নরোত্তমদা’ বলল আমাকে। তার নতুন শেখা আপ্তবাক্যটা।- নতুন করে কোনও গল্প লেখার উপায় নেই। পৃথিবীর সব গল্পই বহুদিন আগে লেখা হয়ে গেছে।
আমি’ হা হা করে হেসে বললাম,- তাই হয়? হতে পারে কখনও?
ত্রিভুবন বাবুর বলা কথাটা নরোত্তমদা’ও ঠিক বিশ্বাস করেনি বোধহয়, তবু জেদ করে বলল,- বাঃ রে, অত বড় লেখক ত্রিভুবন সান্যাল নিজে মুখে বললেন যে! তোর সামনেই বললেন তো।
– বললেই বা, তা মানতে হবে কেন?
বিখ্যাত সাহিত্যিক ত্রিভুবন বাবুর কাছে নরোত্তম দা’ গেছিল আমাকে নিয়ে। গল্প লেখার কায়দা কানুন শিখতে। মানে এই যে উনি অত অত গল্প লেখেন, প্লট কোত্থেকে পান, কী করে সাজান, এই সব। এমনিতেই ভারি ব্যস্ত ছিলেন। ছ’মাস পরে পুজো। আজকাল শারদীয়া সংখ্যা বেরিয়ে যায়, মহালয়ারও পনেরো কুড়িদিন আগে। তাই নাকি খুব চাপ।
নেহাত আমার ছোট মেসো ওনার কলেজের বন্ধু। সেই সুবাদে এই বাড়িতে দেখা করতে ঢুকতে পেরেছি আমরা। গিয়ে উঠতি লেখক বলে নিজেদের পরিচয় দিয়েছি। মেসো বারবার বলে দিয়েছিলেন,- তোদের ওই লিটল ম্যাগাজিনের জন্য মোটেই লেখা চাইবি না। ও কিন্তু ফ্রিতে লেখা দেয় না কোত্থাও!
আমরা বাংলায় লেখালেখি করি। আমাদের গ্রুপের নাম কথা কও। আমাদের লেখা বড়রা কেউ ছাপে না বলে, আমরা কয় বন্ধু মিলে একটা দু ফর্মার লিটল ম্যাগাজিন বার করি।
সবই প্রায় কবিতা। অতি অখাদ্য সে সব। কিন্তু খালি কবিতা থাকলে তো আর চলবে না। অন্তত খান তিনেক গল্প আর একটা প্রবন্ধ থাকলে, ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির খগেন কাকা বলেছেন, সেখানে এককপি রাখার ব্যবস্থা হতে পারে।
আর তা’ছাড়া অত কবিতা ছাপলে সৌজন্য সংখ্যাতেই সব কপি নিঃশেষ হয়ে যাবে। বৃন্দাবন যে ওর থিসিস গাইডকে আর ইউনিভার্সিটির অফিস ক্লার্ককে এক এক কপি দিয়ে ইমপ্রেস করবে, কিম্বা আমি সলিল কুমার পাঁচকপি কিনে পাঁচজন বালিকাকে থুড়ি সম্ভাব্য প্রেমিকাকে উপহার দিয়ে কলার তুলব, তার উপায় থাকবে না।
গ্রুপের সবাই মিলে নরোত্তমদা’কে মুরগী করেছি। সস্তার ব্রয়লার মুরগী না। দামি কড়কনাথ মুরগী।
– তুমি দাদা সব পারো। এক সঙ্গে একশ’টা ফুচকা খেতে পারো, লং জাম্পে দৌড়ে এসে বালির জায়গায় না পৌঁছাতে পেরে হাঁটুর নুন ছাল তুলে ফেলতে পারো। তুমি চাইলেই গল্প লিখতে পারবে।
এই সব চাপের মুখে দাদার এই অভিযান। এ তো আর কবিতা লেখা নয়, যে দশখানা অন্যদের লেখা কবিতা জোগাড় করে এটার থেকে এক লাইন, সেটার থেকে আধ লাইন নিয়ে গোটা একটা পোস্টমডার্ন মাল নেমে গেল।
উদাহরণ? কেন, নরোত্তমদা’র গতবারের সংখ্যায় লেখা কবিতাটাই তো তাই।
যদিও ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামছে
মফস্বলীয় সান্ধ্য আড্ডায় থেমে গেছে সব গান
মাঝের কাচের দরজা বন্ধ।
একটি উচ্চকণ্ঠ… দুঃসংবাদ পয়দা করে বাতাসে।
ত্রাস শেখায়।
যেন স্বর্গ নেই, সারিডনও নেই।
আমি যেন শিশুকন্যা।
হাত থেকে খসে গেছে ন্যাকড়ার পুতুল
দুধ পোড়ার গন্ধ পাশের বাড়ি থেকে
কে যেন তবুও গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,
ভেদাভেদ জ্ঞান ভোলো, ভয় নেই
আর শোনো পাখি,
চোখ গেল, চোখ গেল গেয়ে অন্ধ হয়েছ
কিন্তু পাখা বন্ধ কোরো না।
রবি ঠাকুরের “যদিও সন্ধ্যা আসিছে”র মাঝে আধুনিক কবিতার একটি একটি লাইন গোঁজা। “ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান” আর “এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা” দিয়ে শেষ।
পদ্য লেখা একরকম। গদ্য লেখা সোজা হওয়া উচিত ছিল। মুদি দোকানের ক্যাশমেমো তো গদ্যেই লেখা হয়। প্রেমপত্র বাদ দিলে অন্য চিঠিপত্র কিম্বা বাড়ির দলিল, সবই গদ্যে।
তা সত্বেও গল্প উপন্যাস অত সোজা ব্যাপার না। প্লট চাই, বিন্যাস চাই। তাই নরোত্তমদা’র এত ছোটাছুটি। কিন্তু ছোটাছুটিই সার। আমাদের জন্য লেখা আর বেরোচ্ছে না।
এদিকে দিন চলে যাচ্ছে। ডিটিপির অবিনাশ বাবু তাড়া দিচ্ছে,
– এর পর পুজোর মুখে চাপ বেড়ে গেলে, তোমাদের কাজ তুলতে পারব না।
এমনিতেই আমাদের কাজটা একটু সস্তায় করে দেয়। অবশ্য ওর একটা কবিতা ছাপতে হয় তার বদলে। কবির নাম অবিনাশ সাঁপুই এর বদলে দিতে হয়, “অবিন্যস্ত স্বপ্ন”।
আমরা নরোত্তমদা’কে তাড়া দিই। এবারের তিনখানা গল্পের মধ্যে দুখানার দায়িত্ব ওর। দায়ও বলা যায়!
