এক ফেসবুক বন্ধুর অনুরোধে কিছু সাধারণ পরামর্শ:-
(১) পৃথিবীতে আজ অবধি মর্ডান মেডিসিনের কোনো ওষুধ বের হয়নি যা সম্পূর্ণভাবে অবাঞ্ছিত, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত ও নিরাপদ। সহনীয় মাত্রার মধ্যে থাকলে তবে সেই ওষুধকে বাজারজাত করার ছাড় পত্র পাওয়া যায়। তাই নির্ভয়ে সেই ওষুধ ব্যবহার করুন।
(২) নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া একটি অতি বদ অভ্যাস। এর সাথে যুক্ত করুন ওষুধের দোকানদার, বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনদের পরামর্শে ওষুধ। এটা আমাদের দেশে প্রচলিত তার কারণ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ পাওয়া যায় আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। এই বদ অভ্যাস ত্যাগ করুন। নিজের ইচ্ছেয় ভিটামিনও কিনে খাবেন না। বেশি ভিটামিন খেলেও বিপদ আছে। Vit A বেশি খেলে চুল পড়ে যাবে।
(৩) ডাক্তার যতদিন বলেছে, ততদিন ওষুধ খান, কমও নয়, বেশিও নয়। আগে একবার অসুবিধার সময় অমুক ওষুধ কাজে দিয়েছিল বলে এবারো সেই অসুবিধে দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই একই ওষুধ খেয়ে দেখি এই জাতীয় অভ্যেস ত্যাগ করুন। অসুবিধে এক মনে হলেও দুটো রোগ সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে। কোমরে ব্যথা হাড়ের রোগেও হয় আবার স্ত্রী রোগেও। আগের বারে জ্বর হয়েছিল আপনি ডিসপিরিন খেয়ে কমিয়েছিলেন। এবারের জ্বরে সেটা চালাতে গেলে বিপদ হতে পারে কারণ এবারের জ্বরটা ডেঙ্গু।
(৪) সামান্য রোগ বলে ডাক্তারের পরার্মশ ছাড়াই নিজে নিজের বা প্রিয়জনের চিকিৎসা করতে যাবেন না। পেটে ব্যথার উপসর্গ সাপের কামড় থেকেও হতে পারে। তাই “সামান্য পেটে ব্যথা” বলে কিছু হয় না। পয়সা, সময় বা পরিশ্রম বাঁচানোর জন্য পেশাদারদের পরামর্শ এড়িয়ে গেলে আখেরে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি।
(৫) তাই যদ্দুর সম্ভব, পেশাদারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খান। ডাক্তারকে অনুরোধ করুন ওই ওষুধের গুণাগুণ বুঝিয়ে বলতে। এই জেনে নেওয়াটা আপনার অধিকার। সেটা প্রয়োগ করুন। পরিবেশ, পরিস্থিতি অনুযায়ী, আপনার বিদ্যেবুদ্ধি অনুযায়ী যতটা বিশদ ও সরল ভাবে সম্ভব, সেটা ডাক্তার আপনাকে বুঝিয়ে বলবে। সেই স্কিল ডাক্তারদের আয়ত্ত্ব করতে হয়।
(৬) জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের খবর পড়ে সচেতন হন কিন্তু বিচলিত হবেন না, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের বিষয়টা পেশাদারদের ওপর ছেড়ে দিন। তাদের সাথে পরামর্শ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। তথ্য আর জ্ঞান, ইনফরমেশন আর নলেজ দুটো শব্দের মানে এক নয়। গুগুল ঘেঁটে ইনফরমেশন পাওয়া যায়, নলেজ নয়। ওটা দিয়ে ডাক্তারি বিদ্যা রিপ্লেস করা গেলে পাঁচ বছরের ডাক্তারি কোর্স (বা ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য কোনো বিদ্যা) তুলে দেওয়া হত।
(৭) বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত নিয়মকানুন আমাদের দেশে এতই শিথিল যে তার সুযোগে আমাদের এনতার বোকা বানানো হয়। খুশকি একটি পরজীবী ঘটিত সমস্যা। গুরুতর হলে ওষুধ মেশানো শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে যা বিজ্ঞাপনে দেখায় না। চুলের কোষগুলি সব মৃত। মাথায় একঝুড়ি ডিম মাখলেও চুলের মৃতকোষের ক্ষমতা নেই তার থেকে কোনো পুষ্টিগুণ শোষণ করার। তাই বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে কোনো তথাকথিত ওষুধ ব্যবহার করবেন না। মনে রাখবেন কোনো মর্ডান মেডিসিনের ডাক্তার কখনো ল্যাবকোট গায়ে দিয়ে কোনো ওষুধের বিজ্ঞাপন করতে পারেন না, তৎক্ষণাৎ তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল হবে। সাদা কোট গায়ে যাদের দেখেন তারা অভিনেতা, আসল ডাক্তার নন।
