Skip to content
Facebook Twitter Google-plus Youtube Microphone
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Menu
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Swasthyer Britte Archive
Search
Generic filters
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Search
Generic filters

নিভৃতকথন পর্ব ১৩

WhatsApp Image 2024-04-29 at 9.21.02 AM (1)
Dr. Sukanya Bandopadhyay

Dr. Sukanya Bandopadhyay

Medical Officer, Immuno-Hematology and Blood Bank, MCH
My Other Posts
  • May 5, 2024
  • 8:47 am
  • No Comments

নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের সময় বলে কিছু হয়না— সকল সুখের রসনাবিলাসের মধ্যেই অল্পবিস্তর দুঃখকষ্টের ফোড়ন থাকে, থাকতেই হয়। নয়ত বড় পানসে হয়ে যায় জীবনের স্বাদ।

বালানন্দ হাসপাতালে আমার চাকরির দিনগুলো অবিমিশ্র সুখের ছিল না ঠিকই, তবে আনন্দ আর নিরানন্দের একটা স্বস্তিকর সামঞ্জস্য ছিল।

আমার আর মিসিসিপির ছাদের ঘরে আসবাব বলতে ছিল দুটো অনাড়ম্বর লোহার খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, আলনা, জলের ফিল্টার, গোটা দুই কাঠের টেবিল, চেয়ার আর একটা পুরোনো ছোট সাদা কালো টিভি, যেটা আমরা আমাদের মেডিক্যাল ডিরেকটর ডঃ অনুতোষ দত্তের কাছে আবদার করে করে আদায় করে নিয়েছিলাম। ও হ্যাঁ, একটা ইন্টারকমও ছিল ঘরে — সেটায় যেমন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতো, তেমনি প্রয়োজন পড়লে বাড়িতেও ফোন করা যেতো — দিনের বেলায় মেন অফিসে নম্বর চেয়ে, আর রাতে, আইসিইউতে ফোন করে। হাসপাতালের টেলিফোনের মূল লাইন এই দু’ জায়গাতেই ছিল কেবল।

গরমের সময় ঐ ছাদের ঘর এতটাই তেতে উঠত, যে, দুপুরবেলা থাকাই যেত না। মিসি সকালবেলা আউটডোর করে, ওটি সামলে, ইভনিং রাউন্ড দিয়ে, একেবারে বিকেলবেলা, রোদ পড়ে যাবার পরে ঘরে ফিরত।

আউটডোরের পরে, আমার ওয়ার্ডে কাজ থাকত কিছু — যে বাচ্চারা ভর্তি হলো, তাদের স্যালাইন বা রক্ত দেওয়া, ওষুধের ডিরেকশন দেওয়া, প্রেসক্রিপশন করার কাজ। সেসব হয়ে যাওয়ার পরে একমাত্র ইমার্জেন্সি সিজার হলে, বা কোনো ভর্তি থাকা শিশুর হঠাৎ অবস্থার অবনতি হলে, আমার ডাক পড়ত — যাকে বলে অন কল। নয়ত অখন্ড অবসর।

ওই তপ্ত টিনের কৌটোর মতো ঘরে ফিরে দুদন্ড বিশ্রাম নেওয়ার কথা চিন্তাই করা যেত না বছরের অধিকাংশ সময়টায়। আমি তাই আড্ডা দিতে যেতাম আইসিইউতে, ওখানে এসির ঠান্ডা খাবো বলে। আইসিইউ মেডিক্যাল অফিসারদের মধ্যে বেশিরভাগ দিনই যার ডিউটি থাকত, সেই দেবাশিস ছিল আমার ভীষণ বন্ধু — আমারই কলেজের প্রাক্তনী।

“হাই সুকু! এসে গেছিস! চা খাবি? মমতা সিস্টার দারুণ চা বানায়”!

“এক্ষুণি ভাত খেয়ে এলাম, এখনই চা খাবো কি রে!”

বালানন্দের খাওয়া অত্যন্ত ঘরোয়া, ভাল — ন্যাশনালের হোস্টেলের ভাতের থালার দুঃস্বপ্ন এখানে তাড়া করে ফিরতো না আমায়।

“তুই দু’মিনিট বোস, আমি আইসিইউ এইটের একটা ইসিজি করেই আসছি।”

আমি সেদিনের খবরের কাগজ নিয়ে গা এলিয়ে দিতাম ডক্টর্স রেস্ট রুমের বিছানায়।

কানে আসত বাইরে বিভিন্ন বেডের মনিটরের সম্মিলিত সিমফনি।

সুদূর কল্পনাতেও কি ভাবতে পেরেছিলাম তখন, যে অনেক অনেক বছর পরে, এই বালানন্দের আইসিইউ ফাটিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠব আমি — আর ওই আইসিইউ এইটের বিছানায় শোয়া মাকে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিতে দিতে চিৎকার করে ডেকে যাবে দেবু —“মাসীমা, শুনতে পাচ্ছেন, আমি দেবাশিস — মাসীমা—-”

হেপাটাইটিস বি থেকে ভুগে ওঠার ফলে আমার লিভার অত্যন্ত কমজোরি হয়ে গিয়েছিল। আর তেমনি বেড়ে গিয়েছিল হাবিজাবি খাওয়ার শখ।

এই আলুচিপস চিবোচ্ছি, তার পরেই কফির সঙ্গে চানাচুর আনাচ্ছি লিফটম্যান দাদাকে দিয়ে — আবার, খানিক বাদেই গরম গরম বেগুনি খাবার জন্য নোলা শকশক করে উঠছে!

মিসি কতবার ছিনিয়ে নিয়েছে চিপসের প্যাকেট, কিন্তু সবসময়ই তো আর ওকে সাক্ষী রেখে খেতাম না আমি।
একদিন মাঝরাতে অসহ্য বমি আর পেটের যন্ত্রণায়, ডেকে তুলতেই হলো ওকে।

মিসিসিপি যেহেতু চোখের ডিপার্টমেন্টের আরএমও ছিল, মেন বিল্ডিংএর অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট, যেমন মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক, গাইনি বা আইসিইউএর ডাক্তারদের সঙ্গে ওর চেনাশোনা বা যোগাযোগ ছিল না খুব একটা। কারণ আই ব্লক অন্য একটি বিল্ডিংএ, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত ছিল।

তবে দেবাশিসের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথা ওর অজানা ছিল না, আর তাই ও সোজাসুজি ফোন করেছিল আইসিইউতে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন দেবুরই নাইট ডিউটি ছিল।

তারপর, ড্রিপ, সিফরান, মেট্রোজিল, র‍্যানটাক, অনডেম, ডিকোলিক — আরএমও-দের জন্য বরাদ্দ ডিলাক্স কেবিন — সে এক এলাহি ব্যাপার। প্রায় সারা রাত আমার দুই বন্ধু আমার মাথার কাছে জেগে কাটিয়েছিল!

অসুখ বোধহয় সবসময় খারাপ নয়। কারণ, আমাকে শুশ্রূষার ফাঁকে ফাঁকেই কখন যেন মিসি আর দেবুর সম্পর্কের সমীকরণটা বদলে গেল। ভাগ্যিস পেটরোগা আমি চানাচুর আর আলুচিপস সাঁটিয়েছিলাম — ভাগ্যিস!

আমার স্যারকে সার্জিক্যাল কেসে অ্যাসিস্ট করতে যাওয়া অনিয়মিত হতে হতে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল একসময়। তার জন্য অবশ্য স্যার দায়ী নন।

“উনি ডাকলেন, আর তুমি নাচতে নাচতে চললে?”— মিসির বলার ধরণ বরাবরই এমন।

“বাঃ, কেসে অ্যাসিস্ট করতে ডাকলে, যাব না?”

“তোমার যদি একটুও সেলফ রেসপেক্ট থাকে, যাবে না!” — মিসি আমার সব কথাই জানতো।

“তুই তো জানিস, না গেলে আমার কষ্ট হয়। কেমন যেন অবসেসড হয়ে গেছি আমি –”

“অবসেসনটা কাটিয়ে ফেলো সুকু — remember, everyone is responsible for the consequences of his or her choice –”

বালানন্দ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রাণপুরুষ ছিলেন ডঃ ডি কে সাহা। অজাতশত্রু, রোগীদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় মানুষটি সম্পর্কে ডঃ অনুতোষ দত্ত আমাকে বলেছিলেন—“ভগবান দেখেছ? মাটির ভগবান? ঐ দিলীপ সাহাকে দেখো!”

এ হেন ডঃ সাহার বেশিরভাগ রোগীই আসতো নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে।

একটি ছেলে, বছর দশেক বয়স — ভর্তি হয়েছিল নিউমোনিয়া নিয়ে। সে যখন সেরে ওঠার পথে, একদিন সন্ধের রাউন্ডের মধ্যেই গল্প করছিলাম তার সঙ্গে।

“কাল তোর ছুটি, জানিস তো?”

“হ্যাঁআআআ—“, সোৎসাহে ঘাড় হেলায় ছেলে —

“বড় ডাক্তারবাবু বলেছে—”

“কত্তদিন পরে বাড়ি যাবি, খুব আনন্দ না, তোর?”—

ব্যস্ত অভ্যস্ত হাতে ডিসচার্জ লিখতে লিখতে বলি আমি —“বাড়ি যেন কোথায় তোর?”

“ছোট মোল্লাখালি গো”—

আমার কলম থেমে যায়। অ্যাডমিশন টিকিটে লেখা ঠিকানা মিলিয়ে নিয়ে, দু’চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল মাখিয়ে তাকাই ওর দিকে —“তাই তো! ছোট মোল্লাখালি মানে সুন্দরবন তো রে?”

“হিঁ গো, বাদা—“, বিশদে বলে ছেলে।

আমার কৌতূহল সপ্তমে ওঠে —“অনেক ভেতরে তোদের গ্রাম? বাঘ আসে ওখানে?”

