সেদিন আমার কোথায় যেন যাবার কথা। অন্য শহরে, তারপর সেখান থেকে আর একটা কনফারেন্স হয়ে কলকাতায় ফেরা দিন চারেক পর।
খুব ভোর বেলায় আমার ফোনটা বাজল। অরুণ, আমাদের বাহনচালক। বয়স পঁয়তিরিশ ছত্রিশ! – দাদা, বুকে খুব ব্যথা হচ্ছে।
-কার, তোমার বাবার?
-না, আমার।
-নিশ্চয়ই বিরিয়ানী খেয়েছিলে কাল! আর কোনো অসুবিধা আছে?
-না, দাদা!
-ঠিক আছে, আজ তো তোমার এমনিতেও ছুটি, একটা প্যান ফর্টি খেয়ে নাও আর তোমার পাড়ার ওই ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে নাও চেম্বার খুললে। আর আমাকে জানিও ও বেলা।
-আচ্ছা, দাদা।
অরুণ ছেলেটা ভদ্র মার্জিত। ক্রিকেটার শিখর ধাওয়ানের মত দেখতে। মদ সিগারেট খায় না! নেশা বলতে শুধু ওই বিরিয়ানি আর রেডিও মির্চির সানডে সাসপেন্স।
ওবেলা ফোনটা অরুণের কাছ থেকে আর আসে নি।এসেছিল বিখ্যাত কর্ডিওলজিস্ট বন্ধুর কাছ থেকে। আমি তখন দেশের আর এক প্রান্তে।
অরুণের ম্যাসিভ মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হয়েছে, ট্রপ টি, ইকো, এঞ্জিও সব রিপোর্ট গুরুতর। দুখানা আর্টারি ব্লকড, স্টেন্ট বসে গেছে। অরুণ ভাল আছে ।
সকালে পাড়ার ডাক্তারবাবুর সন্দেহ হওয়ায় ইসিজি, ইকো করে গোলমালটা ধরা পড়ে। ওরা সময় নষ্ট না করে সোজা হাসপাতালে চলে যায়, ওর একটা মেডিক্লেম করা ছিল তার ভরসায়!
অরুণ বেঁচে যায়!
যদি ব্যাপারটা একটু অন্য রকম হত? যদি আমার বলা প্যান ফর্টি খাবার পর ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে যেত অরুণ, যদি ওরা হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি করত… যদি… ভাবতেই গা শিউরে ওঠে !
আমি কার্ডিওলজিস্ট নই, মাঝ তিরিশের টগবগে যুবকের এমন হার্ট এট্যাক যে হতে পারে আমার মাথাতেও আসেনি।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক একটি মৃত্যু আর তার পর এক ইএনটি চিকিৎসক এবং তাঁর পরিবারের ওপর নেমে আসা ভয়ঙ্কর আক্রমণের ঘটনা কি ঘটে যেতে পারত আমার ক্ষেত্রেও!
এক অচিকিৎসক বাল্যবন্ধু বললেন, “….একটা বাচ্চা ছেলের একটু বুকের ব্যাথা……একটু এন্টাসিড তো দিতে পারতো……”
উত্তর দিলাম “সব অসুখ যে অ্যান্টাসিডে সারে না রে! আর তারপর ওই পিশাচটা বিষ খাইয়ে মেরে দিলো, এটা শুনতে কিন্তু হতোই!”
আমার স্কুলজীবন জুড়ে, আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল চা-বাগানের ডাক্তার হওয়া। সেই আদর্শবাদী, শিশুসুলভ এবং ‘অবাস্তব’ আকাঙ্ক্ষার পিছনে কারণটি ছিলেন আমার মাতামহ, চা বাগানের এক প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক। তাসাটি চা বাগান থেকে অবসর নেবার পর আবার নতুন করে পরিণত বয়সে নাংডালা চা বাগানে কর্মজীবন শুরু করেন এবং প্রায় আশি বছর বয়স পর্যন্ত ওই অঞ্চলের মানুষের সেবা করে গেছেন। আরো পরে ২০০০ সালে ৯৪ বছর বয়সে শেষ দিন পর্যন্ত ডাক্তারি করেছিলেন জলপাইগুড়ি শহরে! চলে যাবার আগে অবধি ছুটি নেন নি একদিনও!
