কৃষিবিল প্রথমে আসে অর্ডিনান্স হিসাবে ৫ই জুন,২০২০। সারা দেশ যখন মহামারী, লকডাউন, কর্মচ্যুতি, পরিযায়ী শ্রমিকের অভূতপূর্ব সমস্যা নিয়ে চরম বিপর্যস্ত, তখন প্রাথমিকভাবে ঠিক বোঝা যায় নি সরকার হঠাৎ এই সময়ে কৃষি আইন নিয়ে পড়লো কেন। এবার বিল হিসাবে আসে ১৪ই সেপ্টেম্বর..।
১৭ তারিখে লোকসভায় ও ২০ তারিখে রাজ্যসভায় পাশ করিয়ে দেওয়া হয়। আলোচনা নিয়মরক্ষার জন্য যেটুকু না করলেই নয়..আর রাজ্যসভায় তো ‘ডিভিসন’ এর দাবী নস্যাৎ করে ধ্বনিভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হয় যদিও সেদিন সরকার পক্ষ ছিল সংখ্যালঘু..!! ২৭ শে সেপ্টেম্বর বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর হয়ে যায়। অস্বাভাবিক অসম্ভব ক্ষিপ্রতা..একমাত্র দৈববাণী হলে শুনেছি মানুষ এরকম খেপে ওঠে। জানি না কোন্ দেবতাদের নির্দেশ ছিল lightning speed-এ কাজ করার, কিন্তু পুরো পদ্ধতিটাই মানুষকে বিশেষ করে কৃষক সম্প্রদায়কে করে তোলে ভীষণভাবে সন্দিহান।
এর সঙ্গে কতকগুলি অদ্ভুত সংযোজন ও বিয়োজন ব্যাপারটাকে আরও ঘোরালো করে তোলে।
- চাষীর যদি private party-র বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে, সে কোর্টে যেতে পারবে না। মহকুমা শাসক খুব বেশি হলে জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ করতে পারে..তারা যা বলবে তাই চূড়ান্ত। কিন্তু কেন কে বলবে?
- MSP-র কোনো উল্লেখই নেই। কেন? না কৃষকরা নাকি এত বেশি দাম পাবে যে MSP র উল্লেখ থাকলেই কমে যেতে পারে। অর্থাৎ সরকার এই ব্যাপার থেকে নিজের হাত তুলে নিল।
- তাহলে public distribution system-এর ফসল procurement হবে কী ভাবে?
- আবার APMC-র বাইরে কেনাবেচা করলে কোনো tax দিতে হবে না। রাজ্যগুলি এই মণ্ডীগুলি থেকে ভালো পরিমাণ রাজস্ব পায়..তার কী হবে? রাজ্যের নিজস্ব অর্থ সংগ্রহের সুযোগ তো এখন অতি সীমিত। সেখানেও আঘাতের আগে কী রাজ্যগুলিকে জানানো হয়েছিল?
- কৃষি তো মূলত state subject..কিছু ক্ষেত্র concurrent list র অন্তর্গত। কিন্ত কখনই union list র নয়। তাহলে রাজ্যকে পুরো অন্ধকারে রেখে এই ধরণের এক তরফা সিদ্ধান্ত কেন?
