এক নম্বর গল্প
একটা ছোট্ট কার্নিভ্যালের মতো। একটা মৃতপ্রায় সিনেমা হলের সামনে একটা ছোটোমতো শান বাঁধানো জায়গা আছে। তার দুপাশে দোকানের সারি। একপাশে ছোটো ছোটো দোকান। অন্যপাশে ফ্ল্যাটের তলায় কয়েকটা দোকান। ফুচকাওয়ালা ভজুয়া আছে– বিদ্যুৎশিল্পী হাবুলবাবু আছেন তাঁর বিখ্যাত পান নিয়ে– একটা সেলুন আছে– কাচের দোকান– হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান- মনোজের চায়ের দোকান- এমনকি একটা মদের দোকান আর বারও আছে।
সন্ধেবেলা ঐ শান বাঁধানো জায়গায় বহু কমবয়সী মাঝবয়সী বুড়োবয়সী মানুষ এখানে আড্ডায় আসে। সব দোকানের এলইডি আর চৈনিক টুনির আলোয় চারপাশ ঝকমক করে। ফুচকার দোকানে ভিড় জমে। সামনের বড়ো রাস্তা দিয়ে হৈহৈ করে বাস অটো আর প্রাইভেট গাড়ি দৌড়ে যায়।
একদিন হঠাৎ করে একটা অটো এসে ঐ জায়গাটায় ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়লো। একটি সন্ত্রস্ত অটোবালক হাতের লাল শালু উড়িয়ে উড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে করতে ঘ্যাচাং করে ব্রেক কষে দাঁড়ালো। ফলতঃ অনেকেই জমা হয় ঐ তিনচাকার চারপাশে। কয়েকজন মিলে পেছনের সীটে শায়িত একটা মানবশরীর টেনে হিঁচড়ে নামায়। আমাদের টেকো বুড়ো, টিয়াপাখি নাকওয়ালা হাতুড়ে ভীড় টীড় ঠেলে কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত হন। মানুষটির শরীরে প্রাণের স্পন্দন ক্রমশঃ মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘেমে ওঠা একটা অজ্ঞান পুরুষ মানুষ। পরনে অতি সাধারণ– বলা যায় দীন দরিদ্রের পোষাক। মুখে সপ্তাহের না কামানো দাড়ি গোঁফ। মুখচোখ নীলচে। দাঁতে দাঁত আটকে আছে। চোখের মণি এক বিন্দুতে আটকানো। নাড়ি প্রায় পাওয়াই যায় না। আমাদের হাতুড়েবাবু মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটার সবকটা পকেট হাতড়াচ্ছেন। সবাই আশ্চর্জি মেনে গেল। হাতুড়ে পাগল জানা ছিলো কিন্তু পাকা পকেটমারও যে সেটা জানা ছিলো না। ওনার স্টেথোস্কোপ প্রেসার যন্ত্র সব মাটিতে পড়ে আছে উনি ঘেমো নোংরা রুমাল, ছেঁড়া কাগজে লেখা ফোন নাম্বার, বাসের টিকিট সব হাৎড়িয়ে বার করছেন আর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। অবশেষে মানি ব্যাগটা খুঁজে পেয়ে প্রথমে কাগজের নোট গুলো পাশে ছড়িয়ে ফেললেন। তারপর একটা টিপ বোতাম দেওয়া খাপ খুলে খুচরোগুলো পাশে ছড়িয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে উল্টো দিকের ওষুধের দোকানের বিক্রয়বালক একটা প্রেসার যন্ত্র নিয়ে হাজির। এ্যামন সময় হাতুড়ে একটা রাংতা মোড়া ওষুধের পাতা খুঁজে পেয়ে চশমার কাছে এনে পড়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। তারপর চোখ তুলে ওষুধের বিক্রয়বালককে দেখতে পেয়ে দুটো ইঞ্জেকশনের নাম বললেন। ছেলেটা উড়ন তুবড়ির মতো অটোর ফাঁক দিয়ে– গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে গেল। তারপর ক্ষণিকের মধ্যেই আবার বিদ্যুতের মতো দুটো ইঞ্জেকশন আর সিরিঞ্জ নিয়ে হাজির। হাতুড়ে শীর্ণ ক্ষীণকায় লোকটির শিরার ইঞ্জেকশন ফুঁড়ে নিজের কপালের ঘাম মুছে অজ্ঞান মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আস্তে আস্তে তার মুখের পেশী স্বাভাবিক হয়ে এলো। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ছন্দময় হয়ে উঠলো। হাতুড়ে হাতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মনোজের চায়ের দোকানের দিকে তাকানোর আগেই মনোজ একটা এ্যালুমিনিয়ামের থালায় করে চায়ের গেলাস নিয়ে হাজির। হাতুড়ে চায়ের গেলাসে ফুঁ দিতে দিতে বললেন “এপিলেপ্সি। স্টেটাস এপিলেপ্টিকাস”।
