ঘন অন্ধকারের ভেতর থেকে ত্রিশূল উঁচিয়ে একটা বেঁটে লোক চিৎকার করে উঠলো “এটা ভূত পিচাশীর মন্দির। এখানে একবার ঢুকলে আর বেরুতি পারবা না”
একটা হাহা করা ফাঁকা মাঠে কেবল একটা মাত্র মন্দির। চারপাশে কোথাও কোনও বাড়িঘর নেই। কেবল অ-সমান পাথুরে জমি। ভাঙাচোরা দেওয়াল থেকে অজানা গাছেরা লতিয়ে আছে, আলো নেই, বাতাস আসার এতটুকু ফাঁক ফোঁকর নেই। টুবানের দমবন্ধ হয়ে আসছে – বেঁটে লোকটা ত্রিশূলটা ওর বুকের দিকে তাক করলো। টুবান ঘামছে। কোথা থেকে যেন আলো পড়ে বেঁটে সন্ন্যাসীর টাকটা চকচক করছে। অন্ধকার থেকে আরো অন্ধকার এই মন্দির। টুবান দৌড়তে লাগলো – একটার পর একটা ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে। সবশেষে বেরোনোর দরজা।
বাইরে দরজার সামনেই ঘন অন্ধকারে একটা ঢেউতোলা উদ্দাম নদী ভীষণ স্রোতে বয়ে চলেছে – অথচ নিঃশব্দে। আশেপাশে অনেক অনেক বাড়ি – সবকটাই জনশূন্য অন্ধকার – টুবান যে বাড়িতেই ঢোকে – কেউ নেই শুধু শূন্যতা – আর নিঃশব্দচরণ সেই সর্বত্রগামী সন্ন্যাসী বাতাসের থেকে দ্রুতগতিতে টুবানের পেছনে পেছনে ধাওয়া করছে। টুবান লাফ দিয়ে ওঠে গোটা শরীর ঘামে ভেজা। জানালায় রাখা জলের বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে জল খায়। বাইরে আলো ফুটেছে। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। মুখটা তেঁতো হয়ে গেছে। ফ্যানের হাওয়া গায়ে লাগছে না। দমবন্ধ লাগছে। বাইরে আকাশ মেঘে ঢাকা। একটু সময় বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
আজ সোমবার – কাল আড্ডা মেরে ফিরে আর প্রজেক্ট শেষ হয়নি। মাড়ি – হাতের মাসল সব টনটন করছে। এরকম হলে মা বলে গা হাত পা চিবোচ্ছে। মনে হয় জ্বর আসবে। নাক গলা সব জ্বালা করছে। রান্নাঘরে খুটখাট- মাধবীদিদি এসে গেছে। মায়ের ঘর থেকে পার্ফ্যুমের গন্ধ – আজকে তো মা ট্যুরে যাবে। এই উইক এন্ডে বাবা আসবে। বাবা এখন আসামে। সেলসের কাজে।
কালরাতে বাবা ফোন করেছিলো “টুবান, ক্যামন আছিস?”
তখন তো জ্বর ছিলো না – ভালো ছিলো। এখন বাবা অফিসের জন্যে রেডি হচ্ছে; টুবান এখন ফোন করবে না। বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
মা বললো “টুবান দরজাটা খুলে দেতো। মনে হচ্ছে বাসু এসে গেছে।” বাসু মায়ের অফিস কলিগ। বেল বাজলো। টুবান গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
“হাই টুবান, হাও ইজ লাইফ আন্ডার দ্য স্কাই”?
টুবান একটু হেসে ঘাড় নাড়লো। মিস্টার বাসু বেঁটেখাটো একজন মানুষ। অল্প ভুঁড়ি আছে। আর একমাথা টাক। টুবান এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ওর সত্যিই জ্বর আসছে। সব দরজা জানালা ক্যালেন্ডার ঘড়ি মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। শরীরটা শিরশির করছে- ঠান্ডা লাগছে , পায়ের পাতা দুটো হিম শীতল। ও বেডকভারটা গায়ে টেনে গুটিসুটি পাকিয়ে শুয়ে পড়লো।
মাধবীদিদি চা নিয়ে এলো “দাদাভাই এই চা রাখলাম- খেয়ে নিয়ো নৈলে জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে ….. ওঃ বাবারে বাবা, আবার কে বেল বাজায় রে বাবা?”