বাস্তবিকক্ষেত্রে কৃষি আইন ভালো না খারাপ সেটা অনেক পরের কথা। পুরো packaging টা এত সন্দেহজনক যে প্রথমেই কৃষক সম্প্রদায়কে ভীষণভাবে আতঙ্কিত করে তোলে। সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাবও উড়িয়ে দেয় ফুৎকারে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রয় আর কৃষিকে corporate sector-এর লোভের সামনে কোনো ধরণের protection ছাড়া উন্মোচিত করার পদ্ধতি যেন প্রায় সমার্থক..। এই সন্দেহ, অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক ও সর্বোপরি মর্যাদায় আঘাতই আপাত নিরীহ এবং নিস্পৃহ কৃষক সম্প্রদায়কে একত্র সংগঠিত হতে বাধ্য করেছে।
বলা হচ্ছে এই রদবদল নাকি Swaminathan Committee-র recommendation অনুযায়ী এবং সরকার তার নাকি ২০১ টির মধ্যে ২০০ টিই মেনে নিয়েছে। জানিনা কোন্ একটি বাদ পড়লো; কিন্তু Swaminathan Committee-র প্রধান একটি recommendation ছিল চাষের মোট খরচের (নিজস্ব শ্রম সহ) দেড়গুণ হিসাবে MSP-র সুনির্দিষ্টকরণ। তাছাড়া খুব পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে চাষের ও অরণ্যের জমি অকৃষিকাজে ব্যবহার করা উচিত নয়। আগেও হয়েছে, তবে গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিক দ্রুততায় পরিবেশের যা খুশী ছাড়পত্র দিয়ে (এমনকি যে প্রস্তাবগুলি বহুকাল ধরে পড়ে ছিল সেগুলিকেও)। যেভাবে অরণ্য ধ্বংস করা হয়েছে তা রেকর্ড বললে অত্যুক্তি করা হবে না। জম্মু হাইকোর্ট তৈরী হয়েছে মাত্র ১৫ বছর আগে। হঠাৎ ১০০ একর অরণ্য নিধন করে তৈরী হচ্ছে নতুন হাইকোর্ট কমপ্লেক্স (যা নাকি দিল্লী হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের মিলিত এলাকার ২ গুণ)। করপোরেটের স্বার্থে যেভাবে অরণ্য, কৃষিজমি ও community land ক্রমশঃ গ্রাস করা হচ্ছে তাতে সমগ্র কৃষক সমাজের সন্ত্রস্ত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। কাশ্মীরে কয়েক শত বছর ধরে বসবাস করা গুজ্জর ও বাকরাওয়ালা সম্প্রদায় আজ অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত। সারা ভারতে রাস্তা, industry, mining এর নামে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক মানুষ, আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়। এরা কেউ দেশের নয়?যা করা হচ্ছে সব নাকি দেশের স্বার্থে। কিন্তু সেই দেশে কারা থাকে.. সংখ্যালঘু, আদিবাসী, দলিত, শ্রমিক( পরিযায়ী ও অপরিযায়ী)এবং এখন কৃষক সবই তো বাদ…..। দেশে থাকবে শুধু ভক্তকুল?
Dr. Swaminathan Committee-র রিপোর্টে তো প্রস্তাব রাখা আছে পতিত ও সিলিং বহির্ভূত জমি ভূমিহীনদের বিতরণ, সেচ ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ এর সুযোগ পায়, সরকারি তত্বাবধানে চাষীকে কম সুদে ঋণদান ও তার সহজ শর্তে শোধ দেওয়ার প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনে কৃষি ঋণ মকুব…..এগুলি তো বিস্মরণের ওপারে..। হ্যাঁ, একটিই কাজ করা হয়েছে বছরে ৬০০০ টাকা (মানে মাসে ৫০০ টাকা) দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। ব্যস, আবার কী? ঐ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে!!!
Dr. Swaminathan অত্যন্ত বিদগ্ধ ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি; ভারতের ‘সবুজ বিপ্লব’–এ তাঁর অবদান সারা বিশ্বে স্বীকৃত। তাঁকে নিয়েও মিথ্যাবচন কী খুব জরুরী ছিল ?
