ভাদ্র মাস। সন্ধ্যা ঘনঘোর। সারাদিন অবিশ্রান্ত বর্ষণে আজ চারপাশ সিক্ত হয়ে আছে। একটা মৃদু ঝর্রর্রর্রর্র শব্দে ঝিরঝির করে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। চারপাশ ঝিঁঝিঁ পোকাদের তীব্র পা ঘষার আওয়াজে মুখরিত। হঠাৎ করে শীতশীত ভেজা হাওয়া এসে ঠান্ডা পরশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কোন এক ডোবা থেকে ব্যাঙগুলোর গ্যাঁঙ গ্যাঁঙ ডাক শুনে মনে হচ্ছে কারা যেন বসে হেঁড়ে গলায় ইশকুলের পড়া মুখস্ত করছে।
পাড়া গ্রাম অঞ্চল তো? ঝড় বৃষ্টির সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। তাই হাতুড়ে বুড়ো তার অন্ধকার এক চিলতে বারান্দায় পা গুটিয়ে বসে আছে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাগানে গাছেদের পরিচর্যা করে এখন একটা মস্ত মগে করে চা পান করতে করতে উষ্ণ হচ্ছে। ওর সামনে অন্ধকার মূর্তির মতো তিনজন যুবক বসে আছে। সুদি, বন্ধু আর অনো। তাদের হাতেও চায়ের পেয়ালা।
একজন বল্লে “ গল্পবুড়ো তুমি একটা গল্প বলো।”
গোটা আকাশ জুড়ে নীল আলোর ঢেউ তুলে ক্ষণপ্রভা বিদ্যুৎশিখা এলো আবার মিলিয়ে গেল। ঠিক তারপরেই আবার ঝেঁপে বৃষ্টি নামলো। ঝমঝম ঝমঝম। অঝোর বৃষ্টিকণা এসে ভিজিয়ে দ্যায় বুড়ো ডাক্তার আর তিন সদ্য যুবকের শরীর মন।
“তখন আমি সদ্য পাশ করা ডাক্তার – জীবন বাঁচানোর প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত। ভরা গরমের রাতগুলো কিছুদিন যাবৎ আমার কাছে আতঙ্কের হয়ে উঠেছিল। তখন আমাদের কলেজের কাছেই একটা রাস্তা তৈরি হচ্ছিল। দূর থেকে আসা গরীব মুটেমজুররা রাতে কাজের শেষে ওখানেই মাটিতে ঘুমিয়ে পড়তো। আর প্রায় প্রতি রাতেই শেষের দিকটায় ওখান থেকে একটা করে রোগী আসতো। পেটে ব্যথা পেটে ব্যথা এই অভিযোগ নিয়ে। কিছু বোঝার আগেই তারা কোমায় চলে যেতো। তখন কোথায় আইসিইউ – কোথায়ই বা ভেন্টিলেটর? কয়েক শো রোগী দু একটা ডাক্তার ….” বিদ্যুতের আলোয় বুড়োর আবছা মুখটা ম্লান দেখায়।
“তারপর?”
“তারপর একদিন শেষ রাতে একটা বাচ্চা মেয়ে এলো। সঙ্গে এসেছিলো তার বাবা– একটা গরীব মজুর। মেয়েটার একই অভিযোগ পেটে বড়ো ব্যথা। আরেকটা মৃত্যু ঘটবে। যন্ত্রণায় আমার সদ্য যুবক মন শিউরে ওঠে। আমি তখন বারবার করে জিজ্ঞেস করছি ‘আর কি কষ্ট? আর কি কষ্ট হচ্ছে তোর? শিগগির বল’ মেয়েটা কোমায় যাওয়ার আগেই আর কোনও ক্ল্যু পাওয়া যায় কিনা জেনে নিতে হবে। যদি আরেকটা মৃত্যু আটকাতে পারি।
একটু পরে সেই মেয়ে বলে উঠলো ‘সব কিছু দুটো করে দেখছি- ডাক্তারবাবু তোমাকেও দুটো দুটো করে দেখছি।’
তাইতো মেয়েটার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। চেষ্টা করেও খুলতে পারছে না। মাথায় বিদ্যুৎ চমকে উঠলো নার্ভ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোন অসুখে নার্ভ অকেজো হয়? বিষ নয়তো?নিউরোটক্সিক? মাথায় ঝিলিক দেয় এ নিশ্চয়ই সাপের কামড়।
তখন সাপের কামড় নিয়ে আমাদের বিশেষ কিছুই পড়ানো হতো না। এখনই দেশে অফিসিয়ালি বছরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়– আসলে কিন্তু অনেক অনেক বেশী লোক মরে। কিন্তু এই মেয়েটা কামড়ানোর কথা তো কিছু বলছে না?
