১
গ্রামের এক ছিঁচকে চোর, তার নাম গনশা, এক জজসাহেবের গ্রামের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল। গনশা বেপাড়ার চোর। এটা যে জজসাহেবের বাড়ি সেটা তার জানা ছিল না। জানলে সে পারতপক্ষে এ বাড়িতে ঢোকে!
যাই হোক, বিশেষ কিছুই নিতে পারে নি সে। বাড়িতে ছিলও না বেশী কিছু। গরমকাল। কয়েকটা আম, দুটো কাঁঠাল, একটা কোদাল আর আধবস্তা চাল নিয়ে পালানোর সময় রাতপাহারাদার ছেলেরা হই হই করে তাড়া করে তাকে ধরে ফেলে। জজসাহেব কলকাতায় থাকেন। কালেভদ্রে আসেন এই গ্রামের বাড়িতে। ঘটনাচক্রে সেই রাতে তিনি ওখানেই ছিলেন।
পাড়ার ছেলেরা হাতের সুখ করে দু-চার পিস ধোলাই দিতে না দিতেই পুলিশ এসে পড়ল। জজসাহেবের বাড়ির চুরি বলে কথা! অন্য কোন বাড়ি হলে দু-তিনদিন বাদে গেলে বা না গেলেও চলত।
পুলিশ এসে গনশা-কে বমাল আটক করে জজসাহেবের সামনে পেশ করল। পরদিন সকালে আবার কলকাতা ফিরতে হবে। শুনানি আছে। সপ্তাহের প্রথমদিন। কাল কোনো ছুটিছাটাও নেই। সুতরাং জজসাহেবের বাড়িতেই মাঝরাতে কোর্ট বসে গেল। বিচারে গনশার হল দুবছরের সশ্রম কারাদন্ড। গনশা অবশ্য মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল যে সে নিজের মেয়ের দুধ জোগাড় করতে না পেরে পয়সার জন্য এ কাজে নেমেছে- কিন্তু কে শোনে কার কথা। এবার গনশা জেলে বসেই মেয়ের জন্য দুধ জোগাড় করবে!
২
জজসাহেবদের নিয়ে বিশেষ লেখালেখি না করাই ভালো। আমারও কাজকর্ম, বৌ-বাচ্চা আছে। বিপদে পড়তে চাই না। তাই এবার অন্য গল্প।
চোর ধরা
ছোটবেলায় আমাদের ছোট্ট পাড়াটায় মাঝেমধ্যেই চুরি হত। এর মুরগীটা, ওর সাইকেলটা, তার কাঁসার থালাটা হাওয়া হয়ে যেত। এই ভাবে অনেক দিন চলার পরে একসময় পাড়ার লোকজন তিতিবিরক্ত হয়ে রাতপাহারার বন্দোবস্ত করল। আমি তখন খুবই ছোট। স্কুলেও ভর্তি হই নি। তখনকার দিনে পাঁচ-ছয় বছরের আগে স্কুলে ভর্তি হওয়া যেত না। যাই হোক, একদিন মাঝরাতে খুব হইচই শুনে ঘুম ভেঙে গেল। বড়দের কথাবার্তায় বুঝলাম চোর ধরা পড়েছে। একটা নয়, একবারে দু-দুটো। চোর কি রকম দেখতে হয় তা জানার আমার প্রচন্ড কৌতুহল। কিন্ত অত রাতে ছোটদের কাউকেই বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হল না।
সারারাত উত্তেজনায় ছটফট করে কুয়াশামাখা শীতের ভোরে আপাদমস্তক চাদর, মাফলার মুড়ি দিয়ে অকুস্থলে গিয়ে চোর দেখে খুবই হতাশ হলাম। দুটো কালো মুশকো জোয়ান লোক খালি গায়ে পুকুরে একবুক জলে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। আর তাদের ঘিরে পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং মজা দেখছে অন্ততঃ শ’খানেক ছেলেবুড়ো।