টুবান জানে ঠিকে কাজের মেয়েটা এসেছে- রাখী। ও বালিশটা দেওয়ালে ঠেকিয়ে হ্যালান দিয়ে বসে চায়ের কাপটা দুহাতে চেপে ধরে। চায়ের কাপের এই উষ্ণতাটুকুও ভালো লাগছে- তারপর চুমুক দেয়।
“টুবান বাবা … সোনা হয়ে থাকবে- আমার আসতে আসতে তো বুধবার হবে- সব পড়া করে রাখবে- আজ তো ইভনিংএ ম্যাথ্সের ট্যুশন- ন্যো মোর টাইম ওয়েস্ট টুবান- মনে রেখো তুমি এখন ক্লাস টেন- সময়ে খেয়ে নেবে কেমন? ফ্রিজে খাবার থাকবে ……. ব্বাই টেক কেয়ার”
টুবান কাপটা নামিয়ে রেখে হাত নাড়ে। দরজা টেনে দেওয়ার শব্দ। ল্যান্ডিং থেকে দুজনের গলার আওয়াজ লিফ্টের দরজায় ঢাকা পড়ে যায়।
মাধবীদিদি একটু পরে ডাক পাড়ে “দাদাভাই বেকফাশ রেডি- টেবিলে রাখলাম খেয়ে নাও- আর ভাত টাত সব ঢাকা দে’ রাখলাম; খেয়ে পরে ইস্কুলে যেও ….. সদর দরজার ছিটকিনিটা দে’ যাও …”
সকাল সাতটা বাজে টুবানের শরীরটা ভেঙে আসছে। ও মোবাইলটা চার্জ থেকে খুলে ফোন করে “শরণ্য? তুই আজ স্কুল যাবি?” …..
“শোন না ভাই তাহলে আমার জন্যে একটু নোটস টোটসগুলো নিয়ে আসিস। আমি তো আজকে বাঙ্ক মারছি” …..
“না রে ভাই, আমার আজ শরীরটা বিগড়েছে, বোধহয় জ্বর আসছে- হেব্বি গায়ে ব্যথা”
শরণ্য কিছু একটা বলে তারপর টুবান “চল ভাই” বলে ফোন কেটে দেয়। ফোন রাখতে না রাখতেই আরেকটা ফোন আসে। এবার ম্যাথ্সের স্যর।
“স্যর অরিত্র বলছি ….. না স্যর জেগে আছি … আচ্ছা স্যর …. তাহলে আজ হবে না …. ঠিক আছে স্যর পরে জেনে নেবো …হ্যাঁ আমি বিজলী মিত্রাক্ষর আর নবারুণকে জানিয়ে দেবো। ওদের নম্বর আমার কাছে আছে আর বলবো বাকিদের জানিয়ে দিতে … ঠিক আছে স্যর .. হ্যাঁ হ্যাঁ রাখছি স্যর। গুড ডে …” টুবান ফোনটোন করা সেরে মাথা পর্যন্ত চাদরটা টেনে নিলো। টোস্ট ডিম সব কিছু ভুলে কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে পড়লো।
হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলো অথবা জ্বরের ঠ্যালায় আচ্ছন্ন হয়েছিলো। যখন উঠলো তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। খট খট করছে রোদ। জানালার ফাঁকে ফাঁকে জনশূণ্য রাস্তা। গলার ব্যথাটা বেড়েছে। ঠান্ডা লাগা ভাবটা কমেছে। কিন্তু জ্বর বোধহয় আরও বেড়েছে। তবু ক্ষিধে ক্ষিধে লাগছে। টুবান উঠে ডাইনিং টেবিলে বসলো। ইচ্ছে হচ্ছে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা রুটি আর আদার কুচি দিয়ে আলু পেঁয়াজভাজা খেতে- যেমন ছোটবেলায় শীতকালে লেপ থেকে বেরিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে খেতো। এখনও ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে ভাত খেতে ইচ্ছেই করছে না- হাত বাড়িয়ে ডিমসেদ্ধ আর দু পিস ঠান্ডা পাঁউরুটি নিজের কাছে টেনে নিলো। খেয়ে উঠে জলের বোতলটা বগলদাবা করে বিছানায় এসে বসলো। জানালায় বোতলটা রেখে বাইরে তাকিয়েছিলো। একেবারে কিচ্ছুটি না ভেবে। আর ঘুম পাচ্ছে না। বাইরে ছায়া লম্বা লম্বা হয়ে এসেছে। একটু পরে বাড়ির ছায়া এসে রাস্তার রোদটুকু মুছে দিলো। টুবানের বড়ো অস্থির লাগছে – ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝেই এরকম হয়। আজ বোধহয় জ্বর বলেই আরও খারাপ লাগছে। ও মোবাইলটা খুলে একটা পর্নো ভিডিও বার করলো। একটুও ভালো লাগলো না।