বছর তিনেক আগে কর্তব্যরত এক প্রবীণ চিকিৎসককে পিটিয়ে খুন করেছিল অসমের জনতা। অভিযোগ, পুলিশের সামনেই জনরোষের শিকার হন জোড়হাটের টিওক হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ দেবেন দত্ত। এক রোগীর মৃত্যুর জেরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বেধড়ক মার খান ডাঃ দত্ত। পরে তাঁকে জোড়হাট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তিনি মারা যান।
সেই ভয়ংকর খবরটা পেয়ে মনে হয়েছিল দাদুকে অন্তত এই দিনটা দেখতে হয় নি !
দাদুর মত আমার ঠাকুর্দাও ছিলেন LMF (Licentiate of Medical Faculty). উত্তর বঙ্গের মফস্বল থেকে এসে একজন পড়তেন কারমাইকেল (বর্তমান আর জি কর) অন্যজন ক্যাম্বেল মেডিক্যাল (বর্তমান এনআরএস) স্কুলে। দুজনেই পরবর্তীতে দায়বদ্ধ এবং শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন নাটোর, রাজশাহী, রংপুর এবং উত্তরবঙ্গের চা বাগানে।দাঁত তোলা থেকে, ডেলিভারি করানো, জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব কিছুতেই তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
এই দুই লম্ফ (LMF পাশ করা ডাক্তারকে সে যুগে তাই বলত) ডাক্তারকে সারাজীবন সম্মানে সম্ভ্রমে মুড়ে দিয়েছিলো সে কালের সমাজ।
যুদ্ধের পরে (আরো নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৪৫ থেকে) এই এলএমএফ ডিগ্রিটি উঠে যায়, শুরু হয় এমবিবিএস। আগের MB বা LMF দের মত এই MBBS রাও আইনত সব রকমের চিকিৎসা করার অধিকার পান এবং আজ অবধি সেই অধিকারে কোন হানি ঘটেনি। এই নিয়ে কোনো বিতর্কের কোনো জায়গাই নেই!
বিতর্কটা হয় তখনই যখন একজন নিজেকে প্রকৃত প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দেন। সেটা অনৈতিক।
কিন্তু একজন এমবিবিএস চিকিৎসক যখন সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সব রকমের জরুরি পরিষেবা দেন, হার্টের রোগীর চিকিৎসা করেন, ডায়াবেটিস রোগীকে সঠিক পরামর্শ দেন, কোভিড অতিমারীতে অমানুষিক পরিশ্রম করেন মাসের পর মাস বা প্রসূতির প্রসবে সহায়তা করেন তখন কোনো প্রশাসক বা বিচারক একবারের জন্যও কৃতজ্ঞতা জানান না!
কোনো মেডিক্যাল কারণ ছাড়াই (গ্রেফতার এড়ানোর কথাটা না হয় এড়িয়েই গেলাম) জেলা থেকে এসে নেতা মন্ত্রীরা হাসপাতালে তারা মার্কা ওয়ার্ডে বেড জবরদখল করে রাখলে প্রশাসক আপত্তি করেন না, কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে কোনো রোগীকে উচ্চতর সংস্থায় পাঠালে চিকিৎসকের গর্দানের হুমকি শোনা যায়! বিচারকের কণ্ঠে শোনা যায় হুমকি, চিকিৎসকের চেম্বারে টাঙিয়ে রাখা উচিৎ তিনি এক চান্সে পাশ করা ডাক্তার কি না! অথচ বিচারকের যোগ্যতা বিচারের প্রস্তাব বোধহয় আদালত অবমাননার আওতায় পড়ে।
হাতুড়ে চিকিৎসক আমাদের দেশের বাস্তবতা, তাঁদের হাতে বা একজন আয়ুষ চিকিৎসকের সব রকমের চেষ্টা ব্যর্থ করে যখন রোগী মারা যান তখন কিন্তু প্রশাসক, কাউন্সিল বা কমিশনের ভ্রূ-বাহু-উত্তোলন আমাদের চোখে পড়ে না!