সিস্টারকে ডাক দিলাম। ‘ও দিদি, মেয়েটার জামা কাপড় খুলে শরীরে কোথাও কোনও বাইট মার্ক (সাপে কামড়ানোর দাগ) আছে কিনা দেখুন তো?’
সিস্টার দিদিরা একেবারে যন্ত্রের মতো নিখুঁতভাবে এবং দ্রুততায় লজ্জানিবারণের আড়াল (স্ক্রিন) তৈরি করে পরীক্ষা করে জানান। হ্যাঁ দাগ আছে– থাইএর ভেতর দিকে। তার মানে আশা আছে। আমি কিছু বলার আগেই সিস্টারদিদিরা ওষুধ আর ড্রিপ সেট রেডি করে ফেলেছেন। চোখের সামনে মৃত্যু দেখতে কেই বা চায়? সন্তানহারা দরিদ্র পিতার বোবা কান্না আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।”
একজন যুবক অধৈর্যে বাধা দেয় “মেয়েটা বেঁচেছিলো?”
হাতুড়ে পকেট হাৎড়ে একটা আধভেজা সিগারেট বার করে শিখাহীন নীল রঙা লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালায়। আবছা আলোয় দাড়িভরা মুখটা বড়ো তৃপ্ত দেখায়। ধোঁয়া ছেড়ে বলে “হ্যাঁ রে। বেঁচেছিলো। পাঁচদিন পরে বাবার কোলে চেপে বাড়ি ফিরেছিলো। তখন পাঁচশো টাকা স্টাইপেন্ড পেতাম কিন্তু…”
“কিন্তু সাপে কামড়ালো অথচ মেয়েটা বুঝতেই পারলো না? ওকি ড্রাগড ছিলো?”
বুড়ো সিগারেটে টান দেয়। লাল আলোকবিন্দু উজ্জ্বল হয়ে বুড়োর মুখটাকে লালচে করে তোলে “কালাচ বা কমন ক্রেইট।”
“কামড়ালে টের পাবে না?”
“না – পাবে না। কালাচ কামড়ালে ব্যথা হয় না– বরং জায়গাটা অসাড় অবশ হয়ে যায়। কিচ্ছু বোঝা যাবে না। সকালে উঠে পেটে ভয়ানক ব্যথা হবে। তারপর হয়তো ডবল ভিশন হবে এরপর নিশ্বাস প্রশ্বাসের মাসলগুলো পর্যন্ত প্যারালাইজড হয়ে যাবে– ফলতঃ নিঃশ্বাস নিতে না পেরে অক্সিজেনের অভাবে অথবা হার্ট প্যারালাইজড হয়ে রোগী মারা যাবে। চিকিৎসা ছাড়া সাধারণতঃ চার থেকে আট ঘন্টা বাঁচবে।”
তিনজন যুবক স্তব্ধ হয়ে যায়। একজন বলে “হোপফুলি এখানে ওটা নেই।”
দ্বিতীয়জন বলে “থাকলেই বা চিনবো করে?”
বুড়োর হাতের সিগারেট পুড়তে থাকে। “কালো অথবা নীল রঙের সাপ গায়ে জোড়া জোড়া সরু ডোরাকাটা দাগ। এরা রাতের বেলা বেরোয়। অনেক সময় বিছানায় উঠে শুয়ে থাকে। ডোরাকাটা আরেকটা সাপ আছে ঘরচিতি। এটা কিন্তু নির্বিষ। এদের একটা একটা করে মোটা মোটা ডোরা থাকে আর গায়ের রং বাদামী।”
সুদি বলে “এটাই সব থেকে বিষাক্ত সাপ?”
