৮/১/২০২৪
আজ আবার ৮ই জানুয়ারি। মায়ের সকলকে ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন।
বাস্তবে লৌকিক সব কিছু ভেসে গেলেও আসলে কিছুই যায় না। নাড়ীর টান আর আত্মিক সম্পর্ক রয়ে যায় অটুট। বিনি সুতোর বাঁধনকে ছেঁড়া যায় নাকি!
সময় চেষ্টা করে শোক ভুলিয়ে দিতে তবু মনের মাঝে শূন্যতা ছেয়ে থাকে। কর্মব্যস্ততা পিছুটান সরিয়ে দিলেও শয়নে স্বপনে, আধোঘুমে
ফিরে আসে স্মৃতির মিছিল।
বাবা মায়ের ঘরে বসে ছিলাম সকালে। আলস্যে জড়িয়ে থাকা শীতের সকাল কে বিরক্ত করে মিঠে রোদ্দুরের লুটোপুটি চলছে ঘরের ভিতর । জানালার শার্সি তে ফুটে উঠছে নকশিকাঁথার উষ্ণতা। দেওয়ালে টাঙানো ছবিতে মায়ের মুখটা যেন আরো ঝকঝকে লাগছে সেই প্রতিফলিত আলোর রেখা’য়।
দোলের আবিরে রাঙানো মায়ের মুখ এই শীতের সকালে যেন অকাল বসন্ত এনে দিলো।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে মাকে চিরবিদায় জানানো’র পরের দিন, শোকসন্তপ্ত পুত্রের একটি লেখা পাঠালাম।
……………….
ভালো থেকো মা
সুরমা নদী আমি দেখিনি। সে নদীর জল কি কাজলা দীঘির মতো শান্ত নাকি তিস্তার মতো উচ্ছলা? সে নদীর বুকে ভাসমান নৌকা থেকে নাকি এখনও ভেসে আসে মাঝিমাল্লাদের ভাটিয়ালি সুর!
ছোটবেলা থেকে আমি শুনে আসছি এসব কথা। মায়ের আনন্দিত কৈশোরগাথা। বাবার সময় ছিল না এসব আলোচনার, কিন্তু মা শোনাতেন যত্ন করে।কি ভাবে ফেলে আসতে হয়েছিল মেয়েবেলাকে, দেশবিভাগের যন্ত্রণা বুকে করে। কাঁটাতারের বেড়া পেড়িয়ে এসেছিলেন বিবাহিতার ছদ্মবেশে।
এদেশে এসেও উদ্বাস্তুদের জীবনযুদ্ধ। কোনমতে একটা ঠাঁই খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং বাস্তববাদী হওয়া সত্বেও পড়াশোনা করতে পারেন নি সুযোগের অভাবে। মেধাবী বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার পরে শুরু হয় আরেক লড়াই। দুই পরিবারের ওপার থেকে ভেসে আসা মানুষদের মাথাগোঁজার ঠাঁই যোগানোর।
আমাদের বাড়িটা ছিল সেই সব ভিটেহারাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল, আশার ঠিকানা। তাই ছোটবেলা থেকেই দেখছি বাড়িতে সবসময় চেনা অচেনা মানুষের ভীড়। রোজ দুবেলা খাওয়ার পাত পড়তো অন্তত পনেরো জনের। দূরসম্পর্কের আত্মীয় স্বজনের বিয়ে থেকে শুরু করে, অনেকে শুধু পড়াশোনা করার জন্য’ই দীর্ঘদিন থেকে গিয়েছেন আমাদের বাড়িতে। এর মধ্যে’ই এক তুতো দাদা ডাক্তারি’ও পাশ করে ফেললেন।
আমরা ভাইবোনেরা মাঝেমাঝে একটু বিরক্ত হতাম প্রাইভেসি না থাকায়। কিন্তু মা বাবাদের কাছে ওইসব ওজর আপত্তি পাত্তা পেত না কখনো। সারাজীবন মানুষকে সাহায্য করে গেছেন দুজনে।
কিছুকাল আগে বাবা চলে গেছেন মাকে একা রেখে। মা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছিলেন ধীরে ধীরে। লড়াকু মানুষটা প্রায়শই বলতেন শৈশবের দিনগুলির কথা। হবিগঞ্জের পাঠশালার গল্প আর ঠাকুরদালানে মহিষবলির কাহিনী। সেই সব কথা বলতে বলতে সুরমা নদীর বুকে ভেসে থাকা ভাটিয়ালি সুর যেন জেগে উঠতো মায়ের চোখে। ফিরে যেতে চাইতেন নিজের দেশে!
আমাদের অবাক করে, প্রয়াত দিদিমার সাথে দেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করছিলেন বিগত কয়েকদিন ধরে। আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করাটাও বেড়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন। চিন্তিত হচ্ছিলাম আমরা সবাই।
কাল সব শেষ হয়ে গেল। আচমকা মস্তিষ্কে বড় স্ট্রোকের আঘাতে মা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। লড়াকু মানুষের মতো, একেবারেই না ভুগে।
কাল মাঝরাতে সব শান্ত হলে, মায়ের ভস্মাবশেষ ভাসিয়ে দিলাম মা গঙ্গার জলে। দুই মা মিশে গেলেন ভরা জোয়ারে।
আমি বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম
“যাও মা,
এবার তুমি যাও…..
গঙ্গা থেকে পদ্মায়,
পদ্মা থেকে সুরমায়!
জলের ধারা কে সাথে করে
ফিরে যাও তোমার শৈশবে,
তোমার সিলেটে!
শুধু রয়ে যেও আমাদের জীবনে বটবৃক্ষের স্নেহচ্ছায়া হয়ে,
তোমার হলুদ ছোপ মাখা আঁচলে রেখে দিলাম আমার শৈশব আর অসুস্থতার দিনলিপি…..
তোমার স্পর্শ লেগে থাক আমাদের শরীরে, পুরনো লেপকাঁথার মতো…..,
ভালো থেকো মা,
ভালো থেকো!!”