এবং শেষ পর্যন্ত, নরোত্তমদা’ গল্প দিল না বলে আমাদের পত্রিকার এই সংখ্যাটা এবারেও ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে ঠাঁই পেল না। আর নরোত্তমদা’ কেমন যেন আমাদের গ্রুপে বেশ অনিয়মিত হয়ে গেল।
রহস্য উদ্ধার হল মাস ছয়েক পরে। দাদার গল্প ছাপা হল এই বাংলার দু দু’খানা নামী পত্রিকায়। একসঙ্গে।
গল্পদুটো হুবহু দিলে কেস খেয়ে যাব। ওই সব হাউসের হাত শুনেছি অনেক লম্বা। কী আশ্চর্য, দুটো কাহিনিই গল্প লেখা নিয়ে। প্রায় আত্মজৈবনিক সন্দেহ করা যেতে পারে।
‘বন কল্লোল’এর গল্পটা এক হবু লেখকের অকাল মৃত্যুর গল্প। তার বাবা ছিল কম্পোজিটর। প্রেস থেকে ফিরে মায়ের কাছে লেখকদের কাজ কারবার, সাহিত্য জগতের লড়াই ধূর্তামির সব গল্প করত। সেই থেকে কী ভাবে সেই বেচারা লেখালেখির বূহে ঢোকার কৌশল শিখে নিয়েছিল, মাতৃগর্ভে থাকতেই।
তারপর সে বড় হল। একদা বাধ্য হয়ে এই ফ্যাসাদের মধ্যে ঢুকল বটে, কিন্তু বেরিয়ে আসার রাস্তা জানত না বলে ওই ব্যূহের ভেতরেই আরও সাতজন মহালেখক আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা ফেসবুকে খাপ বসিয়ে, পত্রিকায় খারাপ রিভিউ লিখে, এমনকি সম্পাদকদের বিগড়ে দিয়ে, তার লেখকসত্বাকে হত্যা করল সবাই মিলে। এই নিয়ে এক অতি করুণ কাহিনি।
স্বদেশ-বিদেশ পত্রিকার গল্পটাও ওই গদ্যলেখা নিয়েই। সম্পাদক তার বড়মামা। লেখক বেচারা গদ্য লিখেছে। চাপে পড়ে। রাত জেগে। খাওয়াদাওয়া শিকেয় তুলে।
প্রথমে পনেরোশ’ শব্দ… গল্প। তারপরে ওইটিকেই সম্পাদকের নির্দেশে দশ হাজার শব্দের উপন্যাসিকা। পরে প্রকাশকের নিষ্ঠুর প্রেরণায় পঞ্চাশ হাজারের এক উপন্যাস। এই সব অত্যাচার সামলাতে গিয়ে তার নায়কের চেয়ে প্রতিনায়ক জোরালো হয়ে গেছে, এমনকি শেষের দিকে নায়ককে গোত্তা মেরে প্রতিনায়ককে বিয়ে করেছে নায়িকা। বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে লেখক।
প্রবল চাপে লেখকের মাথার শিরা ছিঁড়ে প্রায় কোমা। ভেন্টিলেটরে দিতে হবে কী না বোঝা যাচ্ছে না। আচ্ছন্ন অবস্থায় লেখক বিড় বিড় করছে, এক বাঁও মেলে না… দুই বাঁও মেলে না…
দুটি গল্পই আমরা সাহিত্য অনুরাগী তথা সাহিত্য অনুশীলনকারীরা ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে পড়েছি। আমাদের উল্লাস দেখে কে। না হয় আমরা নিজেরা পারিনি, আমাদের কেউ একজন তো পেরেছে।
নরোত্তমদা, এই ছোট শহরেও আমাদের থেকে লুকিয়ে বেড়ায়। লাইব্রেরির খগেন কাকাকে শুধোলাম। তিনি বললেন, – হ্যাঁ, আসে তো প্রায়ই আসে। তোমাদের ঢুকতে দেখলেই আমার অফিসের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়।
অবশেষে একদিন পাকড়াও করলাম ওকে। স্টেশনে চার নম্বর প্লাটফর্মের বেঞ্চে উদাস মুখে বসেছিল। আমরা ওভারব্রিজে উঠে একটা সিগারেট পাঁচজনে টানছিলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে চুপি চুপি গিয়ে ধরলাম।- “ব্যাপারটা কী তোমার। আমাদেরকে লেখা না দিয়ে বড় গাছে নৌকো বেঁধেছ? এই কাজটা ঠিক করলে?”
দাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “তুই সাক্ষী সলিল! কোন মুখে তোদের সামনে যাই বল তো! ত্রিভুবন স্যারই ঠিক বলেছিলেন। লিখতে গিয়ে টের পেলাম, পৃথিবীর সব গল্পই লেখা হয়ে গেছে!”
(পুনঃপ্রকাশিত)