সব দাঁত বেরিয়ে পড়ে তার —“হিঁ — কতোবার এসছে—”

“তুই দেখেছিস বাঘ? নিজের চোখে?” — উত্তেজনায় গলা কেঁপে যায় আমার।

“হিঁ গো”— গলায় মুরুব্বিয়ানা ফোটে ছেলের, যেন আমা হেন অর্বাচীনকে তার নিত্যদিনের দোসরের গল্প শোনাচ্ছে —“সেই যে বারে নদী সাঁতরে আল্যো — আমার জ্বর বলে বের হয়েন্যিকো — বাবা, জ্যেঠারা রোপার জন্য ক্ষেতে গ্যাল্যো — খুব আছাড়ি পটকা ফাটাল্যো সবাই! আমি দোরের আড়াল থেক্যে দেখলাম গো, বাঘ মাথা নিচু করে যায় — আর চোখের কোণ্যে টেরিয়ে দেখতে দেখতে যায় — এই এমনি করে—”

তাকে মাথা নিচু করে ঘাড় বাঁকিয়ে পলায়নরত বাঘের দৃষ্টির অবিকল অনুকরণ করতে দেখে সমবেত সিস্টাররা হেসে ফেললেও, আমি হাসতে পারিনি সেদিন।

ওই প্রত্যন্ত গাঁয়ের অখ্যাত ছেলেটা আমাকে যেন আমার ভুলে যাওয়া কবেকার ছাইচাপা ধুলোমাখা একটা স্বপ্নের কথা মনে করিয়ে দিল।

খুকু, লেবার সাবের আদরের ‘বাপি’— তোর কোথায় যেন যাবার কথা ছিল? কোন গাঁয়ে, কোন অভাগাদের দেশে? যেখানে না আছে কোনো সুষ্ঠু চিকিৎসা ব্যবস্থা, না আছে কোনো পাশ করা ডাক্তার! তোর কোথায় যেন যাবার কথা ছিল!

অ্যাডভার্টাইজমেন্টটা যে বাবা-মা দু’জনেরই চোখে পড়েছে সেটা বুঝতে পারলাম, যখন এক শনিবার বাড়ি গিয়ে, পূরণ করা ফর্মটা বাবার হাতে দিয়ে যখন বললাম —“পোস্ট করে দিও” — তখন ব্রাউন খামটার দিকে একঝলক তাকিয়েই বাবা বলেছিল —“হেলথ সার্ভিসের জন্য অ্যাপ্লাই করেই দিলি তাহলে?”

“হ্যাঁ বাবা, পরীক্ষাটা তো দিই —”

“কম্পিটিটিভ পরীক্ষা কিন্তু খুকু, একটু হলেও প্রিপারেশন নিস” —

মায়ের গলায় গ্রামের চাকরির নামে দু’বছর আগের শ্লেষ একেবারেই উধাও —“রিটেন আছে, ক্লিয়ার করলে তারপর ইন্টারভিউ আছে — যেমন তেমন করে পড়ে গেলে চলবে না কিন্তু।”

মানুষ পরিস্থিতির চাপে পড়ে কতই না আপস করতে শেখে। দরকার পড়লে নিজেকে পুরোপুরি ভেঙে, নতুন করে গড়ে — এক্বেবারে নতুন করে।

বাড়ি তৈরির কাজ তখন জোর কদমে চলছে। এই চার ভ্যান সিমেন্টের বস্তা এলো, তো খানিক পরেই সাদা বালির লরি এসে হর্ন বাজাচ্ছে —

ইঁট ফুরিয়েছে বলে কি রাজমিস্ত্রিরা বসে থাকবে? কন্ট্রাকটরের তড়পানিতে, অফিস ভুলে বাবা ছুটল সাপ্লায়ারের কাছে।

লাল সিমেন্টের মেঝের বদলে, মোজেকের মেঝের শখ ছিল মায়ের, আর বাথরুমে মার্বেল — দামটা বড্ড বেশি পড়ে যাচ্ছে! তা-ও ম্যানেজ করে নিতে হবে, বাড়ি তো মানুষ বারবার তৈরি করে না — একবারই করে।

আজ স্যানিটরি ফিটিংস কিনতে কলেজ স্ট্রিট ছুটছে, তো কাল ইলেকট্রিকের মালপত্র আনতে চাঁদনির বাজার — বাবা যেন দিশেহারা হয়ে পড়ছিল তখন।

অথচ আমি মুহূর্তের জন্যও বাবার পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করিনি। ভাবখানা এমন ছিল আমার, যে তোমাদের দ্বিতীয় সন্তানকে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো সাজাচ্ছ গোজাচ্ছ, বড় করছ, সেখানে আমার কি-ই বা বলার থাকতে পারে?