সেই বয়সে আমার ধারণা ছিল চোর একটা অন্য প্রজাতির জীব। কিন্তু এ কি! এদের তো আমাদেরই মত একটা মাথা, দুটো হাত, দুটো কান, দুটো চোখ। ধুস্।
সারারাত চোর পাহারা দেওয়ার পর থানা থেকে পুলিশ এল। বেঁধে নিয়ে গেল ওদের। সত্যি বলতে কি, সেই ছোটবেলায় চোরদুটোর দুর্গতি দেখে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল।
৩
ভোট চুরি
পানপুর উলুডাঙা স্কুলের পরিচালন সমিতির নির্বাচন। এলাকার মাছের পাইকারী কারবারি কার্তিক বাছাড় এবার সেই নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য প্রার্থী। উচ্চমাধ্যমিকে তিনবার ফেল হলে হবে কি, ধনী ব্যবসায়ী। বিধায়কের কাছের লোক। মাছের ব্যবসার সাথে সাথে ইদানিং ধান-চাল, ইঁট-বালি, কন্ট্রাকটারি ব্যবসায় ভালোই হাত পাকিয়েছে। তার মুল প্রতিদ্বন্দী হল জীবনকৃষ্ণ পাল। বংশ পরম্পরায় বিখ্যাত মূর্তির কারিগর। জেলা জুড়ে নাম। কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগ বিশেষ নেই। তাই তার জেতার সম্ভাবনাও বিশেষ নেই।
কার্যক্ষেত্রে হলও তাই। ছাপ্পা ভোট দিয়ে, পোষ্টমাষ্টারকে ঘুষ দিয়ে পোষ্টাল ব্যালট হাত করে, ভোট চুরি করে বাছাড় বাবু স্কুলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। প্রথম মিটিং-এ বিধায়ক মশাই-এর উপস্থিতিতে নবনির্বাচিত সভাপতি মশাই হেডমাষ্টার সতীশবাবুকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, আপনার আমলে এই স্কুলে পরীক্ষায় টোকাটুকি এবং ভর্তিতে স্বজনপোষণ বেড়ে গেছে। এসব আর সহ্য করা হবে না। এই অপমান নিতে না পেরে এক সপ্তাহের মধ্যেই সতীশবাবু হেডমাষ্টারের পোষ্ট থেকে পদত্যাগ করলেন।
৪
কুম্ভীলক বৃত্তি
খবরে প্রকাশ, দেশের একটা অগ্রণী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত গবেষণাপত্র বিলেতের একটা বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকায় নকল করার অভিযোগে বাতিল হয়ে গেছে। কি লজ্জা! প্লেজিয়ারিজম অর্থ্যাৎ কুম্ভীলকবৃত্তি সংক্রান্ত নিয়ম বলছে, সামান্য কিছু শতাংশ পর্যন্ত কিছু ক্ষেত্রে শব্দের নকল করা গ্রহণযোগ্য। যদিও বিষয়ের ধারণা, তত্ত্ব বা গবেষণালব্ধ ফলাফলের সামান্যতম নকলও গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এইসব জটিল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এই লেখা নয়। সে না হয় পরে করা যাবে।
অস্থিবিদ্যার এক জগদ্বিখ্যাত পত্রিকার সম্পাদক বিলেতের ফুলফোর্ড সাহেবের এক বক্তৃতা শুনেছিলাম দিল্লীতে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- ‘এশীয়, বিশেষতঃ ভারতীয়দের গবেষণাপত্র আপনারা প্রকাশ করেন না কেন?’
