আপনি কি সেইসব মহুয়াদের চেনেন যারা ‘কৃষ্ণকলি’ বলে কাব্যে আদিখ্যেতা আর বাস্তবে স্কুল-কলেজ-রাস্তাঘাটে উপহাসের পাত্রী হয়? আপনি কি সেইসব ফতেমাদের চেনেন যাদের গায়ের রঙ কালো বলে বিয়ে ভেঙে যায় বারবার? আপনি কি সেইসব সুস্মিতাদের চেনেন দুগালে ব্রণ নিয়ে যারা মারাত্মক অবসাদে ভোগে? আর উচ্চমাত্রার অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট নেয়? আপনি কি সেইসব নিত্যযাত্রী সুকুমারদের চেনেন যারা বছরভর দাদ নিয়ে জেরবার হয়? আর ফিরিওলা বা হাতুড়ে চিকিৎসকের দেওয়া মলম লাগিয়েই চলে? এ মা! ছি ছি! ওসব জায়গার দাদের কথা কাউকে বলা যায় নাকি?
এবারের পর্বটা তাদের নিয়ে। আগের পর্বটা মূলত পুরুষপ্রধান সমস্যা নিয়ে ছিল, এবারেরটা মূলত মহিলাদের সমস্যা। নারীবাদীরা অকারণে হেঁ হেঁ করে উঠবেন না। ‘মূলত’ কথাটা খেয়াল করুন। এদেশে সৌন্দর্যের ধারণার সাথে গায়ের রঙ ফর্সা হওয়া অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছে। বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে তো বটেই। আর সেখান থেকেই যেনতেনপ্রকারেণ গায়ের চামড়া সাদা করার উদগ্র প্রয়াস। এই মানসিকতার সুযোগ নিয়ে এদেশে কোটি কোটি টাকার অনৈতিক ব্যবসা ফেঁদে বসেছে ফেয়ারনেস ক্রিমের কোম্পানিগুলো। ফলত, কৃষ্ণকলির ‘কালো হরিণ চোখ’ ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে ঢেকে যায়।
সোজাসুজি টপিকে আসি। ফেয়ারনেস ক্রিমে কী থাকে?
- উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্টেরয়েড
- হাইড্রোকুইনোন
- ট্রেটিনোইন
- প্যারাবেন
- লেড
- মারকারি… ইত্যাদি ইত্যাদি
মাথায় রাখবেন অনেক কোম্পানিই তাদের ক্রিমের সব কাঁচামাল কম্পোজিশনে লেখে না। সেগুলিকেও সরল মনে বিশ্বাস না করাই ভালো। এরা ফর্সা করে না। মূলত চামড়ার আসল রঙ সরিয়ে চামড়া ফ্যাকাশে করে দেয়। স্টেরয়েড দীর্ঘদিন ব্যবহার (অবৈজ্ঞানিকভাবে) করলে চামড়া পাতলা ও লাল হয়ে যায়। সহজেই বারবার ইনফেকশন হতে থাকে, ব্রণর সম্ভাবনা বাড়ে। হাইড্রোকুইনোন এক ধরনের ব্লিচিং এজেন্ট। যেমনভাবে জামাকাপড়ের নোংরা দাগ তোলা হয় এরাও সেরকম ভাবে স্বাভাবিক চামড়ার রঙ ফ্যাকাশে করে দেয়। প্যারাবেন প্রিজারভেটিভ। অ্যালার্জিক র্যাশ করতে পারে। লেড, পারদের মত ভারী যৌগ স্কিন ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়। মূলত লিপস্টিকে লেড বেশি ব্যবহার হয়।
আবার বলি, সব কোম্পানি কম্পোজিশন ঠিকঠাক লেখে না। লুকিয়ে রাখে।
দীর্ঘদিন অবৈজ্ঞানিকভাবে স্টেরয়েড ব্যবহারের আর একটি কুফল হচ্ছে, স্টেরয়েড ঠিক মদের নেশার মত। আপনি স্টেরয়েড ছাড়তে চাইলেও সে আপনাকে ছাড়বে না। বন্ধ করতে গেলেই র্যাশ, ব্রণ ইত্যাদি বেরিয়ে সে আপনাকে ব্যবহার চালিয়ে যেতে বাধ্য করবে। আপনি তখন স্টেরয়েডের হুকুম তালিম করা প্রজামাত্র!