কাজের কথা হতো, যদি একটা দু-কামরার ফ্ল্যাট কিনে নেওয়া যেতো কোথাও। বাবার শরীর বাঁচত, টাকাও। কিন্তু অবিমৃষ্যকারী আমার সঙ্গে কেউ কি আলোচনা করেছিল? এই ধরনের বৈষয়িক ব্যাপারে বাস্তব পরামর্শ দেবার যোগ্যতা আছে কি না আমার — সে বিষয়েই তো ঘোর সংশয়ী ছিল ওরা।

যে মেয়ে সাতাশ আঠাশ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের ভবিষ্যৎ, কেরিয়ার ইত্যাদি নিয়ে একটা সঠিক পদক্ষেপই করে উঠতে পারেনি, সে কি না বাপ-মাকে পরামর্শ দেবে? তা-ও এত গুরুতর ব্যাপারে? অবিশ্বাস্য!

তাই অসহায় চোখে বাবার একটু একটু করে নিজেকে ক্ষইয়ে ফেলা দেখতাম — বোঝাতে গেলে, দুজনের কাছেই শুনতে হতো বকুনি।

“আমার কিস্যু হবে না—”

বাবা বলতো, “তুই এইসব জমি বাড়ি, ঘর দোরের ব্যাপারে কতটুকু বুঝিস? আমার বাড়ি — মাথার সঙ্গে সঙ্গে গা-ও তো আমাকেই ঘামাতে হবে!”

লক্ষ্য করতাম, ‘আমার বাড়ি’ কথাটা উচ্চারণ করার সময়, আমার বেচারা বাবার গলা থেকে হিরের কুচির মতো অহঙ্কার ঝরে পড়ত। এক পিছনের সারিতে পড়ে থাকা, বিস্মৃতপ্রায় রাজার, জীবনের শেষ যুদ্ধটা জেতার পরাক্রমী আস্ফালন থাকত সেই উচ্চারণে।

মা শুধু পরিশীলিত গলায় বলত আমায় —“তুমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দুশ্চিন্তামুক্ত করো কেবল। বাড়ির ভাবনা, আমাদের দু’জনের ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না।”

এদের আত্মঘাতী আত্মতৃপ্তির ফাঁকি আমাকে ব্যাকুল করে তুলত, অজানিতের আশঙ্কায়। আমি যে জানতাম, ওদের দুজনেরই কোনো মেডিক্যাল ইনশিয়োরেন্স নেই — নেই কোনো পেনশনও।

হেলথ সার্ভিসের লিখিত পরীক্ষাটা যেমন তেমন করে হয়ে গেল। ইন্টারভিউও।

গ্রামাঞ্চলে প্রসূতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা আর যথাসম্ভব কম উপচারে সাধারণ সার্জারি, এই ধরনের কিছু গতানুগতিক প্রশ্নের পরে আকস্মিক প্রশ্ন ধেয়ে এসেছিল —“ফেউ কি জাতের জানোয়ার, জানো?”

হতচকিত ভাব কাটিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম —“ফেউ তো জানোয়ার নয় স্যার। বাঘ দেখলে, মুখে ওরকম অদ্ভুত শব্দ করে শেয়াল বাঘের পিছু পিছু ফেরে। তাই ফেউয়ের ডাক শুনলে আশপাশের গ্রামের লোক বুঝতে পারে, কাছাকাছি বাঘ আছে।”

প্রশ্নকর্তার ভুরুর ভাঁজ মিলিয়ে গিয়েছিল। মুখে ফুটেছিল সন্তুষ্টির রেখা। আমি আরো একবার নীরবে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম আমার বই পড়ার অভ্যাসকে। জয় বুদ্ধদেব গুহ!

শুধু একটাই প্রশ্ন খচখচ করছিল মনের ভিতর! চাকরিটা যদি হয়, পোস্টিংটা কি জঙ্গলে হবে? সুন্দরবন? প্রশ্নকর্তার ইঙ্গিত তো সেদিকেই ছিল।

পরীক্ষা, ইন্টারভিউএর ঝামেলা মিটতে মিটতেই হইহই করে এসে পড়ল সর্বজনীন দুর্গাপুজো। ‘শারদোৎসব’ তখন ঝুলি উপুড় করেনি সর্বসাধারণের জন্য। শরৎকালীন আনন্দ বলতে আমজনতা তখন নির্ভেজাল দুর্গাপুজোই বুঝত — কোনো কার্নিভ্যাল বুঝত না।

পুজোয় বাবার ছুটি তিনদিন। সপ্তমীর ডিউটি শেষ করে আমারও তাই।

অষ্টমীর দিন দুপুরে মায়ের রান্না করা মাংসভাত খেয়ে বেলাবেলি আমরা তিনজন মোড়ের মাথা থেকে একখানা ফাঁকা সাতাত্তর নম্বর বাস ধরে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।