(৮) মর্ডান মেডিসিন অন্যান্য বিজ্ঞানের শাখার চেয়ে বয়সে নবীন। তাই বহু রোগের সঠিক ওষুধ আবিষ্কার এখনো বাকি। সাধারণ সর্দিকাশিতে বাচ্চার বুকে মলম মালিশ করলে সেই মলমের ক্ষমতা নেই মাংস, হাড়, পাঁজরা ভেদ করে ফুসফুসে গিয়ে কাজ করার। মলম লাগিয়ে মা বাবা আনন্দ পেতে পারেন তার বেশি কিছু লাভ নেই। সাধারণ সর্দিকাশির কোনো ম্যাজিক ওষুধ এখনো মর্ডান মেডিসিন বের করতে পারে নি।
(৯) সেরে যাওয়া আর ভালো থাকা এই দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। আধুনিক চিকিৎসায় বহু অসুখ সারে না কিন্তু ভালো থাকা যায়। যেমন হাইপারটেনশন। সারা জীবনই ওষুধ খেতে হবে দরকার হলে। ভালো আছি ভেবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজেই ওষুধ বন্ধ করা আত্মহত্যার সামিল। ধৈর্য্য হারাবেন না।
(১০) “এখানে ১০০% গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসা করা হয়” এই জাতীয় বিজ্ঞাপনে ভুলবেন না। ওগুলো ঠগ, প্রবঞ্চকরা দেয়।কোনো মর্ডান মেডিসিনের ডাক্তার ওভাবে বিজ্ঞাপন দেন না। তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র বলেই তার বিদ্যের সীমাবদ্ধতাটা জানেন।
(১১) “বহুদিন ধরেই চলে আসছে” বলে কোনো ধরণের মুষ্টিযোগ বা টোটকার ওপরে ভরসা রাখা যুক্তিহীন। বিরাট কোহলির পা মচকে গেলে যে ফিজিওথেরাপিস্ট দৌড়ে মাঠে ঢোকে তার ব্যাগে কিন্তু চুন হলুদ থাকে না, অন্য ওষুধ থাকে। মা ঠাকুমা বলেছেন বলে মায়ের বুকে সাদা দুধের আগে যে গাঢ় হলুদ দুধ বেরোয়, সেটা ফেলে দেবেন না। ওটা বাচ্চা কে না খাওয়ানো অপরাধ। প্রবীণদের যথাযথ সম্মান দেবেন কিন্তু সবকথা বেদ বাক্য বলে মেনে নেবেন না।
(১২) কোনটা অসুখ আর কোনটা অসুখ নয় সেটা গুলিয়ে ফেলার চক্রান্ত চলছে মুনাফাখোরদের। সেই ফাঁদে পা দেবেন না। নিজের বাচ্চা কতটা লম্বা বা স্বাস্থ্যবান বা ফর্সা হবে সেটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকে। এর জন্য কোনো ওষুধ নেই। কালো হওয়া কোনো অসুখ নয়। কোনো ক্রিমের বাবার ক্ষমতা নেই। বরঞ্চ ওসব মাখলে বিরাট ক্ষতি। “হেলথ ড্রিংক” বলে কোনো জিনিস চামচে করে গুলে খাওয়ালে যদি সবাই “টলার, স্ট্রংগার” হয়ে যেত তাহলে ভারত বাস্কেটবল টিম অলিম্পিকে সোনা জিততো। বাচ্চার বিকাশ স্বাভাবিক থাকলেই হল। তেনডুলকার ওই হাইট নিয়েই চ্যাম্পিয়ন।
(১৩) রোজই শুনি ক্যানসারের অমুক ওষুধ বেরিয়েছে, তমুক বিজ্ঞানী নোবেল পেতে চলেছে, ওই খেলে ক্যানসার সেরে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে রাখবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সহ অনেক কোটিপতি নেতা, চিত্রতারকা রোজ ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে। ওইসব অবাস্তব দাবি সত্যি হলে তারা মরে কেন। ওষুধ আবিষ্কার করা পৃথিবীতে অতি জটিল, সময় সাপেক্ষ, ও ব্যায়বহুল বিষয়। তাই কোনো মিরাকল আশা করবেন না।
সব শেষে ডাক্তার-রুগী অবিশ্বাসের যুগে “বিশ্বাস” রাখতে বলবো না। কমন সেন্স খালি এপ্লাই করতে, যুক্তিবোধ প্রয়োগ করতে অনুরোধ রাখবো। পৃথিবীর বেশিরভাগ ডাক্তার বদ হলে কেউ বেঁচে থাকতে পারতো না। অসুখ সারানোর ক্ষেত্রে “মনের জোর” শব্দটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। এই মনের জোর বাড়াতে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনের একটা বড় ভূমিকা থাকে।
ডাক্তারকেও এই নিকটজনের বৃত্তে সামিল করুন। যেমনটা করেছিলেন যুবরাজ সিংহ সহ অনেক সাধারণ মানুষ। দেখবেন, আগের চেয়ে অনেক ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। রোগমুক্ত দীর্ধ সুস্থ জীবন হোক আপনার।