বন্ধু (সুবন্ধু তকাই চক্রবর্তী) প্রাণীবিদ্যার ছাত্র, সে বলে “না শাঁখামুটি সব থেকে বিষাক্ত সাপ। কিন্তু এ সাপ কোনদিন কাউকে ছোবল দিয়েছে বলে জানা নেই।”
হাতুড়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে “এরা বরং কালাচ আর কেউটে গোখরো চন্দ্রবোড়া সাপেদের খেয়ে নেয় তাই অনেকে এদের রাজসাপও বলে।”
অনো বলে “বন্ধুসাপ”।
সুদি বলে “আর কি কি বিষাক্ত সাপ আছে জেনে রাখা ভালো ভাই। কখন কোথায় দেখা হয়ে যাবে তার ঠিক নাই।”
বুড়ো হাসে “অবশ্যই। বাচ্চারা জেনে রাখো। কেউটে গোখরো শঙ্খচূড় ফনাওয়ালা সাপ এদের নার্ভ ধ্বংস করার বিষ আছে। আর চন্দ্রবোড়া (ভাইপার) এরা রক্তকণিকা ধ্বংস করে। কাটা জায়গা ফুলে ওঠে – মুখ নাক পায়ুদ্বার পেচ্ছাপ সব কিছুই রক্তে ভরে যায়। এরাই হলো মারাত্মক বিষাক্ত জিনিস।”
বন্ধু যোগ করে “কেউটে আবার তাড়া করে এসে ছোবল দেয়। অথচ গোখরো একই ধরণের সাপ হলেও তুলনায় শান্ত প্রকৃতির সাপ।”
গুড়গুড় করে মেঘ ডাকে। কামিনী মাধবীলতা আর জুঁইয়ের গন্ধ ভেসে আসে। ঝোপঝাড়ে হিংস্র শ্বাপদের চোখের মতো নীলচে সবুজ জোনাকির আলো জ্বলতে নিভতে থাকে। কোথায় যেন হিসসসস করে একটা শব্দ শোনা যায়। চারজনই উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শোনে। তারপর সবাই হেসে ফেলে। দূরে একটা বাড়িতে প্রেসার কুকারে সিটি দিচ্ছে।
অনো বলে “কালনাগিনী নিয়ে অনেক মিথ আছে। ওটা কি পয়জনাস সাপ?”
বন্ধু উত্তর দ্যায় “মাইল্ড পয়জন আছে। ওদের তো বিষথলি নেই তাই লালাটাই অল্প বিষাক্ত। আসলে ওটা ছোট খাটো প্রাণীদের ঘুম পাড়িয়ে দ্যায়। ল্যাবে দ্যাখা গেছে ওর লালা ইঞ্জেক্ট করলে একটা ইঁদুর চল্লিশ মিনিট মতো ঘুমিয়ে থাকে।”
হাতুড়ে সিগারেটটা ফেলুদা স্টাইলে টুশকি দিয়ে রঙ্গন গাছের মাথার ওপর দিয়ে উড়িয়ে দিলো। “লখিন্দর কালনাগিনীর ছোবলে ঘুমিয়ে পড়েছিলো আর বেহুলা ওকে কলার ভেলায় তুলে নিয়ে নাচতে নাচতে ভেসে যাচ্ছিলো। পরের দিন সকালে লখিন্দরের ঘুম ভাঙে। তারপর চোখ টোখ কচলে গাছ থেকে দুগাছি মর্তমান কলা পেড়ে গাবুসগুবুস করে খেয়ে দুজনে বাড়ি ফিরে আসে।”
বাচ্চারা নিঃশব্দে হাসে ।
“যেহেতু ইঁদুর ছুঁচো এরা গৃহস্থ বাড়ির চারপাশে থাকে তাই অনেক সাপই ইঁদুর খেতে বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে।”
“লোকে যে বলে দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা এটার কি কোনও বেস আছে?”