ধর্মতলায় নেমে ফের চৌত্রিশের সি ধরে শ্যামবাজার। তারপর হাতেটানা রিকশায় বাগবাজারের ঠাকুর দেখে ফেরা। জগৎ মুখার্জি পার্ক, শ্যাম স্কোয়ার, হাতিবাগান পায়ে হেঁটে দেখার সময়ই কানে এলো ভিড়ের গুঞ্জন — এবার এশিয়ান পেন্টস শারদ সম্মান জিতেছে চালতাবাগান লোহাপট্টি। অতএব ছোট্, ছোট্ — অটো ধরে সেখানে। কি ভিড় কি ভিড়! সন্ধে নেমে গেছে। জমকালো চালচিত্তিরে একচালার সাবেক ঠাকুর দেখে মন ভরে গেলে কি হবে, মা যে আর হাঁটতে পারছে না! পথচলতি অস্থায়ী ‘ফুড প্লাজা’-র বেঞ্চিতে বসে মোগলাই ভক্ষণ করে, প্রচুর যুদ্ধ করে একখানা ট্যাকসি ধরে ধর্মতলা আসা গেল।

তারপর ফের সাতাত্তর নম্বর। টার্মিনাস বলে ফাঁকা। তিনজনেই বসতে পেলাম বলে আমার অপার্থিব আনন্দ!

পাড়ায় ফিরে, বাবা গেল প্যান্ডেলে — প্রতিবেশী কাকুদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে। মা আমার হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে, বাবাকে হেঁকে বলল —“ফেরার সময় রুটি নিয়ে এসো। কালকের সয়াবিনের তরকারি আছে, তাই দিয়ে হয়ে যাবে আজ। রান্না করছি না আর কিছু—”

“মিষ্টি আছে? না আনতে হবে?”

“পান্তুয়া এনেছিলে যে কাল – আছে ক’টা। আজ আর এনো না। একেবারে দশুমীর সকালে বিজয়ার মিষ্টি আনবে।”

এই ঠাকুর দেখাই আমার মা আর বাবা, দুজনের হাত ধরে শেষ একসঙ্গে ঠাকুর দেখা।

তাই আজও, ন্যাপথালিন দেওয়া পুরোনো পশমের মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি মোলায়েম মুহূর্তগুলো — বড় ভঙ্গুর, বড় দামী যে।

এখনো পেরিয়ে যাই মোড়ের মাথা, ধর্মতলা, বাগবাজার, জগৎ মুখার্জি পার্ক — চোখে পড়ে শ্যাম স্কোয়ারের নতুন রং করা গেট, লোহাপট্টির কর্মব্যস্ততা, হাতিবাগানের ভিড় — শুধু হারিয়ে গিয়েছে সাতাত্তর নম্বর বাস — আমার বাবার মতো।

একদিন হাসপাতালের জুনিয়রদের মুখে খবর পেলাম, হেলথ সার্ভিসের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে — টালিগঞ্জ রেলব্রিজের কাছে পিএসসি ভবনে লিস্ট ঝুলিয়ে দিয়েছে নাকি।

আমি আর মিসি যে যার আউটডোর শেষ করে, দুরুদুরু বুকে টালিগঞ্জ ফাঁড়ির অটোতে চেপে বসলাম।
সারা রাস্তা একটাও কথা বলিনি দুজনে।

পিএসসি ভবনের একতলায় তখন খুব ভিড়। দেওয়ালে সাঁটানো নামের তালিকায় আরো একবার নিজেকে খুঁজে

পেলাম আমি। ফার্স্ট লিস্টেই।

বাইরে বেরিয়ে মিসি প্রথম কথা বলল —“এই চাকরিটার তোমার অসম্ভব প্রয়োজন ছিল সুকু।”

মিসির জন্য মনটা একটু ভার ছিল আমার। কারণ, তখনো তো জানি না যে আর কয়েক মাস পরেই বেরোবে পরের লিস্ট, আর তাতে ওর নাম থাকবে প্রথম দিকেই।

হাসপাতালের অফিস থেকে বাবা-মাকে ফোন করে খবরটা দিয়েছিলাম ওখান থেকে ফিরেই। বাবার সেদিন জ্বর হয়েছিল বলে অফিস যায়নি — খবরটা শুনে কিছু উচ্চবাচ্য করল না বাবা। অবশ্য চিরকালই বাবার উচ্ছ্বাসের প্রকাশ একটু কম।

মা কিন্তু বাঁধনছাড়া খুশি হয়েছিল সেদিন। শুধু ফোনের ওপারের অনাবিল আনন্দের তোড়ের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তার কাঁটা খচখচ করে বিঁধছিল মাকে, সেটা বুঝেছিলাম আমি —“হ্যাঁ রে, চাকরি তো হলো। কোথায় পোস্টিং, সেটা জানা যাবে না এখন, না রে?”

“এক্ষুণি কি করে বলব মা? মাস কয়েকের মধ্যে পোস্টিংএর চিঠিও এসে যাবে নিশ্চয়।”

“আচ্ছা, কাছাকাছিও তো হতে পারে, পারে না? কত হাসপাতাল আছে” —

আমি হেসে ফেলেছিলাম মায়ের ছেলেমানুষিতে —“এই চাকরিতে রুরাল পোস্টিং হবে মা। কাছাকাছি গ্রাম কোথায়?”