সব দোষ কেবল মাত্র প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের!
ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইন আসার পর থেকে আজ অবধি গত কয়েক বছরে পুরুলিয়ায়, পাঁশকুড়ায়, ডেবরায়, শিলিগুড়িতে, ভাঙ্গরে, আউশগ্রামে, গোপীবল্লভপুরে, মালদায়, মথুরাপুরে, বোলপুরে, বর্ধমানে, ইসলামপুরে, মুর্শিদাবাদে, রায়গঞ্জে, ভগবানগোলায়, ডায়মন্ডহারবারে, দার্জিলিঙে, হেমতাবাদে এবং আরো বহু-বহু নাম শোনা না শোনা জায়গায় অপমানিত, লাঞ্ছিত, নিগৃহীত,আহত, বিষ্ঠালেপিত, বিধ্বস্ত হয়েছেন অন্তত শ’পাঁচেক চিকিৎসক!
মনে রাখা ভালো, এই করাল করোনাকালে সব ধর্মের উপাসনাগৃহেই তালা ঝুলছিল! খোলা ছিল কেবল হাসপাতাল!
এই বিপদের দিনে পাশে পেয়েছি কোনো ধর্মগুরুকে নয়, রক্ষাকর্তা হিসেবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন আছেন কেবল সাদা পোষাক পরা চিকিৎসক আর চিকিৎসকর্মীদেরই!
অতিমারী থেকে বাঁচানোর প্রতিষেধক এসেছে বিজ্ঞানের গবেষণাগার থেকে, ধর্মস্থান থেকে নয়!
কয়েকটি তথ্য
- দেশ স্বাধীন হওয়ার সত্তর বছর পরে আজও স্বাস্থ্যের অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়।
- প্রতি হাজারে শয্যা সংখ্যা ০.৮।
- স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.২ শতাংশ।
- এই একশ তিরিশ কোটির দেশে প্রতি ১৪৫৬ মানুষ পিছু মাত্র একজন চিকিৎসক!
ফলে যা হবার তাই হয়েছে! দিন ঢলে পড়ে, অথচ প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয় না! ক্ষুধার্ত, বিরক্ত,এবং স্বাভাবিক ভাবেই ক্রুদ্ধ রোগিনী বা তাঁর পরিজন কিন্তু জানতেও পারেন না বন্ধ দরজার ওপারে
চিকিৎসকটির ও খাওয়া হয়নি!
প্রয়োজনের তুলনায় এক পঞ্চমাংশ ডাক্তার থাকবেন অজস্র মানুষের পরিষেবায়, সেটা কি ডাক্তারের দোষে?
মানুষ ডাক্তার না পেয়ে ওঝা, গুণীন, হাতুড়ে করে শেষ অবস্থায়
যাবেন সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে, তার পর মারা যাবেন, এটা কি ডাক্তারবাবুটির দোষ?
হাসপাতালে একজন রোগী ডাক্তারবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় পাবেন গড়ে চল্লিশ সেকেন্ড থেকে মিনিট দেড়েক!
ডাক্তারবাবুর দোষ?
এবং সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৩ টে অবধি আউটডোরে রোগী দেখে যদি ডাক্তারবাবুটি এমার্জেন্সিতে রোগীদেখতে যান বা রাউন্ড দিতে আর তার জন্য যদি রোগী বিক্ষোভ হয়, তার দায়, সেই চিকিৎসকটির ওপর বর্তায় কি?
আমরা কি করেছি?
চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীদের প্রতি সম্মানে প্রদীপ জ্বালিয়েছি, থালা বাটি কাঁসর ঘন্টা বাজিয়েছি,
হেলিকপ্টার থেকে হাসপাতালে পুষ্পবৃষ্টি করেছি,
আবার খুলে রেখেছি অসম্মানের এই সিংহদুয়ার!
আমরা কি একটু ভেবে দেখবো?