হাতুড়ে নিঃশব্দে হাসে- হাসতেই থাকে। হাওয়ায় ওর পাকা দাড়ি নৌকোর পালের মতো উড়তে থাকে। রেইন ওয়াটার পাইপ বেয়ে কলকল করে জল পড়ে। বৃষ্টি বাড়ছে। চারপাশ অঝোর বৃষ্টিধারার সাদা পর্দায় ঢেকে গেছে।
“বেশীরভাগ সাপেরই একটা মাত্র কোনো রকমে কাজ চালানো গোছের ফুসফুস। ওদের পক্ষে কিছু পান করা অসম্ভব শুধু নয় নামুমকিন হ্যায়। বেচারারা সম্পূর্ণ কালা। ওদের কোনও কানই নেই। চোখেও ভালো দ্যাখে না– শুধু আলো অন্ধকার আর নড়াচড়া। ওরা কোনরকমে গলা আর পেটের মাংসপেশির সাহায্যে খাবারটা গলায় পাচার করে, তারপর আবার গর্তে ঢুকে যায়। একেবারেই নিরীহ একটা প্রাণী।”
সুদি প্রশ্ন করে “তাহলে ওদের বিষ কেনো?”
বন্ধু বলে “না ভাই ওটা বিষ নয়। ওটা স্যালাইভা (লালা)– অনেক সাপ লালাটাই বিষথলিতে জমিয়ে রাখে– শিকারকে কাবু করে ধরার জন্য কেননা ওদের হাত পা কিচ্ছু নেই- দাঁতও ঐ দুটো মাত্র।”
“তাহলে ওরা শিকার ধরে কি করে?” অনোর প্রশ্ন।
“কিছুটা গন্ধ শুঁকে আর কিছুটা উত্তাপ মেপে বাকিটা মাটির কাঁপুনি মেপে। ওদের শরীরে উত্তাপ বোঝার একটা ইউনিক ব্যবস্থা আছে। ওরা তো শীতল রক্তের প্রাণী তাই এটায় ওদের সুবিধা হয়। আর ঝোপে জঙ্গলে হাঁটার সময় মাটিতে পা ঠুকে ঠুকে হাঁটলে সাপেরা সাবধান হয়ে পালিয়ে যায় কেননা ওরা মাটির কাঁপুনিটুকুই বুঝতে পারে। আসলে ওরা খুব ভীতু আর অসহায়।” হাতুড়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছাঁট অনুভব করেন।
“অসহায়? এ্যাতো মানুষ যে সাপের কামড়ে মারা যায়– সেটা কি?” অনো কিছুটা বিষ্মিত।
“এটা মানুষেরই দোষ। আমাদের অন্ধবিশ্বাস ওঝা গুণিন তুকতাক যতদিন থাকবে ততদিন এই সব মৃত্যু ঠেকানো যাবে না। কেননা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সাপের কামড়ের চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয়। আর সাপ সম্বন্ধে এ্যামন এ্যামন সব ভয়াবহ গুজব চালু আছে যে আর্ধেক মানুষ ভয়েই মরে যায়। এছাড়া ডাক্তারদেরও সাপের কামড়ের ব্যাপারে সঠিক শিক্ষা দরকার।”
বাচ্চারা চায়ের পাত্র তুলে ঘরে যাবার সময় সুদি বললো “আমি একটা কালনাগিনী পুষবো।”
অনো বললো “আর ঘুম না হলেই ছোবল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি?”
দেড়েল হাতুড়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন “ঘুম হয় না? কেনো প্রেমে পড়েছিস নাকি?”
বাচ্চারা কলকল করতে করতে ঘরে ঢুকে যায়।
Amaar bari r ulto dik e thik ei rokom ekta “Buro” doctor boshto – amader lifeline chhilen uni. Haal e dekhte pachhi na bole khub chap e achhi.
আছে । শোনা যায় সে নাকি কোভিড আমলে কোন্ এক ক্লিনিকে বসছে । পাকা খবর নেই ।