উনি বলেছিলেন, ‘গবেষণাপত্র নকল করার প্রবণতা বেশী বলে।’
কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। বিশেষতঃ, বর্ণবিদ্বেষ, ঔপনিবেশিকতা, অর্থনৈতিক অসাম্য- ইত্যাদি নানা বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু নকল গবেষণাপত্রের অনেক উদাহরণ আমরা দেখেছি।
৫
থীসিস চুরি
মেডিক্যালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী করার সময়ে সকলকেই একটা থীসিস করতে হয়, যদিও সেটা আসলে ডিসার্টেশন। তাতে একজন বা একাধিক গাইড থাকেন- যারা সাধারণতঃ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের থেকেও ভয়ঙ্কর হন। তা নাহলে, সে ছাত্র/ছাত্রী ভাগ্যবান। এসব লিখতে পারছি, কারণ আমাকে এ জন্মে আর থীসিস লিখতে হবে না।
ভাগ্য আমাকে সাথ দেয় না। তাই দ্বিতীয় বর্ষের মাস ছয়েক গেছিল থীসিস লিখতে আর কাটাকুটি খেলতে। মানে হল, দুপাতা লিখছি আবার লাল কালিতে সব সংশোধন হচ্ছে। আবার লিখছি। কিন্তু এ তো ত্রেতা বা দ্বাপর যুগ নয় যে ভুর্জপত্রে লিখে থীসিস জমা দেবো। হাতে লিখে তো আর বই হয় না! তাই অগত্যা প্রশান্তবাবু।
আশী বা নব্বই-এর দশকে কেউ মেডিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর করেছে অথচ প্রশান্ত বাবু -কে চেনে না এ প্রায় অসম্ভব। এই দুই দশকের প্রথম দিকে ইলেকট্রনিক টাইপরাইটারে আর পরের দিকে কম্পিউটারে থীসিস লেখা হত। তখন কম্পিউটার এসেছে বাজারে তবে ল্যাপটপ নয়। ব্যক্তিগত ডেস্কটপ বিরল কয়েকজনের কাছে ছিল। আমার সে সৌভাগ্য ছিল না।
কলকাতায় ডিটিপি বা ডেস্কটপ পাবলিশিং আরো দুয়েকজন হয়তো করত। কিন্তু ডাক্তারী প্রতিশব্দ গুলোর সাথে সড়গড় না হওয়াতে তাদের দিয়ে ডাক্তারি থীসিসের কাজ হত না। সুতরাং প্রশান্তবাবুই ভরসা। প্রশান্তবাবুর বাড়ি এবং অফিস ছিল কলকাতার এক বিখ্যাত জায়গায়- মেডিক্যাল কলেজের উল্টোদিকে প্রেমচাঁদ বড়াল ষ্ট্রীটে। পরের দিকে বেশ হৃদ্যতা হওয়ার পরে বিলেত থেকে সিনিয়র দাদাদের পাঠানো সার্ডিন মাছ, রানী ভিক্টোরিয়ার ছাপ দেওয়া কাঠের কেসে বন্দী আমাদের দার্জিলিং চা খাওয়াতো প্রশান্তদা।
সান্ধ্যকালীন ওয়ার্ড রাউন্ড শেষে থীসিসের কাগজপত্র হাতে রাত আটটা- নটা নাগাদ যখন প্রশান্তবাবুর অফিসে যেতাম, তখন একটাই চিন্তা থাকত মনে- থীসিসের কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। অন্য কোনো বোধ কাজ করত না।
প্রশান্তবাবু বলত, ‘এত খাটেন কেন? ইউ সি এম (ইউনিভার্সিটি কলেজ অব মেডিসিন) থেকে পুরোনো একটা থীসিস জোগাড় করুন না। কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে।’
ইউ সি এম হল ইউনিভার্সিটি কলেজ অব মেডিসিন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তারির স্নাতকোত্তর শিক্ষাকেন্দ্র।
আমি বললাম, ‘ও আমি পারব না প্রশান্তদা। আর পারলেও আমার বস পিঠের চামড়া তুলে দেবে।’
আমি তখন মেডিক্যাল কলেজ, পিজি, এন আরএস, ব্রিটিশ কাউন্সিল -এর লাইব্রেরীতে লাইব্রেরীতে ঘুরে বেড়াতাম। লাইব্রেরীয়ানদের ব্যথার ওষুধ, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম এর স্যাম্পল জোগান দিয়ে জোগাড় করতাম প্রয়োজনীয় মূল্যবান জার্নাল। সেখান থেকে দরকারী অংশগুলো লিখে নিতে হত, ফটোকপি ছিল না। হয়ত, অতটা খেটেছিলাম বলেই আমার থীসিসটা গবেষণাপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজি ও ফরাসী ভাষায় ব্রাসেলস থেকে প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশন্যাল অর্থোপেডিক্স’ জার্নালে।
ধান ভানতে শিবের গীত করে ফেললাম। আসল প্রসঙ্গে আসি। একদিন সন্ধ্যায় প্রশান্তবাবুর অফিসে কাজ করছি। এমন সময় আমারই পরিচিত ধাত্রীবিদ্যার এক স্নাতোকোত্তর ছাত্র একটা পুরনো থীসিস প্রশান্তদাকে দিয়ে বলল, ‘এটাই একটু এদিক-ওদিক করে টাইপ করে দেবেন। তারপর আমি চেক করব।’
সে চলে যাওয়ার পরে প্রশান্তদা বলল, ‘দেখলেন তো, আমি এটাই বলছিলাম।’
‘আমি এটা পারব না, প্রশান্তদা।’
‘হুম্, অনেকেই পারে না।’
শেষমেষ দেখা গেল আমার থীসিসের অন্ততঃ এক মাস আগেই ওই টোকা থীসিস স্বাক্ষর হয়ে জমা পড়ে গেল!
