করোনার দিনগুলো কেটে গেলে আমাদের জীবনে কী কী পরিবর্তন হতে পারে?
ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়ার যৌথ দাপটের যুগে এই আমাদের প্রথম অতিমারী। কাজেই, পূর্ববর্তী অতিমারীর তুলনায় এই দফা মৃত্যুসংখ্যা কম হোক বা বেশী, সামাজিক অভিঘাত গভীর হবে, নিঃসন্দেহে। এই অতিমারী মোকাবিলা করতে জীবনে যেসব পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে, বিপদ কেটে যাওয়া মাত্র তার ছাপ মুহূর্তে হাপিশ হয়ে যাবে, এমন তো নয়।
অতএব, আমাদের যাপনে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তার দাগ রয়ে যাবে – এমনটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু, ঠিক কী সেই দাগ?
এদেশে নয় – মার্কিন দেশে তিরিশ-পঁয়ত্রিশজন সমাজবিজ্ঞানী-অর্থনীতিবিদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল – জানতে চাওয়া হয়েছিল পূর্বাভাস। স্বভাবতই, বিভিন্ন মানুষ বিষয়টা দেখেছেন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে – পূর্বাভাসও তদনুযায়ী।
যেমন ধরুন, একজন বলেছেন, এই কোভিড উনিশ আমাদের দাঁড় করিয়ে দিল কঠোর বাস্তবের সামনে। দেখিয়ে দিল, আসল বিপদের মুহূর্তে আসল হিরো কারা – হ্যাঁ, আমাদের আসল হিরো ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা – যাঁরা বিপদের মুহূর্তে নিজেদের সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েও, মৃত্যুর সম্ভাবনা মাথায় রেখেও আমাদের নিরাপদ রাখতে লড়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত।
আমরা হয়ত বুঝতে শিখব, বীরত্বের অর্থ শুধু উড়োজাহাজে করে বোমা ফেলে শত্রুপক্ষের কিছু মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া নয় – আসল বীরত্ব, নিজের নিরাপত্তার চাইতে অপরের জীবন সুরক্ষিত রাখাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মতো দায়বদ্ধতা।
আশা করি, এই বিপর্যয় কাটলে মার্কিন জনগণ বুঝতে শিখবেন, আমাদের আসল নিরাপত্তা ঠিক কারা দিয়ে থাকেন। সামগ্রিক সমাজের মানসিকতার গভীরে গেঁথে থাকা যে মিলিটারাইজেশন, এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে, হয়ত সমাজ বুঝবে তার অন্তঃসারশূন্যতা।
আমরা যেদিন আমাদের সত্যিকারের হিরোদের চিনতে শিখব, সামগ্রিকভাবে সমাজের চিন্তাভাবনার ধরণটাই বদলে যাবে।
এ তো গেল ওদেশের কথা। কিন্তু এদেশ??
রোববার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর আবেদন মেনে অনেকেই থালা-কাঁসর-শাঁখ বাজিয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন – হ্যাঁ, ধরে নেওয়া যাক, এমন সমবেত বাদ্যির মুহূর্তে সবাই সেই কৃতজ্ঞতার কথা-ই ভাবছিলেন (যে কয়েকজন জ্যোতিষগণনার হিসেবের ‘পরে ভরসা করে, ওই বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ শব্দতরঙ্গ দিয়ে ভাইরাস নিকেশে বিশ্বাস রাখছিলেন, তাঁদের কথা আপাতত না হয় বাদই রাখলাম) – আর, আমরা, যাঁরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাথে যুক্ত আছি – সঙ্কটের মুহূর্তে আগুয়ান মানুষগুলোর উদ্দেশে কাঁসরঘণ্টা বাজানোই সেরা পথ কিনা, সে বিষয়ে কিছু সংশয় থাকলেও – হ্যাঁ, আমরা সেই কৃতজ্ঞতা-ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। সত্যিই খুশী হয়েছিলাম।
