না। তৃতীয় ঢেউ মারাত্মক হয়নি। অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু সেরকম সাংঘাতিক রোগীর সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। যদিও ভয় ছিল ষোলআনা। দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাবেই। অল্প কিছু ক্ষেত্র বাদ দিলে সামান্য হাঁচি-কাশি বা দু-তিনদিনের জ্বরের ওপর দিয়েই মিটে গেছে। যদিও মধুরেণসমাপয়েৎ দেখে খেলা-মেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের যাথার্থ্য বিচার করতে চাওয়া অবান্তর। এটা অনেকটা হেলমেট ছাড়া বাইক চালিয়ে এসে বুক বাজানোর মতোই ব্যাপার। আশা রাখা যাক, ভাইরাসের এবার ঝিমিয়ে যাওয়ার পালা। এর আগের ভাইরাসঘটিত অতিমারীগুলোতেও তাই হয়েছিল। ধীরে ধীরে ভাইরাসের শক্তি কমে যায়। যদিও কার্যক্ষেত্রে সবকিছু ভালোর দিকেই যাবে কিনা সেটা সময়ই বলবে। এর আগেও অনেকে অনেকরকম ভবিষ্যৎবাণী করেছেন এবং তার অনেক কিছুই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই, আশা থাক। সাথে সতর্কতাও থাক। বাচ্চারা সতর্কতা নিয়েই স্কুলে যাক। তারা অনেকদিন বন্ধুদের পায়নি, স্কুলের মাঠ পায়নি, টেবিল-বেঞ্চ-চক-ডাস্টারের জগৎটা পায়নি। অনেকের পড়াশোনার দুনিয়াটাই সারা জীবনের জন্য মুছে গেছে। তাড়াতাড়ি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া দরকার। প্রচুর বাচ্চা মোবাইল-কম্পিউটারে অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে বা বাড়িতে ইন্টারনেটের নেশায় চোখ দিয়ে জল ঝরা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছে। মোটা হয়ে যাওয়ার সমস্যাটাও অনেকটা বেড়েছে।
****
আমাদের হাসপাতালে সারা পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় জটিল-কুটিল, বহুদিনের না সারা রোগ নিয়ে বাচ্চারা আসে। অনেকের কাছেই একতাড়া করে কাগজপত্র পাওয়া যায়। সবকিছু পড়ে-টড়ে বুঝে নিতে অনেকটা সময় লাগে। একজনের জন্য বেশি সময় লাগলেই পেছনে সাপের মতো লাইনে গুজগুজ ফিসফিস শুরু হয়ে যায়। সেটা চিৎকারে পৌঁছোতে বেশি সময় লাগে না। তারপর দেখা যায় বেশি চিৎকার করা লোকজনের অধিকাংশ-ই সাধারণ সর্দিকাশি, পাতলা পায়খানা কিংবা গোলগাল বাচ্চার ‘কিছু খায় না’ নিয়ে এসেছে। যেগুলোর অধিকাংশেরই চিকিৎসা বাড়ির কাছের ছোটো হাসপাতালে হয়ে যাওয়ার কথা। এটা এ দেশের চিরকালীন সমস্যা। সাধারণ সমস্যা দিয়ে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার মাথাভারী হয়ে যায়। অর্থাৎ, টার্শিয়ারী কেয়ার সেন্টার বা তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে যেখানে তুলনামূলক ভাবে জটিল রোগীদের চিকিৎসা হওয়ার কথা সেখানেও সাধারণ রোগীদের ভিড়। ফলে যাদের সত্যিই অনেকটা সময় নিয়ে চিকিৎসা করার কথা তাদের জন্য সময় কমে যায়। ধরা যাক, কিডনির রোগ নিয়ে যে বাচ্চাটা এসেছে তাকে রোগটা বোঝানো, জলের হিসেব, স্টেরয়েডের ডোজের হেরফের, পেচ্ছাবের পরিমাণ মাপা, প্রতিদিন পেচ্ছাবে প্রোটিন মেপে রাখা, প্রেশার মাপা ইত্যাদি সবকিছু ভালোভাবে করতে অন্তত মিনিট পনেরো সময় লাগার কথা। অথচ, সেটা পাঁচ মিনিটে সেরে ফেলতে হয়। কিডনির রোগ তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিনে তিন-চার লিটার করে নাকের স্যালাইন ড্রপ লিখি। উপযুক্ত রেফারেল সিস্টেম না গড়ে উঠলে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার নিচের স্তরগুলোই আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভিত শক্তপোক্ত না হ’লে যে কোনও সময় পুরো বাড়ি ভেঙে পড়ার ভয় থাকে। এই অতিমারী প্রাথমিক চিকিৎসা মজবুত করার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে শিখিয়েছে।
****
বাইরে আবার বিষন্ন দিন। হাসপাতাল ক্যাম্পাসের মধ্যে অনেকগুলো বড় বড় গাছ। কখন থেকে তাদের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে খেয়াল করিনি। শীতের শিরশিরে ভাবটা কেটে হাল্কা গরমের আভাস এলেই কী যেন বিষন্নতা হাঁ করে ছুটে আসে। ছাদের ওপর প্রায় প্রতিদিন হাল্কা ব্যায়াম করতে যাই। ছাদ থেকে গাছগুলোর মাথা সহজেই দেখা যায়। অথচ এতদিন চোখে পড়েনি। আজ বিষন্ন বাতাসে কেমন যেন পাতাঝরার সুর। আজই গাছগুলো দেখলাম। একটাও পাতা নেই! হেমাটোলজি বিভাগে হাউসস্টাফ থাকার দিনগুলো মনে পড়ছে। মাসের পর মাস ভর্তি থাকা রোগীদের বেশিরভাগকেই নাম ধরে চিনতাম। কেমোথেরাপি শুরু হবে… মাথার চুল উঠবে… অজস্র ছুঁচ, ওষুধের নল পেঁচিয়ে ধরবে… কেউ জিতে ফিরবে, হারিয়ে যাবে কেউ…
এরকম কেন হয় জানি না। খুব ছোট বয়স থেকেই শীত ছেড়ে গেলেই মনখারাপ হ’তে শুরু করে। ওই কবোষ্ণ দখিন হাওয়ায় স্মৃতিরা ভিড় করে। স্মৃতিতে বুঝি বেশি করে মনখারাপই জমা থাকে। একলা আয়নায় মৃত্যুর শীতলতা। যে গেছে সে একেবারেই গেছে…