বাস্তবিকপক্ষে কৃষকদের বর্তমান পর্যায়ে আন্দোলনে সব চেয়ে অবাক করা জিনিস হলো বিরাট স্বতস্ফূর্ততা, অসাধারণ শৃঙ্খলা, আত্মমর্য্যাদাবোধ ও আত্মপ্রত্যয়। স্বাধীন ভারতে এ এক অনন্যসাধারণ উদাহরণ …..। এই সরকার একটা জিনিসে ভীষণভাবে handicapped..এদের মধ্যে বিপক্ষ দলের বা বিরোধ/আন্দোলন রত নেতৃত্বের সঙ্গে কথাবার্তা বা আলোচনার মাধ্যমে আপাত সমাধানসূত্র নির্ণয়ে দক্ষ মানুষ প্রায় নেই। যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রয়াত। আর এই অদক্ষতা পূরণ করতে যেটা প্রচুর পরিমাণে আছে তা হলো সারাক্ষণ যা খুশী গালাগাল ও কুৎসা করার অসাধারণ ক্ষমতা। ১)খালিস্তানি, ২) বিরোধীদের চক্রান্ত, ৩)কৃষকই নয় কিছু ধনী দেশবিরোধী, ৪) বক্তব্যে দ্বিচারিতা এবং ৫) দৈনিক মজুরী দিয়ে লোক নিয়ে এসে অরাজকতা তৈরীর চেষ্টা….। তার সঙ্গে মহামারীজনিত সাবধানতা ভেঙে রোগ সংক্রমণকে বাড়ানো।
পরপর ধরা যাক..দেশে এত খালিস্তানিতে ভরে গেলে সরকার এতদিন কী করলো? হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র,উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ এরাও খালিস্তানিতে ভরে গেলো? হিন্দুস্থানের কী রইলো?
বিরোধীদের তো সারা ভারতে ছত্রভঙ্গ অবস্থা। তাদের যদি এত ক্ষমতা হয় আর তারা যদি এত মানুষকে বোঝাতে পারে (আবার ভুলভাবে) তাহলে তো সরকার পক্ষের অতি করুণ অবস্থা!!! পরিষ্কার বুঝুন বিরোধীদের সেই ক্ষমতাও নেই আর ভুল বুঝিয়ে এত মানুষকে নিজের অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে এত আত্মপ্রত্যয়ী করা কঠিন নয় সরাসরি অসম্ভব….।
যাঁরা আজ শিক্ষাদীক্ষায়, খেলাধুলায়, দেশ রক্ষা বা সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে নিজস্ব উদ্যোগে বিশিষ্ট স্থান দখল করতে সমর্থ হয়েছেন,তাঁদের বিরাট অংশ এসেছেন কৃষক পরিবার থেকে। এই আন্দোলনে এঁদের একটা বড় অংশ রয়েছে….প্রাক্তন সেনানী- পুলিশ অফিসার, অলিম্পিয়ান, বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ, আইনজীবি, গায়ক, অভিনেতা, সঙ্গীতকার…. এক অসামান্য সমাহার….। দেশ-বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী, চাকুরীজীবি অকাতরে সাহায্য পাঠাচ্ছেন। প্রতিটা গ্রাম দায়িত্ব নিচ্ছে নিয়মিত খাদ্য ও স্বেচ্ছাসেবক পাঠানোর..। একসঙ্গে সকলের খাবার তৈরী হচ্ছে..একসঙ্গে সবাই মিলে একই খাবার খাচ্ছে..কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।….. এ জিনিস কল্পনা করা যায়? এই একাত্মতাকে ছোট করার ক্ষমতা কাদের আছে জানি না। কিন্তু আমরা সত্যিই অভিভূত…. । জীবনে সফল হলে root বা মূলের সঙ্গে টান কজন অনুভব করতে পারেন? যাঁরা পারেন তাঁরা অবশ্যই ভাগ্যবান আর যাঁরা প্রত্যক্ষ করতে পারছেন তাঁরাও..। কৃষকের সমাবেশে আসবেন বলে তো কেউ নেতাদের মত ভেক ধরে আসেন নি। স্বাভাবিক ভাবে স্বাভাবিক পোষাকে এসেছেন। তাতেও আপত্তি??
প্রশ্ন, APMC এর বিপক্ষে এক সময়ে যাঁরা বলেছে, তাঁরা কী করে আজ অন্য বক্তব্য রাখে?