মুখ্যমন্ত্রী যখন বললেন, আমাদের অনেক কিছুর শর্টেজ আছে – মাস্ক-স্যানিটাইজার ইত্যাদি – আমরা চেষ্টা করছি তৈরী করতে – তাড়াতাড়ি তৈরী করতে – আর তৈরী হলে সবার আগে দেওয়া হবে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের – কেননা, সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে লড়াইটা চালাচ্ছেন তাঁরাই – বিশ্বাস করুন, খুব খুউব ভালো লেগেছিল।
ভেবেছিলাম, সত্যিই এত মানুষ আমাদের ভালোবেসেছেন!! না, আমরা ভগবান তো নই-ই, সুপারম্যানও নই। সামগ্রিক লকডাউনের বাজারে আমাদেরও বিস্তর ঝামেলা হয় হাসপাতাল পৌঁছাতে – বাড়ি ফিরে পরিজনের সাথে ঠিক কী আচরণ করা উচিত ভেবে পাই না – হাজারবার হাত ধুয়েও, বয়স্ক বাবা-মায়ের সাথে কথা বলি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে – কথা না শুনে বাচ্চা গায়ের ওপর চলে এলে বিরক্ত হই – ওয়েদার চেঞ্জের বাজারে একটু গা-ম্যাজম্যাজ কি দুবার হাঁচি হলে কেমন একটা দুশ্চিন্তা হয়।
তবু, সেদিন মনে হচ্ছিল, নাঃ, এমন করে গোটা দেশ ভালোবাসা জানাচ্ছেন, এমন করে সব নেতানেত্রীরা আমাদের কথা বলছেন – রোজকার গালাগালি সয়ে কাজ করে যাওয়ার মধ্যে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা – সত্যিই নজিরবিহীন!! আর, এই পেশায় যুক্ত আছি বলে খুব খুউব গর্ব হচ্ছিল।
অবশ্য, আমাদের বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনছিলেন আরো কঠোর চিন্তাশীল বাস্তববাদীরা। বিচক্ষণ সেই মানুষেরা জানাচ্ছিলেন – ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা তো থ্যাঙ্কলেস জব করেন না – তাঁরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করেন। তাহলে আলাদা করে কৃতজ্ঞতা জানানোর মানে কী!! আমাদের কাজের মাসি, দুধওয়ালা – তাঁরাও তো কাজ করে থাকেন – আমরা তো এমন করে তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানানোর কথা ভাবি না!! তাহলে?? শুধুই স্বাস্থ্যকর্মী-ডাক্তারদের গুরুত্ব বা সম্মান দেওয়ার ভাবনা এলিটিজম। অতএব…
তাঁরা বিচক্ষণ মানুষ। আমার চাইতে মনোজগতের অনেক গভীরে তাঁদের বিচরণ। তাঁদের কেউ সিনেমা বানান, তো কেউ কবিতা লেখেন বা গান। স্বাস্থ্যকর্মীদের সবাই যে এলিট নন – অনেকে নেহাতই অন্ত্যজ, যাকে বলে দরিদ্র ভারতবাসী, যাঁকে কে একজন কবেই যেন ভাই বলে ডাকার আবেদন জানিয়েছিলেন – সেকথা তাঁরা জানেন না, এ আমার বিশ্বাস হয় না। হয়ত তাঁদের বাড়িতে যাঁরা কাজ করেন, রোজ দুধ বা খবরের কাগজ দেন – সেসব নিশ্চয়ই খুব ঝুঁকির কাজ – আমরাই জানতে পারি না।
মারাত্মক সংক্রামক এক ব্যধির সামনাসামনি মোকাবিলা করার ঝুঁকি – বিশেষত যখন সংক্রমণ প্রতিরোধের অস্ত্র অমিল – এত বড় চিন্তাশীল মানুষ তাঁরা – সে বিষয়েও তাঁরা নিশ্চয়ই সম্যক ওয়াকিবহাল।
