মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের নিয়ে সমস্যা ছিল এক রকম যখন জুনিয়র ডাক্তার ছিলাম। ক্রমে যখন বড়ো হলাম তখন সমস্যার পরিবর্তন হল।
আজকাল অনেক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। কখনও সখনও ভিটামিনের মতো রিপ্রেজেন্টেটিভ এসে একটা গল্প বলে যেগুলো বোঝা কঠিন হয় না। কিন্তু যখন কোম্পানির ডাক্তার আসেন, বা রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, তখন খুব অসুবিধা হয়।
একবার কোনও এক কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ, ধরা যাক তার নাম পরিমল, এসে বলল, “স্যার, আপনি অনুমতি দিলে একটা জিনিস দেখাই।” বলে ব্যাগ থেকে প্রথমে একটা গ্লাস বের করে টেবিলে রাখল। তারপর একটা জলের বোতল বের করে গ্লাসে জল ঢালল। তারপর, সেই ব্যাগ থেকেই বের করল তাদের কোম্পানির একটা ওষুধের পাতা এবং অন্য তিন-চারটে বড়ো বড়ো কোম্পানির সেই ওষুধের পাতা। বলল, “স্যার, এই সব ওষুধগুলো আমি দোকান থেকে কিনে এনেছি। অন্যগুলো তো বটেই, এমনকি আমাদের নিজেদেরটাও। দেখুন কোথাও ফিজিশয়ান’স স্যাম্পেল লেখা নেই। এবার আমি এক এক করে সবকটা জলে ফেলব, আপনি দেখবেন আমাদের ওষুধটা তাড়াতাড়ি গুলে যায়। অন্যদের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি গোলে।”
এই বলে সে পাতা ছিঁড়ে ওষুধ বের করতে যাবে, আমি বাধা দিয়ে বললাম, “থাক, থাক, আমি মেনে নিচ্ছি তোমার ওষুধ ওদের চেয়ে তাড়াতাড়ি গোলে। কিন্তু তাতে কী প্রমাণ হয়?”
প্রবল উৎসাহের সঙ্গে পরিমল বলল, “স্যার, এই হল অকাট্য প্রমাণ যে আমাদের ওষুধই সবচেয়ে ভালো এবং ডিপ্রেশন সব চেয়ে তাড়াতাড়ি সারাবে। সুতরাং দাম একটু বেশি হলেও আমাদেরটাই লিখবেন।”
আমি বললাম, “তোমাদের ওষুধ অন্যদের চেয়ে কত আগে জলে গুলে যায়? দু’মিনিট? তিন মিনিট?”
পরিমল একটু সামান্য লজ্জার হাসি হেসে বলল, “না, অত নয়। পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড মতো।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “তাই, পুরো পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড? তার মানে তোমার ওষুধটা পেটে গেলে ওই অন্যগুলোর চেয়ে পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড আগে গুলে যাবে? নাকি ওগুলোর চেয়ে পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড আগে ডিপ্রেশন সেরে যাবে?”
পরিমল চোখ গোল গোল করে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, “তাই তো বটে স্যর, ডিপ্রেশন তো সারতে সারতেই ছ’ সপ্তাহ সময় লাগবে।”
“কিন্তু তুমি বলছ, তোমার কোম্পানির ওষুধ খেলে পাঁচ সপ্তাহ, ছ’দিন, তেইশ ঘন্টা, ঊনষাট মিনিট, পনের সেকেন্ড পরেই ডিপ্রেশন সারতে শুরু করবে। এবং সেই জন্য ওগুলোর চেয়ে অন্তত ষোলোগুণ দামি তোমার কোম্পানির ওষুধ লিখতে হবে তাই তো?”
বিশাল জিভ কেটে পরিমল যখন গ্লাস, বোতল সব ব্যাগে ঢোকাচ্ছে, আমি তখন বললাম, “তোমার কোম্পানি নিজেদের রিসার্চ অরগানাইজেশন বলে বর্ণনা করে। এই কি গবেষণার ফল?”
