আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় মহিলা ডাক্তারের মৃত্যুর অভিঘাত আজ বিশ্ব জুড়ে গণ আন্দোলনের আকার নিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মর্মাহত, শঙ্কিত, অনিশ্চয়তায় ভুগছি। এই মৃত্যু সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারছে না কারণ আজ ঘরে ঘরে মেয়েরা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত। কর্মস্থলে কর্মরত অবস্থায়, সরকারী হাসপাতালে যদি একজন মেয়ের এই মর্মান্তিক পরিণতি হয় তা হলে মেয়েরা কোথায় সুরক্ষিত? তাই সাধারণ মানুষ বুঝেছে এর প্রতিবাদ হওয়া দরকার। প্রতিকার দরকার। এই জঘন্য হত্যার বিচার না হলে যারা দোষী তারা বা তাদের মতো অনেকে আবার এই কাজ করার সাহস করবে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ব্যক্তিগত মতামত ভাগ করে নেওয়ার জন্য আজ এই কলম ধরা। এই কয়েকদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে অনেক মতামত দিয়েছেন। একজন লিখেছেন, আমি আমার ছোট মেয়েকে এতদিন শিখিয়েছি অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করবে। এখন আর জি কর কাণ্ডের পর উনি লিখছেন দ্বিধায় আছেন মেয়েকে কি শেখাবেন। অন্যায়ের প্রতিবাদের পরিণতি যদি এমন ভয়ঙ্কর হয় তাহলে প্রতিবাদী মেয়ে হওয়া কি সমীচীন হবে? এই প্রশ্ন যে কোন মায়ের কাছে একটা বিরাট বড় দ্বন্দের উৎস।
একজন সাধারণ পরিবারের একটি মেধাবী মেয়ে, ডিগ্রীর সাথে সাথে তার কিছু মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে যে মূল্যবোধের কারণে সে হয়তো কর্মক্ষেত্রের অনৈতিক কাজকর্ম মেনে নিতে পারছিল না। একজন ডাক্তারের সমাজ চেতনা এমনই তো হওয়ার কথা। অন্যদিকে আর একদল ডাক্তার তারা ক্ষমতার লোভে, অর্থের লালসায় নিজের শুভ বুদ্ধি এবং মেরুদন্ড বিক্রি করে বসে আছেন।মানুষে মানুষে এই ফারাক কেন হয়? আসলে প্রতিটি মানুষের মধ্যে শুভ বুদ্ধি যেমন থাকে তেমনই থাকে কিছু আদিম প্রবৃত্তি(পশুদেরও যে প্রবৃত্তি দেখা যায়)। আদিম প্রবৃত্তির মধ্যে একটা ঝোঁক বা ইংরাজীতে যাকে বলা হয় impulse কাজ করে। আদিম প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মাই আমরা। কিন্তু সামাজিক জীবনে শুধু আদিম প্রবৃত্তি নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, তাই ব্যক্তিত্বের একটা দিক গড়ে ওঠে যাকে বলি আমিত্ব বোধ। আর পরবর্তী কালে সমাজ, পরিবার, স্কুল এসব থেকে গড়ে ওঠে ভাল মন্দের ধারণা। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেই মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধই মানুষকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। শুভ বুদ্ধির জাগরণ সেই মূল্যবোধেরই ফল। কথা হচ্ছে তাহলে কিছু মানুষের এমন গুলিয়ে যাচ্ছে কেন? শুধু ডাক্তারের ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই এই ফারাক চোখে পড়ছে। কিছু মানুষ আদিম প্রবৃত্তিগুলো জয় করে শুভ বুদ্ধির পথে উত্তরিত হতে পারছেন না। কিংবা শুভ বুদ্ধির পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে নিম্ন চেতনায় ডুবে যাচ্ছেন। যদি চেতনার দিক থেকে বিচার করা যায় তবে উচ্চতর চেতনায় উত্তরণের জন্য সামাজিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। পশুচেতনা বা আদিম চেতনার থেকে অভিযোজিত হয়ে আজ যে মানব চেতনার জন্ম হয়েছে সেই চেতনার ধারা উর্ধ্বমুখী বা নিম্ন মুখী হতে পারে। তার নিম্নমুখী গমন স্বাভাবিক, কিন্তু তার উর্ধ্বমুখী গমন অধ্যাবসায় ও সাধনার বিষয়। যুক্তি সঙ্গত মন, আবেগসঞ্জিত মনের থেকে উচ্চতর চেতনায় অধিষ্ঠিত আবার আবেগসঞ্জিত মন, জৈবিক চেতনার থেকে উচ্চতর। আসলে মানুষ তো সাদায় কালোয় মিশেই মানুষ। কালো বড় সহজে গ্রাস করে আমাদের। কালোর হাতছানি অমোঘ। সাদায় ফিরতে লাগে মনের জোর, অধ্যাবসায়, মূল্যবোধের প্রতি সৎ থাকার অঙ্গীকার। যখন নিম্ন চেতনার দাপাদাপি চলে, লোভ, লালসা, ক্ষমতার আস্ফালন তখন আমাদের মধ্যের শুভ বুদ্ধি লম্বা শীত ঘুমে চলে যায়। দীর্ঘ দিনের জমা হওয়া এই নিম্ন চেতনার বাস্প একদিন এমন আসুরিক রূপ নিয়ে প্রকাশ পেতে বাধ্য। আমরা প্রতিদিন যেটা অভ্যাস করি তাতেই আমাদের দক্ষতা বাড়ে। যদি নিম্নগামী পশুবৃত্তি অভ্যাস করি তাতেই দক্ষতা বাড়বে সে বিষয়ে সন্দেহ কি! এই নিয়ম মুখ্য মন্ত্রী, প্রধান মন্ত্রী, সান্ত্রীবৃন্দ, সাধারণ মানুষ, ডাক্তার, উকিল, মোক্তার, স্টুডেন্ট সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটা সংগঠন যখন লোভে, লালসায়, ক্ষমতার দম্ভে চলে তখন তার পুঞ্জীভূত কালো নিম্ন চেতনা সঞ্জাত শক্তি এমন নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। আজ নাগরিক সমাজ চমকে উঠেছে সেই দৃশ্য দেখে। পৃথিবীর বুকে যত যুদ্ধ, রাষ্ট্র শক্তির দম্ভ, আস্ফালন, অত্যাচার, ক্ষমতার লড়াই সবের জন্য এই নিম্ন চেতনার পুঞ্জীভূত শক্তিই দায়ী। স্বর্গ নরক এই পৃথিবীতেই গড়ে তুলি আমরা। আন্দোলন চলছে। জানি না এই অপরাধের বিচার হবে কিনা, কিন্তু অভয়ার মৃত্যু বৃথা যায় নি। আজ নাগরিক সমাজের শুভ বুদ্ধি এক যোগে রুখে দাঁড়িয়েছে, আদিম নিম্ন চেতনার বিরুদ্ধে, লোভের বিরুদ্ধে, লালসা এবং অসংযত চাহিদার বিরুদ্ধে। তাই দিকে দিকে প্রতিরোধ, প্রতিকারের দাবী। এই আন্দোলন একদিন থেমে যাবে। কিন্তু প্রতিদিন, প্রতি মূহূর্তে আমাদের সচেতন হতে হবে। নিজেদের মধ্যের সাদা আর কালো চিনতে হবে। কালোকে অস্বীকার করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কালো বা নিম্ন চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে উর্দ্ধতর চেতনায় উত্তোরণের চেষ্টা চালিতে যেতে হবে। নিরন্তর এই সাধনাই আমাদের যুক্তিবোধ বজায় রাখতে সাহায্য করবে, মূল্যবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। সব ভেদাভেদ ভুলে সুস্থ নাগরিক সমাজ গড়ে তুলতে পারব আমরা।