“কেন? এই তো ডায়মন্ডহারবার, ক্যানিং, আরো কি কি সব—”

আমার আদ্যন্ত শহুরে মায়ের দুর্বল গ্রামীণ ভৌগোলিক জ্ঞানে আর কুলোলো না। খুব মায়া হলো আমার, মায়ের জন্য।

“ডায়মন্ড হারবার রুরাল পোস্টিং নয় মা। ক্যানিং অবশ্য তাই — কিন্তু, ইন্টারভিউতেই তো বলে দিয়েছিল, হোম ডিস্ট্রিক্ট হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।”

“ও”—কেমন নিভে গিয়েছিল মায়ের গলা।

আমার চাকরিপ্রাপ্তির খবরে ডক্টর অনুতোষ দত্ত কিন্তু একটুও খুশি হলেন না। বেশ রাগত গলায় বললেন —
“এখানে কি অসুবিধে হচ্ছিল শুনি? যাও, গ্রামে যাও, মজা টের পাবে। সরকার তো ঠিক সময়ে মাইনে টাইনে কিছুই দেবে না, গ্রামের লোক চিকিৎসা টিকিৎসা করিয়ে ক্ষেতের কুমড়ো, পটল, ঢ্যাঁড়শ, মুলো এইসব দিয়ে যাবে — তাই রেঁধে খেতে হবে! বুঝবে ঠেলা!”

গাইনির ডাক্তার রঞ্জিত বিশ্বাস, আমার খুব প্রিয় রঞ্জিতদা মিষ্টি হেসে বললেন — “গাঁয়ে কিন্তু বেশির ভাগই গাইনি আর লেবার পেশেন্ট। কিস্যু তো জানো না, অন্তত নর্মাল ডেলিভারি আর এপিসিওটমি সেলাইটা একটু ঝালিয়ে নিও আমাদের কাছে। নয়ত মুশকিলে পড়বে ভাই।”

সেই শুনে আমার শুকনো মুখ দেখে গাইনির আরএমও বিনয় অভয় দিল —“অত ভেবো না তো। আমি জানি, হেলথ সেন্টারে সব ডেলিভারি সিস্টার দিদিরা করান, তোমাকে হাতই দিতে হবে না — গণ্ডগোলের কেস দেখলে স্রেফ দু’লাইন লিখে ডিসট্রিক্ট বা সাব ডিভিশনে রেফার করে দেবে! ব্যস, ঝামেলা ফিনিশ!”

শুনে আমি হাসলাম বটে, কিন্তু দুশ্চিন্তাটা রয়েই গেল। ও’রকম বেড়াল পার করার মতো পেশেন্টের দায়িত্ব ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলা যায় নাকি! ইশ, হাতে কলমে গাইনেকলজি বিষয়টা শিখতে কেন যে এত অনীহা ছিল আমার! এখন কে শেখাবে আমাকে হাতে ধরে? কে?

পোস্টিংয়ের জায়গার জন্য অপেক্ষা আর উৎকন্ঠার সমাপ্তি ঘটল কিছুদিনের মধ্যেই।

একদিন নার্সারীতে একটা সদ্যোজাতকে চেক আপ করছিলাম, গাইনির এক জুনিয়র আরএমও আমাকে দেখে বলে উঠল —“আরে সুকন্যাদি, কাল একটা কাজে রাইটার্সে গেছিলাম। তোমাদের পোস্টিংএর অর্ডার বেরিয়ে গেছে তো। টাঙিয়ে দিয়েছে দেখলাম।”

আমার গলার কাছে টেনশন দলা পাকাচ্ছে তখন। প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম —“কোথায় হয়েছে, দেখলে ভাই?”

“দেখেছিলাম গো, বিলকুল ভুলে মেরে দিয়েছি। দাঁড়াও দাঁড়াও, ডিসট্রিক্টটা মনে আছে — সাম দিনাজপুর! নর্থ বেঙ্গলে!”

সাম দিনাজপুর! দিনাজপুর বলতে তো পশ্চিম দিনাজপুর — ঐ নামটাই ভাসা ভাসা জানতাম বলে মনে হলো। উত্তরবঙ্গের জেলা মানে তো দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, মালদা — আর কি কি যেন? নিজের অজ্ঞতায় বুকটা একেবারে দমে গেল আমার।

কোনোমতে স্নান খাওয়া সেরে, একটা ট্যাকসি নিয়ে ছুটলাম রাইটার্স। এবার একাই। মিসি একটা অপারেশনে ব্যস্ত ছিল তখন। দেবুর নাইট অফ। মড়ার মত ঘুমোচ্ছে নির্ঘাত বাড়িতে। ডেকে তোলবার সাধ্য নেই মাসীমার, জানতাম।

রাইটার্সের ধূলিমলিন অনালোকিত করিডোরে দেওয়ালে টাঙানো অর্ডারে মোট চুরাশিজনের পোস্টিং ডিটেলস দেওয়া আছে। সেই তালিকার মাঝামাঝি আবিষ্কার করলাম নিজেকে।