জনগণ জানে হাতুড়ে ছিটগ্রস্ত তাই ওনার বুগবুলবুলি ভাষায় মনোযোগ না দিয়ে ঐ অটোতে করেই লোকটিকে নিয়ে এবার নিকটবর্তী হাসপাতালের উদ্দেশে রওয়ানা দিলো।
দুনম্বরী গল্প
ষষ্ঠীর দুপুর। রাস্তায় শিউলি- দুগ্গা পুজো আর জমা জলের গন্ধ– আকাশে কখনো মেঘ কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি। হাতুড়ে ছানটান করে ভোলার দোকানে দুটি ভাত খেতে চলেছেন– আজ আবার কচি পাঁঠার ঝোল– এইসব দোকানে দুষ্প্রাপ্য খাদ্য। একটা খাল– যদিও স্থানীয় বর্জ্য পদার্থের খুশবুতে খুশবুদার– তবুও লোকজন কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে মা গঙ্গার অংশ। তার দুপাশে রাস্তা চলেছে সমান্তরাল ভাবে। দুটো রাস্তাকে জুড়েছে একটা কালভার্ট। তার একপাশে একটা খুব মোটা সোটা জলের পাইপ। জল সরবরাহের সময় তার দুর্বল জোড়গুলো থেকে ফোয়ারার মতো জলধারা তৈরি হয়। আর হাতুড়ে আর অন্যান্য জনসাধারণ সেই পাইপের ওপর বসে বিড়ি টিড়ি খায়।
হাতুড়ে হেঁটে হেঁটে ভোলার দোকানে যাচ্ছেন এ্যামন সময় দেখা গ্যালো দূরে একটা সাইকেল আসছে। আরোহী একজন অতি রোগা– চামড়ার তলায় বিন্দুমাত্র চর্বি না থাকা এক নামাবলী ধারী বৃদ্ধ – তিনি তীব্র মাতালের মতো সাইকেল চালাচ্ছেন। একবার ডানদিকে, তো একবার বাঁদিকে। হাতুড়ের হঠাৎ করে জয় বাবা ফেলুনাথের ঐ দৃশ্যটা মনে পড়লো। ছুরিবিদ্ধ বৃদ্ধ মূর্তিশিল্পী (সম্ভবতঃ শশীবাবু) দেওয়াল ধরে ধরে আসছেন আর ফেলুদা আবৃত্তি করছে ‘বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু’। হাতুড়ে যতদূর সম্ভব দ্রুত গতিতে বৃদ্ধের কাছে পৌঁছতেই বৃদ্ধ হাত পা ছেড়ে দিলেন। সাইকেল গড়িয়ে একদিকে চলে গেল আর হাতুড়ের বজ্রবন্ধনে বৃদ্ধ লটপটকে রইলেন। হাতুড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বুড়োকে ঐ মস্তো পাইপে বসানোর আগেই বৃদ্ধ ছ্যার্ছ্যারিয়ে হিসি করে সদ্যস্নাত হাতুড়েকে ভিজিয়ে দিলেন। “আপনার কি শুগার আছে? ওষুধ খান?” অর্ধনিমীলিত চোখে স্খলিত কন্ঠে বৃদ্ধ বললেন “হ্যাঁ” হাতুড়ে ভেবে নিলেন এই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ সকাল থেকেই নিরম্বু উপবাস করেছেন- ব্যতিক্রম শুধু সুগারের ওষুধটি। ষষ্ঠীর সকাল থেকে মৃন্ময়ী মূর্তির আরাধনায় নিজেরই ষষ্ঠী পুজো করে ফেলেছেন। এখন আর সময় নেই। পুরোহিতবাবু কোমায় গিয়ে ফুলস্টপ হওয়ার আগেই ওনাকে একটু চিনি খাওয়াতে হবে। এক মস্তো তুড়িলাফ দিয়ে বিমলবাবুর চায়ের দোকান থেকে এক খাবলা চিনি নিয়ে এসে বুড়োকে একটু একটু করে মুখে চিনি দিতে লাগলেন। ইতিমধ্যে পুজোমন্ডপে আড্ডারত সুবেশ যুবকেরা সব এসে গেছে। হাতুড়ে জীবনে প্রথমবার নিজে একটাও না খেয়ে অন্যের জন্য সন্দেশ কিনলেন। তারপর? একটা ছেলে পুরোহিতবাবুর সাইকেল চালিয়ে নিয়ে গেল আর একজন বুড়োকে রিক্সা করে বাড়ি পৌঁছতে গেল। হাতুড়ে চললেন ভোলার দোকানে। ওখানে আজ পাঁঠার মাংস আছে। দেরী করলে খৎম হয়ে যাবে।
গল্প যখন তিন নম্বর
এক সন্ধ্যায় আমাদের বুড়ো হাতুড়ে নিজের খুপরিতে রোগীর অপেক্ষায় বসে আছেন। এ্যামন সময়ে একজন বৃদ্ধা এক সদাহাস্যময় টেকো দীর্ঘনাসা শ্বেতশুভ্র দাড়িগোঁফওয়ালা বৃদ্ধকে নিয়ে খুপ্রির দরজা দিয়ে উঁকি দিলেন। নমস্কার বিনিময়ের পর হাতুড়ে ভুরু নাচালেন “কী কেস?” বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে বুড়োকে দ্যাখালেন। হাতুড়ে ভুরু আর চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন “কী কষ্ট?” বৃদ্ধ টেবিলে আঙ্গুল ঘসতে ঘসতে নিষ্পাপ হাসলেন।
“নাম কি ?”
