আবারও একবার প্রহৃত চিকিৎসক, এই খবর এখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর কারণ খুঁজতে গেলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে যার বিশদ বিবরণ ওয়াকিবহাল মানুষেরা ইতিমধ্যেই জানেন। একটা বড় কারণ আমি মনে করি, প্রশাসনিক ঔদাসীন্য, যেটা আবার হয়তো অনেকটাই ইচ্ছাকৃত। অন্য কারণ যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা অবশ্যই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, কারণ শুধু ডাক্তার-নিগ্রহই নয়, খুন-ধর্ষণ ইত্যাদি বিভিন্ন সমাজবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। কিন্তু চিকিৎসক নিগ্রহের সাথে বাকি অপরাধগুলোর মূল পার্থক্য হলো, ডাক্তার পিটিয়ে মানুষ বুক ফুলিয়ে সমাজে বলে বেড়াতে পারে এবং তার সমর্থনেও লোকের অভাব হয় না। তাই বোধ হয় আজ এপার আর ওপারের অর্থাৎ ডাক্তার আর যারা অ-ডাক্তার, তাদের মধ্যে মানসিক দূরত্বটা কমানোর চেষ্টা করার সময় এসেছে।
একজন সাধারণ ছাত্র যখন ডাক্তারি পড়তে আসে, তার চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। সত্যি বলতে কি ডাক্তারি পড়তে পড়তেও স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকে। কিন্তু ইন্টার্নশিপ থেকেই স্বপ্নের দুনিয়া থেকে আমরা বাস্তবের রুক্ষ জমিতে এসে পড়ি, এই রুক্ষ জমিটাই হলো এপার। ওপার থেকে এপারের ‘সর্বসুখ’ দৃশ্যমান হলেও আদপে সেটা একেবারেই সত্যি নয়।
প্রথম কথা, পরিকাঠামো। এই সমস্যা শুধু ভারতবর্ষের নয়, সমস্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশের। এর মধ্যে ডাক্তারের সংখ্যা, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা, হাসপাতালে বেডের সংখ্যা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সব খুঁটিনাটিই পড়ে। একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে শ’য়-শ’য় রোগী, মেঝেতে শুয়ে ধুঁকতে থাকা রোগী- এই পরিস্থিতিতে কোনো দেশেই উন্নত পরিষেবা আশা করা যায় না।
দ্বিতীয় কথা, অনিশ্চয়তা। ডাক্তারি শাস্ত্র গণিতের নিয়মে চলে না। সঠিক রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসার পরেও যে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই কঠিন সত্যটা কেউই বুঝতে চান না। ঠিক একই কারণে কবিগুরুর অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়েও তৎকালীন বরেণ্য চিকিৎসকরা আজও সমালোচিত হন। আসলে এটার বদলে ওটা করলে ঘটনাটা কী দাঁড়াত সেটা কেউই জানে না। কোনো রোগীকে মেরে ফেলার মানসিকতা কারো মধ্যেই থাকে না। আর রোগীমৃত্যু মানেই গাফিলতি নয়, এটা বোঝার পরিণতিবোধ-টুকু যদি এই সমাজের না থাকে- তবে অচিরেই ভালো ডাক্তারি পরিষেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কেউ আর থাকবে না।
তৃতীয় কথা, অর্থনৈতিক বাধা। ভারতবর্ষের স্বাস্থ্য-বাজেটে সকলের জন্যে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাটুকুই বরাদ্দ করা সম্ভব, আধুনিকতর চিকিৎসার জন্যে আরো অনেক অনেক অর্থ লগ্নি প্রয়োজন। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে, নিত্য নতুন আবিষ্কার, ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি- সেসব আমাদের দেশের পটভূমিকায় সব ক্ষেত্রে সম্ভবপর নয়। তার মধ্যেও ভেবে দেখুন গত অর্ধশতাব্দীতে ভারতের গড় আয়ু কী পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে!
ভারতবর্ষের প্রত্যেকজন ডাক্তার, যাঁরা রোগী পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত আছেন; কোনো না কোনো ভাবে এরকম গুচ্ছের বিপত্তি পেরিয়ে আপনাকে আপনার বাজেটের মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ভারতের মতো সুলভ স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বের আর কোনো দেশে রয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। এই প্রত্যেকজন ডাক্তারই নির্দিষ্ট সময়সীমার অনেক বেশি সময় পরিষেবা দিতে বাধ্য হন, দেশের এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে যথাযথ পরিষেবা দেওয়ার জন্যে। এদের প্রত্যেকেই অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন, ইচ্ছা হলে বিদেশে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে খোঁজ নিতে পারেন।
তবে রোগী প্রতারণার ঘটনা কি ঘটে না? অবশ্যই ঘটে। প্রত্যেক জীবিকাতেই এরকম কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকে। চিকিৎসাক্ষেত্রে সব থেকে বড় সমস্যা হলো, ডাক্তার সেজে প্রচুর হাতুড়ে রমরমিয়ে ব্যবসা পেতেছেন, এদের উপর রাশ টানা আশু প্রয়োজন।
ভবিষ্যতে উন্নততর চিকিৎসাব্যবস্থার জন্যে আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার সম্বন্ধে ‘ওপার’-র লোকদেরও সচেতন হতে হবে এবং সেই দাবি জানাতে হবে। এই বিপত্তিগুলোকে একসাথে সরানোর চেষ্টা না করে যদি উল্টে ডাক্তার-নিগ্রহ করেন, তবে আমাদের শেষের দিন আগতপ্রায়।
রবীন্দ্রনাথকে সুপ্রাপিউবিক সিস্টোস্টমি করে ক্যাথেটার পরানো হয়েছিল । এটা ঘরেই করা যায়/ হয়েছিল । পরে ইনফেকশন বেড়ে মৃত্যু ঘটে । কেননা কবি প্রথম থেকে এর আগে পর্যন্ত মূলতঃ হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করতেন ।