১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের পিএসসি পরীক্ষায়, মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মেয়ে, ডাক্তার সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পোস্টিং হলো উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালে। আগামী পনেরো দিনের মধ্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে ডাক্তার বন্দ্যোপাধ্যায়কে, রায়গঞ্জে, উত্তর দিনাজপুর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের অফিসে কাজে যোগদান করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

“পশ্চিম দিনাজপুর তো জানি। সেই হিসেবে একটা পূর্ব দিনাজপুর হতে পারে। আবার উত্তর দক্ষিণ দিনাজপুর কোথ্থেকে এলো রে বাবা!”—- আমার স্বগতোক্তি রাইটার্স বিল্ডিংএর কোনো বাচাল কর্মচারীর কানে গিয়েছিল সম্ভবত। একটু বাদে দুজনের খ্যাঁকখেকে হাসি শুনতে পেলাম —“পশ্চিমটা যে ভাগ হইয়া দুইটা জ্যালা হইসে, উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুর, হেইডাও এয়ারা জানে না — গ্রামে সার্ভিস করনের লগে যাইতাসে! কি দিনকাল পড়সে — হ্যাঃহ্যাঃহ্যাঃ —”

মালদারও উত্তরে, বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা এই অল্পচর্চিত জেলাটি আমার সীমিত জ্ঞানে তার ঝাপসা উপস্থিতি আর আবছা ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে আমাকে যুগপৎ আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ করতে লাগল।

আমার চিরকঠিন মা পর্যন্ত পোস্টিংএর জায়গার নাম শুনে স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাকুল গলায় বলে উঠেছিল,”উত্তর দি-না-জপুর! সে কোথায়? মালদা থেকে আরও দু’ঘন্টার পথ শুনছি! সে তো অনেক দূর, খুকু!”

আমি অবাক হয়েছিলাম। “দূর তো কি হয়েছে মা? তোমরাও তো থাকবে আমার সঙ্গে!”

মা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলেছিল —“তোর বাবা চাকরিটা ছাড়বে না রে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এত কষ্ট করে বাড়ি করালো, থাকবে না সেই বাড়িতে? আর তোর বাবাকে এই বয়সে একা ফেলে আমি যেতে পারি তোর সঙ্গে, বল? আমরা তো মাঝে মাঝেই যাবো তোর কাছে। তুইও আসবি এখানে। এমনিতেও তো তুই হোস্টেল লাইফ থেকেই বাড়িছাড়া, এখনো তো সেই শনি রোববারেই বাড়ি আসিস—”

মায়ের কথাগুলো কি সেভাবে আঘাত করেছিল আমাকে? না তো! চিরকালের স্বপ্নজীবী সুকন্যার চোখে তখন অন্য এক অনাস্বাদিত জগতের হাতছানি —

একটা ছিমছাম ছোটো একতলা কোয়ার্টার, তার জাফরি কাটা খুপরি জানলায় ফুলছাপা পর্দা, লোহার সিঙ্গল খাটে টানটান করে পাতা জয়পুরি চাদর, একফালি রান্নাঘরের কোণে জলের কলসি আর কেরোসিনের স্টোভের পাশে বেতের টুকরিতে গুছিয়ে রাখা অল্প শাক সবজি —

সেই কোয়ার্টারের সামনে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা মস্ত ঘোড়ানিম গাছ, আর তার নিচে, গায়ে কমলা রঙের শাল জড়িয়ে, কাঁচা রোদ্দুর ছড়ানো ভোরবেলায়, নরম ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটছি আমি, আমার ফেটে যাওয়া গোড়ালিতে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে ভোরের শিশির —

স্যারকে খবরটা সামনাসামনি জানানোই মনস্থ করলাম। পাঠকপাড়ায়, হাসপাতালের সামনে থেকে অটো ধরে কালীঘাট মেট্রো। সেখান থেকে শ্যামবাজার। স্যারের চেম্বার।

যেতে যেতে মনে পড়ল, স্যারের সঙ্গেই আমার প্রথম মেট্রোয় ওঠা। ভয়ে কিছুতেই পা রাখতে পারছি না এসক্যালেটরে। স্যার হাসছেন হাহা করে —“নে, আমার হাত ধরে ওঠ। একেবারে পারফেক্ট গাঁইয়া অ্যাসিস্টান্ট আমার —”

কলকাতায় রাস্তা পেরোতে ভয় পেতাম — ওরেব্বাবা, কত গাড়ি! চাপা পড়ি যদি! স্যার চিনিয়ে দিয়েছিলেন মেট্রোর সিঁড়ি — কোনদিক দিয়ে পাতাল থেকে উপরে উঠলে পেরোতে হবে না ব্যস্ত রাজপথ।

সেদিন কিন্তু একাই পেরিয়ে গিয়েছিলাম ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ।

খবরটা শুনে স্যারের মুখে তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটল না, শুধু একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে।
“সেই জয়েন্ট এন্ট্রান্সে চান্স পাওয়ার পর থেকে এই প্রথম একটা ভাল ঘটনা ঘটল তোর জীবনে” — আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন তিনি।

আমি তীক্ষ্ণভাবে চেয়ে ছিলাম স্যারের মুখের দিকে। আমার সমস্ত একাগ্রতা আমার দু’চোখের মণিতে জড়ো করে খুঁটিয়ে দেখছিলাম আমার ঈশ্বরকে।

আচ্ছা, স্যার কি আমাকে একটুও ভালবাসেননি কখনো?