হ্যাঁ, এসব তাঁরা অবশ্যই জানেন, কেননা, তাঁরা ঘরের মধ্যে দরজা আটকে ব্যাপক বোর হচ্ছেন এবং সেই বোরডোম-সঞ্জাত সৃষ্টিশীলতার ফুলিঝুরি ছেটাচ্ছেন – সেই আলো ফুটে উঠছে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে – একদম সেই মুহূর্তে, যখন আমরা লকডাউনের মধ্যে সময়মত হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যাপারে চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি। সেই মুহূর্তে – যখন যে পরিবারের দুজনেই স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাথে যুক্ত, আমরা ভেবে পাচ্ছিনা, বাচ্চাটাকে কার কাছে রেখে যাওয়া যায় – ড্রাইভার আসতে পারবেন না, বাচ্চার দেখভালের মাসিও না, ইশকুল বা ক্রেশ দুইই বন্ধ, এদিকে আমাদের পক্ষে এইমুহূর্তে ছুটি নেওয়ার কথা ভাবাও অনুচিত – বেশ কিছু হাসপাতালেই যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত করা যায়নি বলে আটঘণ্টার ডিউটি শিফট বদলে দেওয়া হয়েছে বারো ঘণ্টায়, এবং অনেকক্ষেত্রে আট ঘণ্টার শিফট দাঁড়াচ্ছে দশ ঘণ্টায়, পরিবর্ধিত বারো ঘণ্টার শিফট চোদ্দ ঘণ্টায়, কেননা পরের শিফটের লোক এসে পৌঁছাতে পারছেন না – ডিউটির সময় খাওয়ার ব্যবস্থা কী, জানা নেই – লম্বা শিফটের শেষে বাড়ি ফিরে খাওয়ার বন্দোবস্ত কী, জানা নেই – রান্নার মাসিও নেই, হাসপাতালের ক্যান্টিন বন্ধ, বাজারের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম – বাকি বড় বড় ঝুঁকি বা দুশ্চিন্তা বা বিপদের কথাগুলো না হয় বাদই দিলাম আপাতত – বিচক্ষণ মানুষেরা আমাদের প্রতি সবার আবেগ-কৃতজ্ঞতার বাড়াবাড়ি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছেন।
বিচক্ষণ ব্যক্তিরা দূরদর্শী। তাঁরা অনেক আগেই ভবিষ্যতটা দেখতে পান।
তাঁরা আজ যা বোঝেন, বাকিদের প্রকাশ হয় একটু দেরীতে। খুব বেশী দেরী নয় – জাস্ট অল্প দেরীতেই।
অতএব, জানা গেল, চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের যাঁরা বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন, তাঁরা নোটিশ দিয়েছেন অবিলম্বে বাড়ি খালি করে দিতে। ওলা-উবের-এর চালকরা হাসপাতালের আশপাশ থেকে বুকিং এলেই ক্যানসেল করছেন – উবের এমার্জেন্সি বলে একটা সার্ভিস থাকলেও হাসপাতাল এলাকায় সবসময়ই “নো ক্যাব” দেখা যাচ্ছে। এমনকি, চিকিৎসক-নার্সদের গাড়ির চালকদেরও অনেকে এখন তো আসছেনই না – পরবর্তীতে কাজ ছাড়ার কথা বলছেন।
অতএব, জানা গেল, যাঁরা দল বেঁধে কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে, মদের দোকানে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে, বাজারে ধাক্কাধাক্কি করে সোশ্যাল ডিস্টান্সিং-এর পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন – তাঁরা আসল “ডিস্ট্যান্সিং” মেইনটেইন করছেন চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে – এমনকি, সেই পরিবারের শিশুদের সাথেও।
অতএব, সঙ্কট মিটে গেলে, মার্কিন দেশে চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়তি সম্ভ্রম মিলবে কিনা জানা নেই – এদেশের বার্তা স্পষ্ট।
যাক গে, বাড়তি কিছু প্রত্যাশা করি না – আমাদ্রর কাজ লাথিঝাঁটার পরেও আমরা করেই চলব – শুধু, এরপর যেন বলতে আসবেন না, ডাক্তারগুলো একেবারে সমাজবিমুখ – আর বড্ডো আত্মকেন্দ্রিক – ওরা বাকিদের কথা ভাবতেই শেখে নি!!!
দারুন এবং সময়োপযোগী।
ভীষণ ভালো লাগলো। ওপেন ফোরামে শেয়ার করতে পারি কি?
দরকারি লেখা।
আজকাল বোধহয় “তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?” – এই বিশ্বাস বড্ড বেশী ক্লিশে!
তবে একটাই কথা বলবো “সামূহিকতা” শব্দটি বোধহয় ক্লিশে হয় না!