আমরা যারা সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার, তাদের আরেক নাম রক্তচোষা ডাক্তার।
ঠিক দাঁত দিয়ে না ফুটো করলেও, আমাদের সঙ্গে থাকে নিডল্ আর সিরিঞ্জ। হাতে বেশ কয়েকটা লাল-নীল-বেগুনি ভায়াল। পাঁচ ক্রোশ দূরের বেডে বসে মা তার ছেলেকে ঘুম পাড়ায়, বলে ঘুমিয়ে পড় নইলে এসে সূচ ফুটিয়ে দেবে। দূর থেকে একহাতে রিকুইজিশন পেপার আর একহাতে সিরিঞ্জ-ভায়াল সমেত আমাদের আসতে দেখলেই পেশেন্টের ঘরের লোকের মুখ ব্যাজার হয়ে ওঠে। ওই এসেছে, আবার ফোটাবে, আর রক্ত টেনে নেবে!
ওয়ার্ডের দায়িত্ব থাকে না আমাদের হাতে তেমন, শুধু পকেটে থাকে ওয়ার্কলিস্টের দোমড়ানো কাগজ। পেশেন্ট পার্টিও জানে ‘কবে ছুটি হবে’ এই অনন্ত প্রশ্নের জবাব এই ডাক্তারদের কাছে নেই, জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যাবে ‘রাউন্ডে এলে বড় ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করে নেবে’। সময়ে সময়ে এই ছোটো ডাক্তারবাবুর পরিচয়ও থাকে না, বরং আমরা হয়ে উঠি ‘ব্লাড টানা দাদা’। আর এই দিনগত পাপক্ষয় করতে করতে আমরা পেশেন্টের বেড নাম্বার মুখস্ত করে ফেলি, মুখ চিনে ফেলি, তার থেকেও বেশি চিনে ফেলি তার হাতের শিরা। কতো রকমের হাত হয়, আর কতো রকমের শিরা, তার বিন্যাস! চেনা হয়ে ওঠে কয়েক বছরেরই।
অত্যধিক মোটা, যার ভালো নাম obese, লোকজনের শিরা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, এতো এতো সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাটের তলায় শিরারা লুকোচুরি খেলে। আব্বুলিশ শব্দ কান চেপে ধরে আটকে দিই, তারপর শিরা খুঁজতে থাকি প্রাণপণে। যাদের অনেক বয়স, বুড়ো বা বুড়ি, তাদের চামড়া ঝোলা অথচ চকচকে, উপর থেকে দেখা যায় নীলচে রঙের রেখা, যেন জীবনরূপী নীলনদ বয়ে চলেছে মিশরীয় শরীরের ভাঁজ বেয়ে। দেখে মনে হয়, এই তো কত্তো সোজা; গ্লাভস বাঁধো কষে, দুতিনবার চাপড় মারো, তাহলেই সূচ ঢুকে যাবে তোমার আদেশানুসারে! কিন্তু ভেইন পিছলে যায়, চোখের সামনে দিয়ে। ফুটো দিয়ে নিষ্ফলা লাল রক্ত বেরিয়ে আসে, ফুলে উঠে হাত, ব্যঙ্গাত্মক এক জোকারের মতো। বরাদ্দ বছরের শেষে পৌঁছে যাওয়া এই মানুষগুলো কিছু বলে না, ব্যথা মুখ ফুটে উঠে আসে না, কেবল মুখ কুঁচকে যায় একটু, তারা সবকিছু মেনে নিয়েছে ভবিতব্য বলে। শীর্ণ শরীরে, জীর্ণ মনে, তাদের সম্বল বলতে শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা— ‘ঠাকুর কবে তুলে নেবে’! কিন্তু দয়ালু ঠাকুররা শুধু মন্দিরে জিভ ভ্যাঙচায়, আর পেমফিগাসে ছটফট করতে থাকা বুড়ি পড়ে থাকে হাসপাতালের নীল চাদর মোড়া বিছানায়।
কতো রকমের হাত দেখি আমরা রোজ, মানুষের থেকেও বেশি। হাত দেখে মানুষ বোঝা যায়, এ তথ্য আমরা জ্যোতিষী না হয়েও জানি। কার হাতে শাঁখা, কার হাতে পুরোনো সুইসাইডাল কাট.. মুখ তুলে তাকাই, মুখে নৈর্ব্যক্তিক ছায়া দেখে আবার হাতে ফিরে যাই। মুখের থেকেও বেশি হাত বলে ওঠে। কার সূচের কামড়ে ব্যথা লাগে, আর কার জীবনের কামড়ের জোর অনেক বেশি, যার জ্বালায় বাকি সব জ্বালা অবশ হয়ে যায় নিজে থেকেই।