৬
চোরের মায়ের বড় গলা
পারমিতা সান্যাল বেশ ভাল লেখে। গদ্য, বিশেষতঃ গল্প লেখায় তার মুন্সীয়ানা রীতিমত চোখে পড়ার মত। সে এখনো সোস্যাল মিডিয়াতেই লেখে। দুয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনে অবশ্য তার গল্প বেরিয়েছে। কিন্তু একটা আস্ত বই ছাপানোর উদ্যোগ, অর্থ, যোগাযোগ- কোনোটাই আপাততঃ তার নেই। সবেমাত্র একটা স্কুলে চাকরী জুটিয়েছে সে। সোস্যাল মিডিয়াতে লেখা কবিতা, গল্প যে চুরি হয়ে যায়, এ বিষয়ে সে সম্যক অবহিত। কিন্তু সে এগুলোকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। নিজের আনন্দেই লেখে। কিন্তু তার পরিণতি যে এমন হবে, তা সে ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পারে নি।
গত বুধবার সন্ধ্যাবেলায় স্কুল থেকে ফিরতেই মা তাকে একটা মোটা এবং ভারী প্যাকেট ধরালো। ‘তোর নামে এসেছে।’
ভেতরে একটা বই আছে মনে হয়। পাঠিয়েছে কে এক অলোক সুর। অনেক ভেবেও নামটা চেনা বলে মনে হল না। প্যাকেটটা খুলে একটা ছোট বাংলা ছোটগল্পের বই বেরোল। অলোক সুরের লেখা। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা গল্পে এসে চোখ আটকে গেল। গল্পের নাম ‘উট’। অবাক কান্ড! এ তো পারমিতারই লেখা। শিরোনাম থেকে শুরু করে সব অবিকল এক। প্রত্যেকটা অক্ষর নকল। আরো চমকে দিল সঙ্গের একটা চিঠি। তার সাথে পিন আপ করা আরেকটা কাগজ। পারমিতারই একটা ফেসবুক পেজের প্রিন্ট আউট। যাতে অবিকল এই গল্পটা লিখেছিল সে। চিঠির বক্তব্য পরিস্কার। ‘আপনি আমার লেখা এবং প্রকাশিত এই “উট” গল্পটা চুরি করে নিজের নামে নিজের ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেছেন। অবিলম্বে প্রকাশ্যে এবং ফেসবুকে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান। নয়তো আমি আদালতের দ্বারস্ত হতে বাধ্য হব।
চিঠিটা পড়ে মাথা ঘুরে গেল পারমিতার। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পরে হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা খেল। তারপর মাথা ঠান্ডা করে ফোন করল মাসতুতো দাদা বুবাই ওরফে অর্ণব চক্রবর্তীকে। অর্ণব হাইকোর্টের নামকরা দেওয়ানী উকিল। সব শুনে সে বলল, ‘বইটা বেরিয়েছে বলছিস এ বছরের মে মাসে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে। আর তোর লেখাটা ফেসবুকে পোষ্ট করেছিস এবছরেরই ২৯শে জুলাই। অথচ তুই বলছিস তোর লেখাটা অরিজিনাল। আর তার কপি করে অলোক সুর তার বইটায় দিয়েছে। এটা আইনের চোখে কিভাবে দাঁড়াবে?’
‘কিন্তু আমি তো আসলে গল্পটা লিখেছিলাম ২০১৯ সালে, একটা অনলাইন সাহিত্য গ্রুপের গল্প প্রতিযোগিতায়। ‘বিশিষ্ট নবীন লেখক’ সম্মানও পেয়েছিলাম।’
‘লেখাটা পাঠিয়েছিলি কিভাবে।’
‘ইমেল করে’
‘সেইসব ইমেল জোগাড় করা যাবে?’