রাস্তা দিয়ে একটা বাচ্চা ছেলের হাত ধরে ওর মা যাচ্ছে। বাচ্চাটা ওপর দিকে মুখ তুলে মাকে কিছু বলছে। মা ওকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়েই যাচ্ছে। একটা ছেলে স্কুল থেকে ফিরছে- বাবার সাইকেলের রডে বসে। বাবার কাঁধে স্কুল ব্যাগটা। টুবান সাইকেলের চেইনের কির কির আওয়াজটা শুনতে পায়। হঠাৎ বিরাট একটা ঘড়ঘড় শব্দে টুবান চমকে ওঠে। সামনের দোকানটা খুলছে- শাটার তোলার আওয়াজ। একটা বাইক ঘটঘট শব্দ করে চলে গেল। একটা কুকুর খানিকটা ওটার পেছন পেছনে দৌড়ে আবার থেমে গেল। সামনের ইলেকট্রিক তারে অনেক কাক বসেছে। আরও আসছে। কোনও বাড়িতে সন্ধে দিচ্ছে। ঘন্টার শব্দ- শাঁখ বাজছে। ঘোর রোদ্দুরের দুপুর – চারপাশে কোথাও কোনও গাছ নেই- ছায়া নেই। একটা সাইকেল চলছে। পেছনের কেরিয়ারে একটা চাদর ভাঁজ করে তার ওপরে একটা বাচ্চা বসে আছে। পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরেছে। সাইকেল চলছে- কিরকির কিরকির শব্দ করে। সাইকেল চালকের মাথা দিয়ে ঘাম পড়ছে, পিঠের জামা ঘামে ভেজা। পেছন থেকে কে যেন ডাকছে “দাদা ওও দাদা, বাচ্চার চটি খুলে পড়ে গেছে।”
“ও বাবা , বাবা আমার চটি …” সাইকেল স্ট্যান্ড করে রেখে বাবা ছেলেটাকে বসিয়ে চটি কুড়িয়ে আনে। দূরে একটা চায়ের দোকানে বসে দুজনে চা বিস্কুট।
“ঈস ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় চলে গেছিলে? ঘেমে লাল হয়ে গেছে…….” মা বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। কারেন্ট নেই। জামা খুলে হাওয়া করে।
টুবানের বড্ড খারাপ লাগছে। গলার ব্যথাটা বাড়ছে। রাস্তায় আলো জ্বলে উঠলো। মোবাইল বাজছে।
“হ্যালো মা? ………. না স্কুলে যাই নি …….. মানে -আমার সত্যিই শরীর খারাপ হয়েছে ……….” অনেকক্ষণ বকা খেতে খেতে টুবান ফোনটা কেটে দেয়। আরেঃ তরকারিগুলো ফ্রিজে ঢোকানো হয়নি। টুবান উঠে আসে। ফ্রিজের ভেতর বাবার রেখে যাওয়া দুটো মদের বোতল চোখে পড়ে। ফ্রিজ বন্ধ করে বাবার ঘরে যায়।টেবিলে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর একটা নীল লাইটার। টুবান সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে গন্ধ শোঁকে। মন খারাপটা বেড়ে যায়। ড্রয়ারের নিচের শেলফে আরও কয়েকটা বোতল রাখা। সিগারেটের প্যাকেটটা রেখে আবার এসে বিছানায় বসে।
ফোনে বাবার মিসকল দেখাচ্ছে। ও ফোনটা তুলে রিং করে।
“হ্যালো বাবা ফোন করেছিলে? ..……..না আমার শরীরটা ভালো ছিলো না বাবা তাই……………….হ্যাঁ বাবা, বড়ো তো হয়েই গেছি ……………. বাবা?”