উত্তর পেলাম নিজেরই কাছে। হ্যাঁ, ভালবেসেছিলেন বৈকি — যে ভাবে ঊর্বর জমি ভালবাসে তার ফসলকে, যে ভাবে কবি/সাহিত্যিক ভালবাসে তার নবতম সৃষ্টিকে, যে ভাবে দার্শনিক ভালবাসে তার আইডিয়াকে, সে ভাবেই তাঁর অনুগত ছাত্রীকে ভালবেসেছেন তিনি — সেই ছাত্রীর সাফল্য বা ব্যর্থতাতেই শেষ হয়ে গিয়েছে অর্থহীন আবেগের পরিচ্ছেদ।

চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম। এবার ফিরতে হবে আমায়।

“আমার ওপর তোর খুব রাগ হয়, না রে?”

“রাগ?”—

কৃত্রিম বিস্ময়ে ভুরু বাঁকিয়ে তাকাই —“কি যে বলেন স্যার? রাগ তো তার ওপরই করা যায়, যার ওপর সামান্যতম অধিকারবোধ থাকে। তা ছাড়া, রাগ করবই বা কেন? এ তো আমার প্রাপ্যই ছিল। Everybody is responsible for the consequences of his or her choice — বৌদিকে বলবেন, আমি উত্তরবঙ্গ চললাম। মাসীমাকে আমার প্রণাম জানাবেন। আসি।”

স্যারের অবাক চোখের উপরে চেম্বারের কাঠের দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম আমি।

যবনিকা পতনের কোনো শব্দ হয় না। পর্দা নামার সঙ্গে সঙ্গে একটা গুরুভারও যেন নেমে যায় মন থেকে।

(ক্রমশ)

PrevPreviousদিনহাটা, তমলুক ও অন্যান্য
Nextপাউন্ড ফর পাউন্ডNext
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত পোস্ট

সুন্দরবন ও নিবারণদের বারমাস্যা

October 31, 2025 1 Comment

এবার নিবারণরা এসেছিল পাড়ার কালী পুজোয় তাদের চড়বড়ি তাসা পার্টি নিয়ে সেই ‘সোদরবন’ থেকে। দলে ওরা মোট পাঁচজন – নিবারণ, নিরাপদ, নিখিল, নিরঞ্জন আর নিরাপদর

সরকার মানুষের স্বার্থে আমাদের দাবিগুলো পূরণের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ দ্রুত নিক।

October 31, 2025 No Comments

২৬ অক্টোবর, ২০২৫ আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, আর জি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের নৃশংস খুন ও ধর্ষণের প্রেক্ষিতে এবং লাগাতার আন্দোলনের চাপে নবান্ন

এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম!!!

October 31, 2025 2 Comments

২০০২ এর ইলেক্টোরাল লিস্টে নাম না থাকলে নানা নথি সহ #SIR এ আবেদন করতে হবে। ২০০২ সালে আমি বিদেশে ছিলাম, সুতরাং নাম থাকবে না এটাই

প্রতিবাদের এক বছরে অভয়া মঞ্চ

October 30, 2025 No Comments

কাশিতে নয় কাশির ওষুধ

October 30, 2025 No Comments

২৭ অক্টোবর ২৯২৫ রাত ৮টায় আলোচিত।

সাম্প্রতিক পোস্ট

সুন্দরবন ও নিবারণদের বারমাস্যা

Somnath Mukhopadhyay October 31, 2025

সরকার মানুষের স্বার্থে আমাদের দাবিগুলো পূরণের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ দ্রুত নিক।

West Bengal Junior Doctors Front October 31, 2025

এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম!!!

Dr. Arjun Dasgupta October 31, 2025

প্রতিবাদের এক বছরে অভয়া মঞ্চ

Abhaya Mancha October 30, 2025

কাশিতে নয় কাশির ওষুধ

Doctors' Dialogue October 30, 2025

An Initiative of Swasthyer Britto society

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

Contact Us

Editorial Committee:
Dr. Punyabrata Gun
Dr. Jayanta Das
Dr. Chinmay Nath
Dr. Indranil Saha
Dr. Aindril Bhowmik
Executive Editor: Piyali Dey Biswas

Address: 

Shramajibi Swasthya Udyog
HA 44, Salt Lake, Sector-3, Kolkata-700097

Leave an audio message

নীচে Justori র মাধ্যমে আমাদের সদস্য হন  – নিজে বলুন আপনার প্রশ্ন, মতামত – সরাসরি উত্তর পান ডাক্তারের কাছ থেকে

Total Visitor

586287
Share on facebook
Share on google
Share on twitter
Share on linkedin

Copyright © 2019 by Doctors’ Dialogue

wpDiscuz

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

[wppb-register]