অথচ,
১. ফর্সা করে দেওয়ার দাবী জানিয়ে ফেয়ারনেস ক্রিম বিক্রি করা আইনত নিষিদ্ধ।
২. পাশ করা মডার্ন মেডিসিনের ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া স্টেরয়েড বিক্রি বে-আইনি।
৩. গায়ের রঙ নিয়ে খোঁটা দেওয়া বা তামাশা করা এক ধরনের অপরাধ।
৪. হাইড্রোকুইনোন জাতীয় স্কিন-ব্লিচার হাইপারপিগমেন্টেশনের কার্যকরী ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা। কিন্তু ফেয়ারনেস ক্রিম হিসেবে এর অবৈজ্ঞানিক ব্যবহার জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের মত উন্নত জায়গাগুলোতে নিষিদ্ধ।
এবার দাদের মলমের কথায় আসি। বাজারচলতি একটা ছত্রাক মারার, একটা ব্যাক্টিরিয়া মারার ওষুধ সঙ্গে স্টেরয়েড মার্কা যে মলমগুলো বিক্রি হয় সেগুলোর মাথা-মুন্ডু-বিজ্ঞান-যুক্তি কিচ্ছু নেই। অথচ রমরমিয়ে চলে। এসব খিচুড়ি ওষুধ বিক্রির একটাই কারণ থাকতে পারে- সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওই বিশেষ চর্মরোগটির কারণ বুঝতে না পেরে একটি সর্বঘটের কাঁঠালি কলা ধরিয়ে দিয়েছেন। যাতে তুক কে তাক কোনও একটায় কাজ হয়ে যায়। কিন্তু এভাবে হয় না। এদেশে সবাই নিজেকে ডাক্তার ভেবে ফেললেও আসলে ডাক্তারিটা ছোলা, পেঁয়াজ, লেবুর চাঁট বানানোর চেয়ে খানিকটা হলেও কঠিন। এসব ব্যবহারের হলে যে দাদ একেবারে নিরীহ হয়ে শরীরের অন্ধিসন্ধির ঘামে ভেজা জায়গায় লুকিয়ে থেকে বাঙালির আরামের, সময় কাটানোর মনোরম চুলকুনির জোগান দিয়ে গেছে এতকাল, সেভাবে মাথা তুলে দাঁড়ায় নি, একবার দাদের মলম লাগালেই ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছে… সেই দাদও হয়ে উঠেছে ভয়ংকর! বাস, ট্রেনের হকারের জাদু-মলম আর পাড়ার হাতুড়ে চিকিৎসকের না বুঝে দেওয়া মলম ব্যবহারের অবিমৃষ্যকারিতায় দাদ এখন সাধারণ দাদবিনাশী ওষুধে সারতেই চায় না।
অন্য পর্বগুলোর মত এবারও বলে রাখি- ত্বকরোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়া ওষুধ যদি কিছু থাকে সেটা স্টেরয়েড। অজস্র ডার্মাটাইটিস, অসংখ্য ক্রনিক স্কিন ডিজিজ স্টেরয়েডের কল্যাণে আজ অনেকটাই মানুষের বশীভূত। আবার সেই স্টেরয়েড ত্বক-ধ্বংস করতে পারে অবলীলায়!
আরও একবার বলি…
স্টেরয়েডের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় স্বয়ম্ভু নয়, তার পেছনের মহাকাল আপনি। হ্যাঁ, আপনিই।
(ক্রমশ..)