…. …রাজনীতিতে সরকার পক্ষে থেকে এক বক্তব্য আর বিরোধী পক্ষে থেকে অন্য বক্তব্য..এ দুয়ের পার্থক্য কী নতুন? তাছাড়া প্রেক্ষিতের তো পার্থক্য থাকতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা কোনো জিনিস পরিবর্তনযোগ্য হলে তার পরিবর্তে যা আসবে তাকে তো আগের থেকে উৎকৃষ্ট হতে হবে? না, পরিবর্তন দরকার বলে যা খুশী নিয়ে এলেই হলো? এটা সত্যি ইদানীংকালে দ্বিতীয়টার উদাহরণই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সর্বশেষ যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে বিপরীত যুক্তি প্রদর্শনে বর্তমান শাসকদল যথেষ্ট পারদর্শী। তাহলে দ্বিচারিতা নিয়ে এত প্রশ্ন না তুলে মূল বিষয় নিয়ে আলোচনাই বেশি অভিপ্রেত নয় কী?
বলা হচ্ছে দৈনিক ৩৫০ টাকার বিনিময়ে লোক জড়ো করা হচ্ছে..। এক কাজ করুন না.. রেটটা ডাবল করে দিন আর ছেঁড়াফাটা ধুতি ও গামছা বিলি করে দেখান একটা পাল্টা সঠিক কৃষকদের জমায়েত করে। কৃষকের এত ঐতিহাসিক উপকার করা হলো আর কৃষক সমাজের কোনো অংশই উদ্দীপ্ত নয়..এটা কী করে সম্ভব? তাহলে কী উপকৃতই বুঝতে পারলো না তার কতবড় উপকার করা হলো?
এবার একটু উল্টো দিক থেকে দেখি। নিশ্চয়ই চেষ্টা কম করা হয় নি এদের কিনে ফেলার। জনপ্রতিনিধি কেনা তো কোনো ব্যাপারই নয়; মিডিয়া, সরকারি-বেসরকারি উচ্চ-সুউচ্চ সবই তো পকেটে!! তাহলে এদের ক্ষেত্রে এই হাল কেন? মন্ত্রীমহোদয়দের সঙ্গে সভায় সোজাসুজি একযোগে বিনা ব্যতিক্রমে জানিয়ে দিল ‘বেশী কথা বলে লাভ নেই ..হ্যাঁ কিংবা না’। এই ঐক্য এই স্পর্ধা কল্পনাতীত। কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে এই প্রত্যয় এই দৃঢ়তা দেখানো সম্ভব!!! এদের কুৎসা না করে বরং দু চোখ ভরে দেখুন। শতাব্দীর অসাধারণ ঘটনার সাক্ষী আপনি আমি….। এদের কুৎসা করে সময় নষ্ট করলে অপূরণীয় ক্ষতি নিজেরই….
মহামারীটা নাহয় উহ্য থাক..। লক্ষ লক্ষ মানুষকে যখন হাজার হাজার মাইল হাঁটার জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হয়েছিল তখন বো বোধটা জাগ্রত ছিল না।
নিউটন সাহেবের তৃতীয় সূত্র অনুসারে, প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই সমপরিমাণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে। সামাজিক ক্ষেত্রে এই নিয়ম কিন্তু সর্বক্ষেত্রে একই রকমভাবে কার্য্যকরী হয় না….। অনেক সময়ে প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে অনেকগুণ বেশী শক্তিশালী..সম পরিমাণের থেকে বহুলাংশে বেশী…….
এটা সকলেরই মনে রাখা ভালো..।
ভালো লেখা। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমার একটি লেখাও এই বিষয়ের ওপরে এখানেই প্রকাশিত হয়েছিল।
স্বামীনাথনের ব্যাপারে আমার রিজার্ভেশন আছে। সবুজ বিপ্লবের জনক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএমএফ-এর প্রতিভূ হিসেবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রয়োজন ছিল নতুন ধরনের কীটনাশক, রাসায়নিক সার ও ওদের তৈরি বীজ ভারতের মতো বড়ো বাজারে বিক্রি করার। তাই সবুজ বিপ্লব।
এর ফলশ্রুতিতে পাঞ্জাব থেকে “ক্যান্সার এক্সপ্রেস” মুম্বাইয়ে, টাটায় চিকিৎসার জন্য।