এখন যেখানে কাজ করি, সেটা সুপারস্পেশালিটি ওয়ার্ড। ব্লাড ক্যান্সার। পোশাকি নাম, ইন্সটিটিউট অফ হেমাটোলজি অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন। একের পর এক বেড, লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা। এখানে বেশিরভাগ পেশেন্টের হাতের ভাঁজে একখানা লম্বা চ্যানেল লাগানো, যাতে রক্ত নিতে বা দিতে বা ওষুধ দিতে বারবার চ্যানেল করতে না হয়, এটাকে বলে PICC (Peripherally Inserted Central Cannula)। কিন্তু সবার থাকে না, সবার করা সম্ভবও হয়ে ওঠে না। একদিন গিয়ে দেখি এক কচি বাচ্চা ভর্তি হয়েছে বেড নাম্বার নয়ে। তার বড়ো বড়ো চোখ, আর গোটা শরীর ভর্তি সূচ ফোটানোর দাগ। আমাকে সিরিঞ্জ ভায়াল নিয়ে আসতে দেখেই সে ভ্যাঁ করে উঠেছে। ফোঁপানো আর মায়ের মিথ্যে সান্ত্বনার মধ্যেই শিরা খুঁজে চলতে হয়। নীলচে-কালো হাত, হাতের ভাঁজ, মুঠো পেরিয়ে পৌঁছাই পায়ে, কোনোমতে সংগ্রহ করি অমূল্য তরল। ফোঁপানি তখন পরিণত হয়েছে চিলচিৎকারে। পেডিয়াট্রিক্সে ডিউটি করার সময়ও বাচ্চাদের হাত, দরকারে পায়ের শিরা থেকে রক্ত নিতে হয়েছে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে এর পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য একটা জিনের ভুলচুকের, একটা ট্রান্সলোকেশনের, একটা ডিলিশনের…
বেড ১৪য় এক মাঝবয়সী ভর্তি হয়েছেন, এই কয়েকদিন আগেই। প্রথমবার রক্ত নিতে গেছি, একটা অদ্ভুত ক্লান্ত হাসি হাসলেন প্রায় যুবক মানুষটা। পরিষ্কার উচ্চারণে বললেন, ‘ডক্টর, ব্লাড নেবেন? দাঁড়ান, হাতটা খুলে দিই, দেখুন যদি পারেন!’ খুব কম আশা, আর বেশ খানিকটা হতাশা গলায়। হাত খুলে দেখলাম, বাঁ হাতের গোটাটা নীলচে কালো প্যাচে ভর্তি, যাকে petechie বলে, কিউবিটাল অঞ্চল থেকে শুরু করে গোটা হাত। ডান হাতের অবস্থাও কাছাকাছি। নিজের থেকেই পা এগিয়ে দিলেন। চেষ্টা, বিফলতা, আবার চেষ্টা, একটু রক্ত যে আমার চাইই চাই…
প্রতিবার সিরিঞ্জের মুখে লাগানো নিডলের খাপ খুলতে গিয়ে মনে পড়ে, এই মানুষগুলো দিনের পর দিন এক কঠিন রোগের সঙ্গে লড়ছে। রোগ, তার ব্যথা, তার আশা ভরসা, তার জীবন পাল্টে যাওয়া, তার মানসিক অবস্থা, সবকিছু এই নীল বিছানায় একটু একটু করে লেগে আছে। তার মাঝে এই সূচ হয়তো খুব ইনসিগনিফিক্যান্ট, হয়তো সিগনিফিক্যান্ট। কে জানে..
পেইন, ব্যথা, কষ্ট খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। খুব ইন্ডিভিজুয়াল। মেডিক্যাল সায়েন্সের কাছেও তাই, কিছু সেমি অ্যাকিউরেট, সেমি সেনসিটিভ পেইন ‘স্কেল’ এর বাইরে আর কিছু বুঝে উঠতে পারি না আমরা।
তাও চেষ্টা করে যাই, সাময়িক ব্যথা পেরিয়ে দীর্ঘকালীন সুস্থতার দিকে আমাদের লড়াই চলতে থাকে, ভ্যাম্পায়ারদের..