেমা হলের তল্লাটের ছেলে। এখন থেকে যমুনায় টিকিট পেতে কোনও অসুবিধে হবে না।
ভূদেব পকেট থেকে চিঠি বের করল। তাতে কাঁচা, কিন্তু নির্ভুল ইংরিজিতে ওই কথাই লেখা। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো কথা – চিঠির নিচে লেখা ‘অ্যালাউড’ আর তার নিচে প্রিনসিপ্যালের সই আর স্ট্যাম্প।
কে যেন বলেছিল, “কিন্তু রথ তো সাজানো নেই। টিফিনের আধঘণ্টায় রথ সাজিয়ে কতটুকু আর চালানো যাবে?”
এক গাল হেসে ভূদেব বলল, “কে বলেছে, টিফিনের সময় তো চিঠিতে লেখা নেই। সুতরাং কতক্ষণ চালাব সে আমাদের ওপর!”
বুদ্ধি দেখে আমরা চমৎকৃত! টিফিনের আগেই প্রিনসিপ্যাল বাড়ি যান। সুতরাং কেউ গিয়ে জিগেসও করবে না। আর ফোন করলে? সে দেখা যাবে ’খন।
টিফিনের সময় আমাদের খাওয়া ফেলে রথ সাজানোর সে কী ধুম! ভূদেব গাইড করছে সবাইকে। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে, “অনি, তুই ঘোষের পোকে ওই কীর্তনটা শিখিয়ে দে। ওই যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সুর দেওয়াটা। ওটাই আজ সংকীর্তন হবে।
কবিতা সহজ। সুরও। ঘোষ–কে শিখিয়ে দিলাম। সে–ও সাদা ফুলপ্যান্টের ওপর নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট চড়িয়ে নিল। ও–ই প্রধান গায়ক। ব্যাগ থেকে খঞ্জনি বের করল ভূদেব। ও বাজাবে। বলল, “খোল আনতে পারতাম, কিন্তু বড্ডো বড়ো। ধরা পড়ে যাব।”
ক্লাস নাইন – এ সেক্সন থেকে রথ বেরোল। হই হই করতে করতে তিনতলা করিডোর ধরে বার দুয়েক তিনেক প্রবল গর্জনে কীর্তনের সঙ্গে সবাই চলল। দেখতে দেখতে তিনতলার সব ক্লাস (বাকি ক্লাসগুলো ক্লাস এইটের ছিল) খালি। হইচই শুনে টিচার্স রুম থেকে টিচাররা বেরিয়ে এল। ছাত্রদের দুষ্টুমিতে সকলেরই মুখে প্রশ্রয়ের একটু হাসি।
ভূদেব বলল, “নিচের করিডোরে চল। এখানে টিচারদের ভীড় বাড়ছে।”
দূরের সিঁড়ি দিয়ে আমরা নেমে গেলাম দোতলায়, সেখান থেকে একতলায়। ক্লাস এইট, সেভেন, সিক্স এবং শেষে ফাইভের ছেলেমেয়েরা সবাই বেরিয়ে এসেছে, সে বিরাট মিছিল। এবারে রথ নিয়ে গান গাইতে গাইতে চারতলায় – সেখানে আমাদের ক্লাসের অন্যান্য সেক্সন। এবং তারও ওপরে ক্লাস টেন আর ইলেভেন।
তারাও আগে থেকেই অনেকে যোগ দিয়েছিল। এখন বাকিরাও ক্লাস থেকে বেরিয়ে এল। একটা করে ক্লাসরুমের পাশ দিয়ে রথ যায়, আর সে ক্লাসের ছেলেরা বেরিয়ে এসে মিছিলে যোগ দেয়। তুমুল হইচই, আর সেই সঙ্গে গান –
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব – হাসে অন্তর্যামী।
এই কবিতা গাওয়া হচ্ছে কীর্তনের সুরে, ফিরে ফিরে, বার বার। প্রতি দু লাইনের পরে যে বিরতি, সেই বিরতিতে যারা গাইছে না তারা ধুয়ো দিচ্ছে, কানফাটে ‘হেই’ শব্দে।
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। (হেই)
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব – হাসে অন্তর্যামী। (হেই)
টিফিন শেষের ঘণ্টা কখন পড়েছে, কেউ শুনতেই পায়নি।
আমি পেয়েছিলাম। ভূদেব আমাকে বলেছিল, “তুই এখন ক্লাসে যা। ওখানেই থাক। টিফিনের পরে টিচার এলে বলে দিবি, ক্লাসে কেউ নেই, সবাই রথ টানছে।”
আমি তাই করেছিলাম। হিস্ট্রি স্যারকে বিদায় দিয়ে আবার ফিরে এসেছি। রথ চলছে দোতলার করিডোর দিয়ে, হঠাৎ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন স্বয়ং অঙ্কের হেড – আশুবাবু। দশাসই চেহারা, হাতে মিটার স্কেল!
সঙ্গে ভাইস–প্রিনসিপ্যাল। তিনি তেমনই শুঁটকো এবং বেঁটে। কিন্তু ভয়াবহতায় কম যান না। বাজখাই গলায় আশুবাবু বললেন, “ক্লাস টাস নেই?”
কিছু স্টুডেন্ট আশুবাবু আর ভাইস–প্রিনসিপ্যালকে দেখেই সটকেছিল, আরও কিছু আশুবাবুর হুঙ্কার শুনে হাওয়া। কিন্তু ভীড় তেমন কমল না। বরং “হেই… রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুম ধাআআআম…”-এর জোর কিছু বাড়ল। সর্পিল ভঙ্গীতে সেই সুরের সঙ্গে নাচতে নাচতে ভূদেব আশুবাবুর মুখের সামনে মেলে ধরল চিঠি – তাতে লেখা আছে, “উই বেগ ইউ টু অ্যালাউ আস টু পুল দ্য চ্যারিয়ট অন দ্য করিডোর ইন ফ্রন্ট অফ আওয়ার ক্লাসরুমস, সো দ্যাট উই আর সেভড ফ্রম সিন…” আর তার নিচে প্রিনসিপ্যালের সই। নিজে হাতে অ্যালাউড লেখা।
সময় দেওয়া নেই।
আশুবাবু আর ভাইস–প্রিনসিপ্যাল মুখ–তাকাতাকি করতে থাকলেন, মিছিলটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে তিনতলায় চলে গেল।