আমার একজন শিক্ষককে এই গল্পটা যখন করেছিলাম তখন তিনি বলেছিলেন, “দেখো অনিরুদ্ধ, মাল বিক্রি করার জন্য কোম্পানির লোক বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছুই বলে, কিন্তু আমার গা জ্বলে যায় ওরা যখন আমাদের গাধা মনে করে গাধা বানাবার চেষ্টা করে।”
এটা বোঝা সোজা ছিল। কিন্তু এর পরের দুটো গল্প বড়ো-সাহেবদের নিয়ে। এরা গাধা বানানোয় সিদ্ধহস্ত। এবং অনেক তাবড় ডাক্তারকে বোকা বানিয়ে নিশ্চয়ই স্টুপিড-রত্ন টাইপের খেতাব টেতাব পেয়েছে – এদের সামলান সোজা নয়।
একটা ওষুধ ছিল যেটা একসময়ে এমনভাবে তৈরি হত যাতে দিনে দু’বার খেতে হত। কিন্তু রোগিরা মাঝে মাঝে দু’বার খেতে ভুলে যায় তাই অনেক কোম্পানি দিনে একবার খাওয়া যায় এমন ভাবে একটা দামি তৈরি করে। এই ধরনের ওষুধকে এক্সটেনডেড রিলিজ বলে (এই ওষুধেও সাধারণত ডবল ডোজ একই ট্যাবলেটে থাকে, কিন্তু আগের কাহিনির ডবল-স্ট্রেংথ ওষুধের টেকনোলজি আর এই টেকনোলজি আলাদা)। ট্যাবলেট থেকে ধীরে ধীরে ওষুধ বেরোয়। কিন্তু অসুবিধা হল এই যে তাতে অনেক সময়ে সম্পূর্ণ ট্যাবলেটটা গোলেই না, তার আগেই শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ ২৫% ওষুধ বেশি দিতে হয়। তাতেও আরও খরচ বাড়ে। সেদিন এক বিখ্যাত কোম্পানির রিসার্চ অফিসার এসেছেন। এসে বললেন, “আমাদের এক্সটেন্ডেড রিলিজ ট্যাবলেট আপনি নিশ্চিন্তে কম ডোজই দিতে পারবেন, আমাদের ওষুধ স্পেশাল ‘প্যারাশুট টেকনোলজি’ দিয়ে তৈরি। তার ফলে ট্যাবলেটটা খাদ্যনালীতে যে খাবার থাকে তার ওপর ভাসতে থাকবে। সুতরাং কোনও চিন্তা নেই, সমস্ত ট্যাবলেটটাই পেশেন্টের রক্তে মিশবে, স্যার।”
শুনে চমৎকৃত হয়ে গেলাম। এমন এক আশ্চর্য আবিষ্কার, অথচ আমি জানতামই না? অবশ্য জানার কথাও নয় : কারণ আমি তো ডাক্তারি পড়েছি আর ওষুধ তৈরির কারিকুরি জানা যায় ফার্মাসি পড়লে – যেটা আমাদের সময়ে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অঙ্গ।
কম্পিউটারের যুগ। বাড়ি ফিরে “প্যারাশুট টেকনোলজির” সঙ্গে “ট্যাবলেট” লিখে ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছুই না পেয়ে শেষে আমার পরিচিত কিছু ডাক্তারকে ই-মেল লিখলাম, এই বিষয়ে কি কিছু জানেন? তাঁরা সকলেই লিখলেন এমন অত্যাশ্চর্য কথা তাঁরা কেউই আগে শোনেননি এবং একজন লিখলেন, “অনিরুদ্ধ, তুমি শিগগির এই ভদ্রলোককে বলো, তিনি যেন তাঁর আবিষ্কারের কাগজপত্র আমাকে পাঠিয়ে দেন, এরকম একটা আবিষ্কার মেডিসিন-এ নোবেল প্রাইজ পাবেই পাবে।”
আমি ভালোমানুষের মতো এই সব কটা ই-মেইল সেই সায়েন্টিস্ট ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দিলাম – পাছে হারিয়ে যায়, তাই ওই কোম্পানির বড় সাহেবকেও পাঠালাম। বলা বাহুল্য, কেউ নোবেল পায়নি এখনও, এবং আমিও ওই ভদ্রলোককে আর কোনওদিন দেখিনি। ওঁর এক সহকর্মী বহুদিন পরে আমার কাছে কবুল করেছিলেন যে আমার চিঠির পরে বিজ্ঞানীকে কোম্পানির তরফে বেশ ভালোরকম বকাবকি করা হয়েছিল। আমার কিন্তু এখনো ওঁর ওপর রাগ আছে। আমরা ওষুধ কোম্পানির গবেষকদের ওপর ভরসা করতে না পারলে কার ওপরে করব? রিসার্চ তো আজকাল আর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় না, হয় কর্পোরেট হাউজে।
এইরকম আর একটা অভিজ্ঞতা সেই কোম্পানিরই একজন বড়ো সাহেবের কাছ থেকে, যে কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ আমার কাছে জলের গ্লাস নিয়ে এসেছিল। তিনি সেদিন এসে বললেন, “জানেন, আমাদের ওষুধটা সবচেয়ে বেশি পরিশ্রুত – পিওর – কারণ এই ওষুধ তৈরি করতে গেলে নিউক্লিয়ার ম্যাগ্নেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং মেশিন লাগে, যা ভারতবর্ষে আর কোনও ওষুধ কোম্পানির নেই।” বলা বাহুল্য, এর পরের অব্যক্ত বাক্যটি হল – সুতরাং স্যার, বুঝে নিন, আমাদের ছাড়া অন্য কারো ওষুধ যদি লিখেছেন, তাহলে কী আপনার রোগির হাতে আপনি তুলে দিচ্ছেন, জাস্ট ভেবে দেখুন।
খটকা লাগল। ভদ্রলোক বেরিয়ে যাওয়া মাত্র ইন্টারনেট ঘেঁটে ফেললাম। কিন্তু নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং-এর সঙ্গে ওই ওষুধ তৈরির কোনও সম্পর্ক পেলাম না। ফলে বাধ্য হয়ে প্রশ্ন করলাম আবার একজন এক্সপার্টকে। তিনি চিঠি লিখে জানালেন, যে যন্ত্র দিয়ে ওষুধটা পরিশ্রুত করা হয় তার নাম সিমুলেটেড মুভিং বেড ক্রোমোটোগ্রাফি। নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং-এর সঙ্গে তার কোনও সম্বন্ধ নেই। সেই সঙ্গে ভদ্রলোক এ-ও জানালেন, যে কোম্পানির কর্তা আমাকে এই গল্পটা মেরেছেন সেটা বিখ্যাত বিদেশি কোম্পানি হতেই পারে, কিন্তু একাধিক ভারতীয় কোম্পানির ক্ষমতা আছে ওই ওষুধ তৈরি করার।
সেই কোম্পানির একজন বড়ো সাহেবকে লিখলাম, “ওমুকবাবুকে আমার সঙ্গে দেখা করতে পাঠাবার আগে ভালো করে হোমওয়ার্ক করে আসতে বলবেন, এবং এ-ও বলে দেবেন, যে উনি গপ্পো বললে সে গরু গাছ থেকে নামানোর উপায় আমার জানা আছে।”
তারপর থেকে আমার সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি।