ডিসেম্বরের ৬ তারিখ শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের ২৫ বছর পূর্ণ হল।
যে বছরে আমার ডাক্তারি পড়তে ঢোকা সেই ১৯৭৮-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আটা ঘোষণা: ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য। যদিও সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রথম রূপায়িত হয়েছিল তার ৬৬ বছর আগে নরওয়েতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব নেয় ১৯৩৭-এ।
মেডিকেল কলেজে যে ছাত্র সংগঠন করতাম সেই মেডিকেল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন শোষণহীন সমতামূলক এক সমাজের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তার অবস্থায় ড্রাগ একশন ফোরাম পশ্চিমবঙ্গের প্রচারে ওষুধ কোম্পানির শোষণের বিরুদ্ধে ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম। ১৯৮৩ সালে অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশনের যে আন্দোলন স্লোগান তুলেছিল ‘স্বাস্থ্য কোনো ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার’, সেই আন্দোলনের কনিষ্ঠতম সৈনিক ছিলাম। ১৯৮৪-৮৫ তে ভোপালের গ্যাস পীড়িতদের ‘সহি ইলাজ ও সহি জানকারি’-র আন্দোলন ও শেখালো অনেক কিছু।
আমরা যখন ছাত্র ছিলাম আমাদের দুই শিক্ষক হিসেবে মানতাম, আজও মানি, ডাক্তার নর্মান বেথুন এবং ডাক্তার দ্বারকানাথ কোটনিসকে। দুজনেই চীনের মুক্তি সংগ্রামে যুদ্ধক্ষেত্রে সার্জেনের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁদের মতো হতে চেয়ে আমরা অনেকেই সার্জারি শিখতাম। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার মতো মুক্তি সংগ্রাম কোথায়?
মানুষের জীবনকে জানতে ছাত্র অবস্থায় মেডিকেল কলেজ ও আরজি করের এমসিডিএসএ-র ছাত্র-ছাত্রীরা কয়েকজন গড়ে তুলেছিলাম পিপলস হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। কাজ করতাম আমরা বেলেঘাটার চাউলপট্টি রোডের বস্তিতে আর খান্না সিনেমার উল্টোদিকের বস্তিতে। পরে বেলুড়ে।
আমাদের মধ্যে কয়েকজন ডাক্তার হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দিই। আমি ১৯৮৬ সালে যোগ দিই শ্রমিক নেতা শংকর গুহ নিয়োগির নেতৃত্বাধীন ‘ছত্রিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ’ ও ‘ছত্রিশগড় মুক্তি মোর্চা’-র স্বাস্থ্য আন্দোলন ও শহীদ হাসপাতালে।
আমি যোগ দেওয়ার বছর পাঁচেক আগেই অবশ্য ছত্তিশগড়ে শ্রমিক ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কর্মসূচির শুরু এক প্রসূতি সদন তৈরীর লক্ষ্যে এবং সাফাই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। সত্যি কথা বলতে কি এই আন্দোলন শ্রমিকরা শুরু করেছিলেন ডাক্তারদের উপস্থিতি ছাড়াই। পরে তাতে যোগ দেন আমার পূর্বজ ডাক্তার বিনায়ক সেন, ডাক্তার আশিস কুন্ডু, ডাক্তার শৈবাল জানা, ডাক্তার চঞ্চলা সমাজদার। এই কর্মসূচি ছিল মেহনতী মানুষের জন্য মেহনতী মানুষের নিজস্ব কর্মসূচি। একদিকে যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার এক মডেল, পাশাপাশি জনশিক্ষার কর্মসূচি এবং সংগ্রামের হাতিয়ার।
ছত্রিশগড় মুক্তি মোর্চার রাজনীতি ছিল সংঘর্ষ ও নির্মাণের রাজনীতি। ব্যবস্থা বদলে জন্য সংগ্রাম আর সংগ্রাম চলাকালীন ছোট ছোট নির্মাণের কাজ যার মধ্যে দিয়ে স্বপ্নের সমাজের এক একটা টুকরো বাস্তবায়িত করা যায়।
১৯৯৫ এ কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে শুরু হল শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ছত্রিশগড় থেকে আসা কিছু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এই কর্মসূচিতে যোগ দিলেন। ধীরে ধীরে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রকে ঘিরে জড়ো হতে লাগলেন আগের দশকের ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের কর্মীরা। ১৯৯৯-এ তাঁরা গড়ে তুললেন ‘শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ’ নামে এক সংগঠন, জনস্বাস্থ্য কর্মসূচিতে যুক্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সংগঠন।