‘যাবে মনে হয়। আর তাছাড়া ওটা সেই ২০১৯ এ আমার ব্লগেও লেখাটা দিয়েছিলাম।’
‘তাহলে তো হয়েই গেল।’
ইমেল, ব্লগস্পট খুলে ২০১৯ এ লেখা গল্প উদ্ধার করে, পুরস্কারের সার্টিফিকেট বের করে পাল্টা উকিলের চিঠি দেওয়া হল অলোক সুরকে। যখন আর পালানোর পথ পায় না সে। চিঠি লিখে, সোস্যাল মিডিয়ায়
লিখে ক্ষমা-টমা চেয়ে একশা’।
৭
ছবি চুরি
২১ আগষ্ট, ১৯১১। সোমবার ভোর। প্যারিস সবেমাত্র জাগছে। তিন ইতালিয়ান- দুই ভাই ভিনসেঞ্জো ও মাইকেল ল্যান্সেলোত্তি এবং তাদের পরিচিত ছবির ফ্রেম বাঁধানোর কারিগর ভিনসেঞ্জো পেরুজিয়া এসে দাঁড়ালো ল্যুভ মিউজিয়ামের বাইরে। তিনজনেরই পরনে ওভারকোট। পেরুজিয়ার ওভারকোটের নীচ দিয়ে চৌকো মত কি একটা বেরিয়ে আছে। আগষ্টের গরমেও তিনজনের গায়ে ওভারকোট কেন- এসব লক্ষ্য করার জন্য অন্য কোনো লোক আশেপাশে উপস্থিত ছিল না। সপ্তাহান্তের উদ্দাম ছুটির পরে গোটা প্যারিস তখন নিদ্রামগ্ন। মিউজিয়ামের সকালের ষ্টাফেদের কাজে আসার সময় তখনো হয় নি।
তিনজন চুপচাপ ট্রেনে উঠে পড়ল এবং পৌঁছে গেল শহরতলীতে ভিনসেঞ্জো পেরুজিয়ার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে। ওভারকোট খুলতেই বেরোলো একটা চৌকো ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। ছবিটা বিখ্যাত। বিক্রি করে ভালো দাম পাওয়ার আশা আছে। সেই জন্যেই ল্যুভ মিউজিয়ামের প্রাক্তন কর্মী পেরুজিয়া তার দুই শাকরেদকে সঙ্গে নিয়ে এত ঝুঁকি নিয়ে ছবিটা চুরি করল। ল্যুভে ছবির ফ্রেম বাঁধাই করার কাজই এককালে করত সে। আপাততঃ খাটের নীচে একটা ভাঙা ট্রাঙ্কের লুকোনো খোপের ভেতর ছবিটা লুকিয়ে রাখল ভিনসেঞ্জো।
এদিকে সকাল হতেই প্রথমে ল্যুভ, তারপর গোটা প্যারিস জুড়ে প্রবল হইচই। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি-র মোনালিসা ল্যুভের গ্যালারি থেকে চুরি গেছে। ফ্রান্স এবং গোটা ইউরোপে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। যারা জানতো না মোনালিসা কি, তারাও সহজেই জেনে গেল। লিওনার্দো ছবিটা এঁকেছিলেন ১৫০৭ সালে। ১৫১১ সালে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের আমন্ত্রণে প্যারিসে এসে রাজাকে উপহার দিয়েছিলেন মোনালিসা। সেই থেকে তার স্থান হয় ল্যুভের গ্যালারিতে। অবশ্য মাঝে নেপোলিয়ন নিজের শয্যাকক্ষের দেওয়ালে টানিয়ে রেখেছিলেন তাকে। যদিও ১৮৬০ সালের আগে মোনালিসা তত বিখ্যাত ছিল না।
চুরির পর সাতদিন বন্ধ থেকে অবার খুলল ল্যুভ। সারা ফ্রান্স ভেঙে পড়ল মোনালিসার শূন্য ফ্রেম দেখতে। ফ্রাঞ্জ কাফকা-ও ছিলেন সেই দলে। ফরাসীরা সন্দেহ করতে লাগল, আমেরিকানরা অথবা জার্মানরা ফরাসী ঐতিহ্য নষ্ট করার জন্য এটা চুরি করিয়েছে।
সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল মোনালিসা চুরির খবর। নানান তদন্ত হল। পঞ্চাশটার উপর গোয়েন্দা দল গঠন করা হয়েছিল। এমনকি বেশ কয়েকজন শিল্পী, আর্ট ডিলার গ্রেফতার হল, আবার প্রমাণের অভাবে ছাড়াও পেয়ে গেল। বহু বিখ্যাত মানুষকে সন্দেহ করা হয়েছিল মোনালিসা চুরির সাথে যুক্ত বলে। এদের মধ্যে বিশিষ্ট আমেরিকান ধনী জে পি মরগ্যান, জার্মানীর শাসক কাইজার এবং স্বয়ং পাবলো পিকাসো। পিকাসোকে গ্রেফতার করা হবে বলে সারা ইউরোপে রটে গেল। তাই নিয়ে চর্চা চলল নিরন্তর। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হন নি। গ্রেফতার হলেন বিশিষ্ট কবি গুইলিয়ামো অ্যাপোলিনিয়ারে। ছাড়াও পেলেন প্রমাণের অভাবে। দুবছর এভাবে চলার পর যখন সব উত্তেজনা থিতিয়ে এল- আসল চোর ভিনসেঞ্জো পেরুজিয়া ভাবলো – এই সুযোগ। একটা বাক্সের তলার লুকোনো খোপে ছবিটা ভরে নিয়ে ফ্রান্স ছেড়ে নিজের দেশ ইতালিতে ফিরে চলল। ইতালির এ শহর, ও শহরে ঘুরেও কাজ না হওয়াতে কিছুটা হতাশ হয়ে সে ফ্লোরেন্সে গিয়ে দেখা করল নামকরা আর্ট ডিলার আলফ্রেডো জেরি-র সাথে। তাকে ভিনসেঞ্জো বলল, দ্য ভিঞ্চি ছিলেন ইতালীয়। তার শিল্পকর্ম ‘লা জিওকোন্ডা’ (ইতালিয়রা ‘মোনালিসা’ কে এই নামে ডাকে) ইতালীর সম্পত্তি। তাই সে ছবিটা কোনো ইতালির শিল্পসংগ্রাহককে বিক্রি করতে চায়। দাম মাত্র পাঁচ লক্ষ লিরা। এ সব ক্ষেত্রে যেমন হয়, জেরি প্রথমে পেরুজিয়াকে পাত্তাই দিতে চায় নি। পরে কি মনে হতে তাকে ছবিটা তখনকার মত রেখে যেতে বলে। কারণ ছবিটা আসল মোনালিসা কিনা, যাচাই করতে হবে।
পেরুজিয়া উপায়ান্তর না দেখে ছবিটা আলফ্রেডোর জিম্মায় রেখেই নিজের হোটেলে ফিরে যায়। আলফ্রেডো জেরি তক্ষুণি যোগাযোগ করে ফ্লোরেন্সের উফিজি আর্ট গ্যালারির ডিরেক্টর জিওভান্নি পোগ্গির সাথে। দুজনে মিলে ছবিটার পেছনে ল্যুভের ষ্ট্যাম্প দেখে তার সত্যতা যাচাই করার পরে দেরী না করে পুলিশে খবর দেয়। তারপর আর কি? ধরা পড়ে যায় পেরুজিয়া। তার মোনালিসাকে নিজের দেশে ফিরিয়ে আনার তত্ত্ব ধোপে টেঁকেনি। বিচারে পেরুজিয়ার আট মাস কারাদন্ড হয়। তাও পুরো শাস্তি ভোগ করতে হয় নি তাকে। কারণ কয়েকদিনের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
৮
টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, লেখা, গান- এসব চুরি নিয়ে বিস্তর মামলা-মোকদ্দমা হলেও বইচুরি নিয়ে কোনো মোকদ্দমা বা নিদেনপক্ষে নিরামিষ অভিযোগ অবধি শোনা যায় না।
‘আহা, একটা বই-ই তো চুরি করেছে!’