ভদ্রমহিলা বললেন “অতীশ ঘোষ”, তারপর গলা নামিয়ে বললেন “সব ভুলে গেছেন …. কিচ্ছু মনে নেই ….”
হাতুড়ে একটু হতাশ হলেন “এর তো কোনও ওষুধ নেই … কিচ্ছু না ….”
“তাহলে কী করবো?”
“ওনাকে আনন্দে রাখুন … স্নেহে ডুবিয়ে রাখুন … পারলে একটা কুকুর পুষুন … ওরা খুব ভালো সঙ্গ দিতে পারে …. গান শোনান …. পুরোনো দিনের গল্প…..” তারপর বুড়োর দিকে তাকিয়ে বললেন
“কোন স্কুল থেকে পাস দিয়েছেন?”
বুড়োর হাসি আরও চওড়া হলো “হিমালয়”, বুড়ির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
হাতুড়ে ওনার গৎবাঁধা প্রশ্ন করতে থাকেন “বাড়িতে কী কী কাগজ রাখেন?”
বুড়ো খানিক ভাবলেন তারপর বললেন “অমৃতবাজার…অমৃত… যুগান্তর….আর…. আর……” বৃদ্ধ স্মৃতির অতলে হাৎড়াতে থাকেন।
“আজ দুপুরে কী খেয়েছেন?”
বুড়ো নিশ্চিন্তে উত্তর দ্যান “ভাত”
“আর কী?”
বৃদ্ধের হাত কাঁপতে থাকে। মনে পড়ছে না।
হাতুড়ে অবসন্ন হয়ে প্রশ্ন করেন “কোথায় থাকেন? ঠিকানা বলতে পারবেন কি?”
সব চুপচাপ।
হাতুড়ে বলেন “দিদিমণি আজ বাড়ি ফিরেই একটা কাগজে নাম ঠিকানা লিখে একটা লকেটে ভরে ওনার গলায় ঝুলিয়ে দেবেন …. সোনা রূপোর কিছু নয় – সস্তা কোনও ইমিটেশন জাতীয় কিছু …”
হতাশ হাতুড়েবাবু কপালের ঘাম মোছেন।
বুড়ি বলেন “ভাই আপনি একটা এমআরআই করিয়ে দেবেন … যদি কিছু…”
হাতুড়ে বোঝান “দিদিমণি কিচ্ছু পাওয়া যাবে না …”
অবশেষে হার মেনে এমআরআই করার ব্যবস্থা করে দ্যান মানে একজন তার নিজের গাড়িতে করে এমআরআই করাতে নিয়ে যাবে সেটারও ব্যবস্থা করে দ্যান।
কিছুদিন পরে সেই বৃদ্ধা আর গাড়ির মালিক এসে হাজির। “দাদা, ঐ ভদ্রলোক হারিয়ে গেছে”
“ভাই, উনি সিগারেট কিনতে গিয়ে আর ফেরেন নি”
হাতুড়ের গোটা পৃথিবী আবছা হয়ে গেল।….. চৈত্রের বাতাসে শিমুলের তুলো ভেসে যায়– উঁচু পাড় দেওয়া পুকুরে মেয়েরা চান করে– বাসন মাজে– লালমাটির ধুলোয় লাল হওয়া সাদা দাড়ি আর হাঁটু অবধি ধুলোমাখা বুড়ো হেঁটে হেঁটে চলে যায়। চৈত্র মাসের তারায় ভরা রাতে এক স্মৃতিহারা বুড়ো ভুলে যাওয়া ঠিকানা খুঁজে ফেরে – শালবন বিস্তীর্ণ পৃথিবী পার হয়ে হয়ে ….
পরিশিষ্ট :- সব কিছু শুধুমাত্র কিছু দরকারি কাগজ নিজের কাছে না রাখার জন্য। এই অভাগা হাতুড়েদের দয়া করুন। যাদের গুরুতর অসুখ আছে প্রয়োজনীয় কাগজটুকু নিজের সঙ্গে রাখুন। সময়ের ভীড়ে স্মৃতি হয়ে যাবেন না।