একটি প্রাচীন লেখার অক্ষম আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ করার চেষ্টা করছিলাম। লেখাটি পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন ব্যাবিলনের একটি স্লেটে। হ্যাঁ, সেই ব্যাবিলন, যেখানে প্রায় চার হাজার বছর আগে ছিল উন্নত মানব সভ্যতা। ছিল ঝুলন্ত উদ্যান।
লেখাটি কি দাঁড়ালো-
অনু (সেই সময়ের সকল দেবতাদের পূর্বপুরুষ অথবা আকাশ) স্বর্গ সৃষ্টি করলেন।
স্বর্গ, পৃথিবী সৃষ্টি করলেন।
পৃথিবী, নদীর জন্ম দিল,
নদী, খালের জন্ম দিল।
খাল, হাওড় বিল জলাভূমির জন্ম দিল।
হাওড় বিল জলাভূমি পোকাদের জন্ম দিল!
পোকারা জলাভূমিতে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
তাঁরা বিচারের দেবতা সামাস এর কাছে গেল,
তাঁরা জলের দেবতা ইয়া-র সামনে কেঁদে ভাসিয়ে দিল এই বলে- আমাদের খাবার জন্য কি রেখেছেন? কি রেখেছেন যা আমরা চুষে খেতে পারি?
দেবতারা বললেন- এই নাও পাকা ফিগ (এক ধরণের ফল) এবং অ্যাপ্রিকট।
পোকারা বললো- ওসব দিয়ে কি হবে?
তার চেয়ে আমাদের বাসস্থান করে দিন দাঁত আর মাড়িতে।
আমরা দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত চুষে খাবো,
আমরা মাড়ির ভেতর দাঁতের গোড়াগুলোকে আস্তে আস্তে চিবোতে থাকবো।
(ভাবুন, পলিটিশিয়ানদের মতো মামা বাড়ির আবদার কত!)
তো এই অনুবাদ থেকে কিছু পেলেন??
দাঁতের পোকার জন্ম বৃত্তান্ত, তাইতো??
অপেক্ষা করুন। আর একটু সামনে পেছনে আসা যাওয়া করুন।
সুমেরীয় সভ্যতা বলে কিছু জানেন? পাঁচ হাজার বছর আগেকার! কিংবা পরবর্তী কালের চৈনিক, মিশরীয়, রোমান অথবা মধ্যযুগীয় সভ্যতার কথা জানেন?? অথবা একসময় আমাদের শাসন ও শোষণ করে যাওয়া ইংল্যান্ডের কথা?
এই সবগুলো সভ্যতার মধ্যে মিল কোথায় বলুন তো??
আসুন, এখনকার শ্রীলঙ্কা মানে প্রাচীন সিংহলে প্রচলিত কয়েকটি লাইন বলি-
Worm of the sun-god!
Worm of the moon god!
Worm of the Passé Buddha!
Stay not in the tooth, thou tooth-worm!
আচ্ছা থাক, অতদূর যেতে হবে না।
আমাদের এই দেশেও গ্রামে-গঞ্জে বেদেনীরা এক ধরণের গাছের শিকড় দিয়ে আর তুলো দিয়ে দাঁতের পোকা বের করে ফেলে, দেখেছেন কেউ??
পোকাগুলো যে হাতের তুলোতেই থাকে, সেটা কখনো দেখেছেন?? নাকি অবিশ্বাস্য একটা হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছেন শুধু??
মাথার চুল ছিঁড়েও মিল পাবেন না, যদি না আপনি জানেন- এই দীর্ঘ সময় কাল ধরে মানব সভ্যতা বিশ্বাস করেছে- মানুষের দাঁতে পোকা হয়!
আর সেই পোকা- আমাদের দাঁত কালো করে, ক্ষয় করে, গর্ত বানায়!! যাকে আজকের দিনে caries অথবা cavity বলা হয়!!
কি একটু চকচকে এনামেল সহ দাঁত কেলিয়ে হাসবেন নাকি?? নাকি পোকা আছে?
তাহলে আসুন একটু ধোঁয়া দিই আপনার মুখে!
রাগ করলেন??
দাঁড়ান একটু। মুখ হাঁ করুন! ভাবুন, আপনি মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে বাস করছেন। আপনার দাঁতে পোকা। Henbane নামক একটি বিষাক্ত গাছের ফল থেকে বীজ নিয়ে সেটা পুড়িয়ে আপনার মুখে ধোঁয়া দিই! দেখবেন, সব পোকা দাঁতের গোড়া থেকে কিলবিল কিলবিল করে বেরিয়ে আসবে!!
গা ঘিন ঘিন করছে??
কেন মশাই? আপনি তো প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বাজার গরম করতে বেশ ওস্তাদ! এখানে সেখানে ন্যাকাকান্না কেঁদে বেড়ান- আহা রে! পেরাচীন চিকিৎসা কত্তো ভালা ছেল! আমাগো দ্যাশেও কত্তো কত্তো চেকেচ্ছা ছেল!!