‘বই চুরি করে পড়াশোনা করেছে তো! ভাল কাজ।’
‘বই নিয়েছে। ফেরত দিতে ভুলে গেছে হয়ত। দিয়ে দেবে।’
এই আমি, সারা জীবন যত বই কিনেছি সব যদি আমার কাছে থাকত, বাড়িতে আমার নিজের থাকার জায়গা হত না। কিন্তু বই একজনের কাছে থাকে না। বইয়ের হাত-পা না গজালেও বই চলাফেরা করে। এই বুককেস থেকে সেই বুককেস, এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি চলে বেড়ায়।
আরেকটা চুরি আছে। তাকে চরম রোম্যান্টিকতার সাথে গ্রহণ করা হয়। মন চুরি।
এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে চিঠি লিখছে, ‘আমার মন চুরি করে যে অপরাধ তুমি করেছ, তার শাস্তি বাবদ তোমাকে আমার হৃদয়ের কারাগারে আজীবন কারাদন্ড দিলাম।’
৯
রোগী চুরি
সন্ধ্যে ছটা। ডাক্তার জেমস প্রাইভেট হাসপাতালে তাঁর ওপিডিতে শেষ রোগী দেখছেন। আজ তাঁর ছেলের জন্মদিন। তাই কমসংখ্যক রোগীকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া আছে। বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগতরা অনেকেই এসে গেছে। এবার তিনি উঠবেন। এমন সময় বাইরের ঘর থেকে সেক্রেটারি লরা বলল, আর আধ ঘন্টা বসুন। একজন পেশেন্ট, আপনারই পুরনো এক পেশেন্টের মেয়ে, একটা জরুরী প্রয়োজনে আপনাকে দেখাতে চায়।
‘না, না আজকে আমি পারব না। ওনাকে কালকে আসতে বল।’
‘একবারটি কথা বলবেন ওনার সাথে? উনি লাইনে আছেন।’
‘হুঁ। দাও।’
ডাক্তার জেমস কথা বললেন রোগিনীর সাথে।
‘ডাক্তারবাবু, আমি লরা। আমার মা জুডি আপনার পেশেন্ট। আপনাকে দেখাব বলে দেড়শ কিলোমিটার দূর থেকে আসছি। এসে গেছি প্রায়। আর আধঘন্টা অপেক্ষা করুন প্লিজ।’
আধঘন্টায় হল না। চল্লিশ মিনিট লাগল। ভদ্রমহিলার একটা ছোট অপারেশন লাগবে। পরদিন সকালে অপারেশনের বন্দোবস্ত করে বাড়ি গেলেন ডাক্তার জেমস। রাত্রে জন্মদিনের পার্টির চক্করে হাসপাতালের মেসেজগুলো পড়া হয় নি। সকালে অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছতেই ও টি ম্যানেজার বলল, ‘আজ তো আপনার অপারেশন নেই, মিঃ জেমস!’
তাই তো, তিনি তো কোনো ফোন বা মেসেজ পান নি ও টি থেকে!
‘কেন? লরা স্মিথ নামে এক মহিলার অপারেশন ছিল তো!’
‘উনি তো মিঃ থমাসের আন্ডারে ভর্তি হয়েছেন। এখনই অপারেশন আছে।’
‘ও’
কথার মাঝখানেই মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন ডাক্তার জেমস-এর দিকে।
‘আমি লরার স্বামী। আমরা এখানে এসে শুনলাম ডাক্তার থমাস এই বিষয়ে আরো ভালো বিশেষজ্ঞ। আমরা তো অত জানি না। সবাই বলল। তা-ই….। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লীজ।
ডাক্তার জেমস হনহন্ করে ওটি ছেড়ে নিজের অফিসে চলে গেলেন।
১০
শেষকথা
এই লেখা শেষ করি এক চুরি করা গল্প দিয়ে। এ গল্পটা অনেকেই জানেন।
গাঁয়ের বনেদি বড়লোক পরেশ চ্যাটার্জী ধনী হতে পারেন, কিন্তু ভীষণ কিপটে। তিনি সকাল সকাল তাঁর বাড়ির পাঁচিলের পাশে চেয়ার পেতে বসেছিলেন। শীতের হাল্কা মিঠে রোদ। অঘোর মাষ্টারমশাই পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। চোখাচোখি হতেই তিনি বললেন, ‘আরে, কেমন আছেন চ্যাটার্জী মশাই? মনমরা দেখছি যে !’
‘আর থাকা! গতকাল রাতে চোর এসেছিল বাড়িতে।’
‘সে কি? কি কি নিলো? পুলিশে খবর দিয়েছেন?’
‘ না না, কিছু নিতে পারে নি।’
‘তবে আর মনমরা কেন?’
‘এই দেখুন।’ বাড়ির পাঁচিল দেখিয়ে ইঙ্গিত করলেন।
বাড়ির পাঁচিলে লেখা, “এই বাড়িতে কেউ চুরি করতে এসো না। এ বাড়ির মালিক অত্যন্ত কঞ্জুস। আলমারিতে একটা টাকাও নেই। বাসনগুলো সব মাটির, না হলে কলাই করা। ওয়ার্ডরোবে পুরনো ময়লা কয়েকটা জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই নেই।”
পরেশবাবু বললেন, ‘বলুন, এই অপমান সহ্য করা যায়?’