(সিকিমে যে বিধংসী বন্যা ও পাহাড়ী ধ্বস হয়ে গেল সেই সময় সপরিবারে সিকিমে বেড়াতে গিয়েছিলেন ডা দয়ালবন্ধু মজুমদার। আসুন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনি।)
এবার সিকিম বেড়াতে যাওয়ার সব কিছুই ছেলে মেয়ে ঠিক করেছিল। যাওয়ার দিন তিনেক আগেও আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার যাওয়া হবে কি না। শেষ পর্যন্ত আমার দুই সহকর্মী রাজী হওয়ায় আমিও দুদিন ছুটির সাথে দুদিন অন্যকে ডিউটি করতে বলে, চললাম। শনিবার বিকেলে বেরোনোর সময়ও কলকাতার আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। বাড়ী থেকে বেরিয়ে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত যেতে পাঁচ মিনিট সময় লাগে; সেটাই ছাতা ছাড়া যাওয়া যাবে কি না সন্দেহ ছিল। যাই হোক, ঐ পাঁচ মিনিট সময়ই পেয়ে গেলাম। ধর্মতলায় পৌঁছে গেলাম বাস ছাড়ার প্রায় এক ঘন্টা আগে। এই প্রথম আমরা বাসে শুয়ে শিলিগুড়ি গেলাম। ব্যবস্থাটা আমার কাছে খুব একটা সুখকর হবে না, বুঝতেই পারছিলাম।
বাস যাত্রা বেশ ভয়ংকর। যতোই ভালো বাস হোক, এ বাংলার রাস্তার যা অবস্থা তাতে করে ঝাঁকুনি খেতে খেতে তের -চোদ্দ ঘন্টা যাওয়া অসহ্য। এর থেকে রেলের জেনারেল কামরায় সারা রাত বসে যাওয়া আরামের হবে মনে হয়। সকালে ডালখোলায় নেমে চা খাওয়ার পর বাস চলতে শুরু করতেই আমার বমি হয়ে গেল। শিলিগুড়িতে নেমে একটা হোটেলের ঘর নিয়ে সকলে স্নান করে পাহাড়ে রওনা দেব ভেবেছিলাম, সে রকম হোটেল পাওয়া গেল না। শুধু মুখ হাত ধুয়ে, প্রাতরাশ করে নিলাম একটা হোটেলে। এরপর গাড়িতে চললাম সিলেরীগাঁও। শিলিগুড়ি থেকে ঘন্টা চারেক। তিন ঘন্টার মত চলার পর এল কালিম্পং শহর।
এর আগে কোনদিন কালিম্পং শহরে যাইনি। ড্রাইভারকে বললাম, কোথাও দাঁড়িয়ে চা খেয়ে যাই। কিন্তু এত ঘিঞ্জি শহর গাড়ী পার্কিং-এর জায়গা পাওয়া গেল না। আরও মিনিট পনের এগিয়ে একটি ছোট দোকানে দাঁড়ানো গেল। এক কাপ করে কফি খেয়ে আবার চলা। কিন্তু ঐ টুকু সময়েই ওদের পোষা কুকুরদুটি আমাদের খুব কাছের হয়ে গেল। সিলেরীগাঁও পৌঁছতে দেড়টা বেজে গেল। পাকা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এবড়ো খেবড়ো পাথুরে রাস্তা।
সিলেরীগাঁও ছোট্ট একটা গ্রাম। হোমস্টের সামনের দিকে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। ওদের পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার কথা, কিন্তু আকাশে মেঘ থাকায় আমরা দেখতে পাই নি। দূরে সবুজ পাহাড়ের ওপর দুটি শহর দেখা গেল, দূরের শহরটি গ্যাংটক। এ ছাড়া একটা পাহাড়ের মাথায় একটা ফুটবল মাঠের মত খোলা জায়গা; ওটা সিকিমের একমাত্র বিমান ওঠা নামার জায়গা। সারাদিনে একটা বিমানও দেখিনি।
পরদিন সকালে বৃষ্টি বন্ধ হলেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেল না। ঠিক আটটায় ড্রাইভার এসে গেলেও গাড়ী হোম স্টে পর্যন্ত আনতে পারল না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে একশ ফুট দূরে গাড়ীতে উঠতে হল। এবার সেই পাথুরে রাস্তা দিয়ে ফিরে চললাম। এবার আর কালিম্পং শহরে না গিয়ে উল্টো দিকে চলল গাড়ী। মাইল চারেক যাওয়ার পর পেডং নামে একটা ছোট শহরে দাঁড়ানো হল। কিছু জেরক্স করা হল। এখানে বলে রাখি, সিকিমের বহু জায়গায় যেতে হলে পার্মিট লাগে। এজন্য ভোটার কার্ড লাগবে, আধার কার্ড দিয়ে হবে না।
পাহাড়ের পাকদণ্ডি রাস্তা দিয়ে এবার একটু একটু করে নেমে চললাম। উল্টো দিকের সবুজ পাহাড়ের নানান দৃশ্য দেখা গেল। একটা জায়গা থেকে উল্টো দিকের পাহাড়ে একটা সোনালী মন্দিরের চুড়া দেখিয়ে ড্রাইভার বলল, ঐ মন্দিরের সামনে দিয়ে যাব। নামতে নামতে একেবারে ঋষি খোলা নদীর কাছে চলে এলাম। এখানে সিকিমে ঢোকার চেক পোষ্ট। কিছু সময় দাঁড়াতে হল। নদীর সেতুর ওপর উঠে দেখলাম দুদিক থেকে দুটি নদী এসে কেমন করে ঋষি নদী তৈরী হয়েছে। নদী পেরিয়ে আবার পাহাড়ী রাস্তায় ওঠা শুরু হল। মিনিট কুড়ি পরে পৌছালাম সেই সোনালী মন্দিরের সামনে। বিশ্ব বিনায়ক মন্দির। গণেশের মন্দির। নতুন মন্দির। অনেক রকমের গণেশ মূর্তি দিয়ে সাজানো।
আরও আধ ঘণ্টা পর এল রংলি শহর। বেশ ঘিঞ্জি বাজার এলাকায় গাড়ী পার্কিং এর সমস্যা। কোন রকমে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, পারমিটের কিছু কপি প্রিন্ট করা হল। আরও মিনিট কুড়ি পরে একটা সুন্দর ঝর্নার কাছে দাঁড়িয়ে কিছু ফোটো তোলা হল। এর পর ক্রমশ পাহাড়ী রাস্তায় উঠে চলা। তখনও বেশ ঝক ঝকে রোদ। এক জায়গা থেকে অনেক উপরে মেঘে ঢাকা পাহাড় দেখিয়ে ড্রাইভার বলল, জুলুক্-এর আবহাওয়া ঐ রকম হবে। একে একে নিমাচেন, পদম চেন পেরিয়ে উঠে চললাম। জুলুকে ওঠার কয়েক মাইল আগে শুরু হল লোয়ার জিগজ্যাগ, পাকদন্ডি । ড্রাইভার জানাল এই লোয়ার জিগজ্যাগে অনেক গাছ আছে, তাই অক্সিজেন কম পড়ে না। কিন্তু আপার জিগজ্যাগে গাছ না থাকায় কারো কারো শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমাদের কারো কোন সময় কোন অসুবিধা হয় নি। বেলা দেড়টা নাগাদ জুলুক্ পৌছালাম, তখন বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের হোটেলের সামনে যে সবুজ পাহাড় সেটা প্রায় মেঘে ঢাকা। পরদিন সকাল পর্যন্ত একটু একটু বৃষ্টি পড়ে চলল।
ক্রমশ…