বাবা ফোন কেটে দিয়েছে। ধুস্ শালা। টুবান উঠে বাবার ঘরে গিয়ে একটা বোতল আর সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে আসে। তারপর গ্লাস; আর জলের বোতল তো ছিলোই। গ্লাসে মদটা ঢেলে- ও জানে এটা ভোডকা- জল মেশালো বাবার মতোন, বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে ঠোঁটে লাগালো। তারপর লাইটার। শব্দহীন ধোঁয়া পাক খেয়ে উড়ে যায়। গ্লাসের পানীয় শেষ হয়ে আসে। টুবান ঘুমিয়ে পড়েছে। যখন ঘুম ভাঙলো তখন মধ্যরাত। অল্প করে ভাত আর চিকেন কারি নিয়ে মাইক্রোওয়েভে গরম করে যতটুকু পারলো খেলো। তারপর উঠে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বসলো। এখনও মাথাটায় বাজিং হচ্ছে। টিপসি তো বটেই। বাবার সিগারেটের ব্র্যান্ডটা ভালো -না হলে টুবানের কাশি হয়। থালাটা সিঙ্কে রেখে এসে সিগারেটটা শেষ করে। এখন আর জ্বর জ্বর লাগছে না। শুধু ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে।
তারপর ভাবলো শরণ্য বুধোদের কাল একটা সারপ্রাইজ দেবে। নিজের ওয়াটার বটলটায় বেশ খানিক ভোডকা আর জল মিশিয়ে রেখে দিলো। কাল স্কুলে নিয়ে যাবে। মাথার বাজিংটা কমেনি। ফ্যানটা চালিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে টুবান শুয়ে পড়লো।
“বাই গড- এটা শুধু জল নয় ভোডকা মেশানো আছে। ভোডকা বুঝিস? রাশ্যান মেইন অ্যালকোহলিক বেভারেজ”
শরণ্য ঢাকনাটা খুলে শুঁকে দেখলো তারপর এক ঢোঁক খেলো “জেনুইন”
“দে আমি মেরে দিই” বুধো বললো।
টুবান মানে অরিত্র বললো “ভাই সামলে খাস, কেস খাওয়াস না”
বুধো মানে বুধাদিত্য ওয়াটার বটলটা নিয়ে বললো “চাপ নেই ভাই; ওব্যেস আছে- দেখবি?” ওয়াটার বটলটা নিজের মুখে উপুড় করে দেয়। বুধো কিন্তু সামলাতে পারেনি। বমি করে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
টুবান সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছে। টুবান বড়ো হয়ে গেছে। ও কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি। না রেক্টরস্যরের, না অন্য টিচারদের, না মা-বাবার। পেছনে পেছনে মা বাবা। আজ সব কাজ ফেলে চলে এসেছে। টুবান আজকে বড়ো হয়ে গেলো।
অনবদ্য
ধন্যবাদ ভাই।পরিশ্রম সার্থক।