বড় বড় গর্ত আছে নাকি দাঁতে?? ব্যথা হয় বুঝি? বাবা রে মাগো রে বলে পোকাদের জন্য গরম জল লবঙ্গ দিয়ে রাখেন না?? নিদেনপক্ষে দন্তকান্তি তো ব্যবহার করেন, তাই না?
ভয় পাবেন কেন?? আধুনিক চিকিৎসকদের কাছে যাবেন কেন??
তবে হাসবেন। হাসলে শরীর মন ভালো থাকে। পেরাচীন চেকেচ্ছার কেচ্ছা পড়ে ও হাসতে পারেন!!
পোকা আপনার কিছুই করতে পারবে না। এটা বিজ্ঞানের গ্যারান্টি !
কারণ, দাঁতের পোকা বলে কিছু হয় না!! অলীক পোকার গপ্পো এসব!!
বিজ্ঞান দেখিয়ে দিয়েছে, পাঁচ হাজার বছরের এই মিথ ভুল!! লালারস (লালা রামদেবের রস নয় কিন্তু!), অ্যাসিড, এক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার মিলিত প্রকল্পের ফলাফল হলো এই গর্ত এবং ক্ষয়রোগ! মুখ অপরিস্কার রাখার ফলাফল এই রোগ!!
তবে হ্যাঁ, যতই বলি- এই দাঁতের গর্ত বা ক্ষয় হয়ে যাওয়া একজন মানুষের শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ক্ষতিও করে।
আমি নিজেও একসময় ভুগেছি এই রোগে।
একসময় ভাবা হতো – কুয়োর জলের ভেতর থাকা এক ধরনের জীবাণু Drucunculus medinensis এই রোগের জন্য দায়ী। সেটিও ভুল প্রমাণিত।
তবে কিছুই কি ছিল না এই মিথ তৈরি হবার পেছনে??
ছিল!
ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যাণ্ড ডেন্টাল স্কুলের গবেষণা প্রমাণ করেছে – দাঁতের ভেতরে পোকার মতোই দেখতে অনেকগুলো ছোট ছোট জিনিস আছে! সেগুলো কিন্তু নর্মাল!!
এর আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে পিয়েরে ফাউচার্ড বলে এক মধ্য আমেরিকার গবেষক মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখে বলেছেন – নষ্ট হয়ে যাওয়া দাঁতের পাল্প দেখতে খানিকটা পোকার মতোই!! অতএব, পোকার মিথ তৈরি কি অসম্ভব ছিল? না।
আর এখন, এইসব ইতিহাস পেরিয়ে এসে ডেন্টাল সায়েন্স এতোটাই উন্নত যে, চাইলেই আপনার দাঁতের এনামেল (যেটা একবার নষ্ট হলে ভগবান অব্দি তৈরি করতে পারে না!)-এর হুবহু অন্য রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে ফেলেছে!!
চাইলেই, আপনার গোটা মাড়ির দাঁত আগের মতো দেখতে করে দিতে পারে!
হ্যাঁ, বিজ্ঞান এই গর্ত বুজিয়েছে, ক্ষয় বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে!
অতএব, পেরাচীন চেকেচ্ছায় কি ছিল কি ছিল না, সে সব না জেনে মিডিয়ার বিজ্ঞাপনী মোহে পড়ে নিজের দাঁত নষ্ট হতে দেবেন না!
কিছু পোকা এখনো আছে আমাদের সভ্যতায়, যারা মোটেই দাঁতের পোকার মতো অলীক নয়! বরং রক্ত মাংসের বাস্তব মানুষের মতোই দেখতে!!
একটু সাবধান হোন। বিজ্ঞান যদি আপনার ক্ষতি করতো, তাহলে আপনি পড়ে থাকতেন ওইসব প্রাচীন সভ্যতায়।
যাকগে। এবার একটুখানি কবিতায় ফিরে আসি।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়েছেন তো??
আবার পড়ুন লাইনগুলো –
… পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল;-/এশিরিয়া ধুলো আজ-ব্যাবিলন ছাই হ’য়ে আছে’।
অথবা এটা –
… চোখ বুজে একপাশে সরে যাই-গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানি নাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।
আপনি কিন্তু চাইলেই জানতে পারেন –
জীর্ণ পাতা কেন ঝড়ে যায়, কেন হাজার হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা থেকে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ আজকের সভ্যতায় এসে পৌঁছেছে।
কে এনেছিল কবিকে এই আজকের মনুমেন্ট আর তারা ভরা কলকাতায়??
বিজ্ঞান!
আপনি ব্যাবলিনের ঝুলন্ত উদ্যানে কিংবা সুমেরু সভ্যতার দেবতাদের সঙ্গে সগ্গীয় আয়েশ ভোগ করতে চাইলে করুন না!!
খালি দাঁত কেলাবেন না! পোকা দেখা যাবে!! গর্ত দেখা যাবে – দাঁতে আর মগজে!!