যাত্রাগাছি, গৌরাঙ্গ নগর, শুলংগুড়ি, এবং সংলগ্ন এলাকা জুড়ে নারী সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধের দাবিতে অভয়া মঞ্চ বৃহত্তর বিধান নগর আয়োজিত গণ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল ৬ ই জুন শুক্রবার শুলংগুড়ি কলোনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।
নতুন দিনের গান গেয়ে অনুষ্ঠানের সুচনা করেন ডঃ তরুণকান্তি কর “আমরা এই বিশ্বের বুকে গড়ব রংমহল/ সৃষ্টির নব মন্ত্রে মোরা করব দিন বদল “
উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর স্থানীয় শিক্ষক তরুণ মুখার্জি বক্তব্য রাখেন। গৌরাঙ্গ নগর অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিবেশের ক্রমঅবনমন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। আবেগপূর্ণ এবং বলিষ্ঠ বক্তৃতায় তিনি বলেন কী ভাবে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়ে টাকা এবং মাদক দ্রব্যের ঢালাও সরবরাহ তরুন প্রজন্মকে বিপথগামী করে তুলেছে। প্রশাসন দুর্নীতি ও বিপথগমনের অন্যতম সহায়। তাই স্বাভাবিক কারণেই নারী এবং শিশু দের নিরাপত্তাহীনতা এই অঞ্চলের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ও শিশু পাচার চক্র এই অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, প্রশাসন সব জেনেও দুষ্কৃতীদের পরিত্রাতার ভুমিকায়। এই দুর্নীতির পাহাড় ভেঙ্গে ফেলে, সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক চাপ, হুমকি ও অন্যায়ের ভ্রূকুটিকে অস্বীকার করে স্থানীয় মানুষকে তিনি অভয়া মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হবার আহবান জানান। এই মঞ্চ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার এক যৌথ মঞ্চ, যা দুর্নীতি সন্ত্রাস আর নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করে চলেছে।
স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মালতী কীর্তনিয়া এই অঞ্চলের নারী সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় মানুষকে এগিয়ে আসতে বলেন। অভয়া মঞ্চকে ধন্যবাদ দেন এলাকার মানুষের এই লড়াই এর পাশে থাকার জন্য।
অভয়া মঞ্চ বৃহত্তর বিধান নগরের অন্যতম আহবায়ক অরিন্দম দাশ তাঁর বক্তব্যে জ্যাংড়া-হাতিয়ারা পঞ্চায়েত এলাকার শুলংগুড়ি, ঘুনী, জ্যোতিনগর, গৌরাঙ্গনগর, জগৎপুর ইত্যাদি অঞ্চলে নারী, বিশেষতঃ কিশোরীদের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তার অভাব এবং অসামাজিক কার্যকলাপের বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আর্থসামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, চাহিদার সঙ্গে সামর্থ্যের অপ্রতুলতার সংঘাত অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের মানসিক গঠনের ওপর প্রভাব ফেলছে। ফল স্বরূপ অপরাধমূলক কাজকর্মের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরী হয়েছে এই অঞ্চল জুড়ে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশী ব্যবস্থার ঘাটতি এই অঞ্চলকে অপরাধীদের অবাধ বিচরণ ভূমিতে পরিণত করেছে। আর জি কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া তরুণী ডাক্তারের খুন ও ধর্ষণের বিচারের দাবীতে সৃষ্টি হওয়া অভয়া মঞ্চের উদ্যোগে গড়ে ওঠা, বৃহত্তর বিধাননগর অভয়া মঞ্চের পক্ষ থেকে তিনি এই অঞ্চলে পুলিশী ব্যবস্থা সক্রিয় করার দাবি জানান। বাগুইহাটি, ইকো পার্ক এবং নিউটাউন – এই তিনটি থানার মধ্যেই সমন্বয়ের অভাব এই অঞ্চলের মানুষকে বারবার বিপন্ন করে তোলে। এই পরিস্থিতিতে মঞ্চের পক্ষ থেকে কয়েকটি নির্দিষ্ট দাবী করেন-
১) বাগুইহাটি থানার জগৎপুর আউটপোষ্টের মত ইকো পার্ক এবং নিউটাউন থানার একটি করে পুলিশ আউটপোষ্ট এই অঞ্চলে গঠন করতে হবে।
২) তিনটি থানা বা তিনটি ফাঁড়ির সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট পুলিস আধিকারিককে দিতে হবে।
৩) এই অঞ্চলের জন্য একটি কার্যকরী পুলিশ হেল্পলাইন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।
৪) অঞ্চলে আরো বেশী পুলিশ পেট্রলিং, সিসি টিভি এবং আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই ব্যাপারে পঞ্চায়েতকেও যথোপযুক্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
৫) সব ক্ষেত্রে অপরাধীদের চিহ্নিত এবং গ্রেপ্তার করতে হবে। অঞ্চলে নিখোঁজ বালিকাদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে মা, বাবা, পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
তিনি অভিভাবকদের কাছে আবেদন জানান উপযুক্ত বয়সের প্রতিটি ছেলেমেয়ে যেন নিয়মিত স্কুলে যায়। অবক্ষয়ের এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে সংবেদনশীল আচরণ এবং খোলা মনে কথাবার্তার মাধ্যমে, বিপদ এবং তার থেকে বাঁচার পথ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা দিতে পারেন মা, বাবা এবং শিক্ষকরাই। সুতরাং বাড়িতে এবং বিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে সুরক্ষার পাঠ দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার।
অভয়া মঞ্চের আহবায়ক ডঃ পুণ্যব্রত গুণ বলেন শুধু একজন অভয়ার বিচারের জন্যে অভয়া মঞ্চ গঠিত হয়নি। অভয়ার বিচার আমরা ছিনিয়ে আনবোই, সেই সঙ্গে নারী সুরক্ষার জন্যে আমাদের লড়াই চলবে যত দিন না পর্যন্ত সব অভয়ারা বিচার পায়, যত দিন না পর্যন্ত অভয়া হবার সামাজিক অবস্থা বদলায়।
ডঃ তমোনাশ ভট্টাচার্য এই অঞ্চলে জন বসতি গড়ে ওঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব সম্পদ রক্ষা করার জন্য এলাকার মানুষ ও অভয়া মঞ্চকে লড়াই চালিয়ে যেতে বলেন।
সমগ্র অনুষ্ঠানটিতে সঞ্চালক এবং সুত্রধর হিসেবে অসামান্য ভুমিকা পালন করেন সুতনুকা বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর বলিষ্ঠ পরিশীলিত কণ্ঠ এবং গভীর সুচিন্তিত সংযোজন অনুষ্ঠানটিতে অন্য মাত্রা এনে দেয়।
দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে ওপার বাংলার ছিন্নমূল মানুষ এবং বাস্তুহারা ভূমিপুত্রদের ঐক্যবদ্ধ, কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই অঞ্চলে বসতি গড়ে উঠেছিল। এই কনভেনশন সেই গৌরবময় সংগ্রামের উত্তরসূরীদের এবং অভয়া মঞ্চের যোদ্ধাদের উন্নততর সমাজ গঠনের লড়াইতে শামিল হবার আহ্বান জানায়।