১। এই সংগঠনের প্রথম লক্ষ্য স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবসায়ীকরণের বিরোধিতা করা। সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্থাৎ ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার এই সংগঠনের লক্ষ্য।
মানুষ যখন সবার জন্য স্বাস্থ্য চায় তখন সরকার বলে, আধুনিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল, সরকারের পক্ষে এই ব্যয় বহন করা সম্ভব না। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ এই বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করার জন্য মডেল ক্লিনিক চালায়। এই ক্লিনিকগুলিতে দেখানো হয় কিভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারে খরচ অনেকটাই কম করা যায়। হিস্ট্রি টেকিং, পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার এবং ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার এর মধ্যে দিয়ে এমনটা করে দেখানো হচ্ছে। শুরুটা হয়েছিল হাওড়া জেলার চেঙ্গাইলে শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, এখন সারা রাজ্যে এরকম দশটিরও বেশি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত আছে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ।
এই সব কটি কেন্দ্র আবার গণতান্ত্রিক পরিচালনারও মডেল, পদাধিকারের কোনো অনুক্রম (হায়ারার্কি) ছাড়া এই কেন্দ্রগুলি পরিচালনা করা হয়, যেমন করা হত শহীদ হাসপাতালে।
সবার জন্য স্বাস্থ্যের প্রচার আন্দোলন গতি পেয়েছে ২০১৩ থেকে। আমরা জানি ২০১০-এ তৎকালীন যোজনা কমিশন সবার জন্য স্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এক উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করে। এই দল তার সুপারিশ পেশ করে ২০১১ সালে। সুপারিশের প্রধান বক্তব্য ছিল স্বাস্থ্য খাতে সরকারকে ব্যয় বাড়াতে হবে। প্রত্যাশিতভাবেই যোজনা কমিশন বা তৎকালীন সরকার এই সুপারিশকে গুরুত্ব দেয়নি। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের প্রয়াসে সারা বাংলায় সবার জন্য স্বাস্থ্যের দাবিকে ছড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে। অনেকগুলি গণসংগঠনকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়, ‘সারা বাংলা সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রচার কমিটি’। জেলায় জেলায় বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অভিযান হয়, গণ কনভেনশন হয়। এমনকি নয়া দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সাইন্স এর ছাত্র সংসদ ও রেসিডেন্ট ডক্টর অ্যাসোসিয়েশনকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ।
২০১৭-এ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার এক নতুন ক্লিনিকাল এস্টাবলিসমেন্ট আইন আনে। সরকার ও শাসক দলের প্ররোচনায় সামনের সারির চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা প্রবলভাবে বেড়ে যায়।
প্রতিবাদী উদ্যোগে গড়ে ওঠে ডাক্তারদের নতুন সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম। শ্রমজীবীর ডাক্তার সদস্যরা অনেকে নতুন সংগঠনের সদস্যতা নেন। অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ডক্টরস ফর ডেমোক্রেসি, হেলথ সার্ভিস এসোসিয়েশন, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম একসঙ্গে মিলে গঠন করে ‘জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল’। শুরুতে ধারণাটা ছিল এরকম: মুখ্যমন্ত্রী কড়া বার্তা দিলেই বুঝি চিকিৎসা কর্মীদের ওপর হিংসার ঘটনা কমে যাবে। শ্রমজীবীর সদস্যরা বোঝাতে থাকেন আসলে সামনের সারির চিকিৎসা কর্মীদের ওপর অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রমণ নামিয়ে আনেন ক্ষুব্ধ রোগীর পরিজন। হাসপাতালে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অনেক কিছু পাওয়া যাবে এই আশা নিয়ে এসে যখন তাঁরা পরিষেবা পান না, তাঁদের ক্ষোভ আছড়ে পড়ে চিকিৎসা কর্মীদের ওপর। তাই রোগীদের স্বাস্থ্যের অধিকার ছাড়া চিকিৎসা কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা সম্ভবপর নয়। ধীরে ধীরে অন্যান্য চিকিৎসক সংগঠনগুলোও ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ারকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে থাকেন।
মানুষকে রোগের অর্থ সামাজিক কারণ সম্পর্কে অবহিত করা এবং রোগ প্রতিরোধ ও রোগ চিকিৎসার সহজ প্রযুক্তিগুলো দিয়ে ক্ষমতায়িত করাও শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের কাজ। এই কাজ করার জন্য সভা, কর্মশালা, প্রকাশনা ছাড়াও নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ২০০০ থেকে ২০১১ অব্দি অসুখ বিসুখ পত্রিকায়, ২০১১ থেকে স্বাস্থ্যের বৃত্তে পত্রিকা প্রকাশনায় যুক্ত আছেন সংগঠনের কর্মীরা। আর পাঁচ বছর হতে চলল স্বাস্থ্যের ওয়েব ম্যাগাজিন www. thedoctorsdialogue.com এর।
যে আর্থসামাজিক কারণগুলো রোগের জন্ম দেয় সেই আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন না হলে মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থার পরিবর্তনও হতে পারে না। তাই ছত্রিশগড়ে শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করা, চেঙ্গাইল ফুলেশ্বরে শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ শুরু করা। সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন অবশ্য দীর্ঘজীবী হয়নি। ‘শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ’ সচেষ্ট থেকেছে মেহনতি মানুষের, জনসাধারণের ন্যায্য আন্দোলনগুলোতে যুক্ত থাকার–সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের আন্দোলন, উড়িষ্যার পস্কো বিরোধী আন্দোলন, লালগড় আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমানে অভয়া আন্দোলন অবধি।
প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে দুর্গত মানুষের পাশে থাকার চেষ্টায় থাকে‘শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ’ । সংগঠনের শুরুর দিনে উড়িষ্যার সুপার সাইক্লোন থেকে শুরু, ২০০০-২০০১-এ রাজ্য ব্যাপী বন্যা, সুনামি, ২০০৯ এর আইলা, ২০২০-র আমপান, ২০২১ এর ইয়াস থেকে নিয়ে এখনো অবধি এই চেষ্টায় ত্রুটি নেই। কেবল দুর্গতদের চিকিৎসা পরিষেবা নয় পাশাপাশি দুর্যোগের সামাজিক কারণগুলো নিয়ে মানুষকে সচেতন করার প্রয়াস থাকে।
জনসংখ্যা পিছু যতজন চিকিৎসক থাকার কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী তার থেকে কম আমাদের দেশে। গরিব মানুষ বিশেষত গ্রামের গরীবেরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণহীন চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। এইসব গ্রামীণ চিকিৎসককে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার পাঠ দেওয়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া বন্ধু সংগঠনগুলোর কর্মীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার এক কর্মসূচি ও চালায় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ।
এই যে কাজগুলোর কথা সংক্ষেপে বললাম সে সবগুলোই কিন্তু চলে দেশী বিদেশী সরকারি বেসরকারি কোন ফান্ডিং ছাড়া।
জনস্বাস্থ্য শিক্ষক ডেভিড ওয়ার্নার বলেছিলেন ‘আউটসাইড ফান্ডিং মিন্স আউটসাইড কন্ট্রোল – বাইরে থেকে টাকা-পয়সা নেওয়া মানে বাইরের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেওয়া।’ তাই, নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে অর্জিত অর্থেই বেশিরভাগ কাজটা চালানো যায়। আর ত্রাণ কাজের মত বড় কাজ বা বড় আন্দোলনে ক্রাউড ফান্ডিং নেওয়া হয়। এই হচ্ছে ‘শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ’-এর কাজকর্মের সারসংক্ষেপ। মানুষের সঙ্গে মিলে মানুষের জন্য করে যাওয়া কাজের অভিজ্ঞতা এই উদ্যোগকে শুধু টিকিয়েই রাখেনি, ক্রমশ সামাজিক, বুদ্ধিগত ও সাংগঠনিক শক্তি অর্জনে সাহায্য করে চলেছে।
অনুষ্টুপ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য লিখিত।
এ ইতিহাস, সংক্ষেপে হলেও, লিপিবদ্ধ করা জরুরী ছিল। এ ইতিহাস স্বাস্থ্য আন্দোলন বা ভাবনার সাথে যুক্ত সবার জানা উচিত।
সামাজিক ব্যবস্থার এমন বিশ্লেষণ এবং করণীয় সম্পর্কে একজন দার্শনিক ডাক্তারের কর্মজীবন আমাকে অভিভূত করেছে। সামাজিক ভাবে এই কাজে আমরা ও পূণ্য ব্রতের সঙ্গী থাকতে চাই।