মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অনশন আজ তিনদিনে পড়লো। ছাত্রছাত্রী বলতে এখনো যাঁরা এমবিবিএস পাশ করেননি। তাঁরা প্রথম বর্ষ থেকে অন্তিম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। অর্থাৎ, তাঁরা কেউ এখনো অব্দি সরাসরি স্বাস্থ্য-পরিষেবার সাথে যুক্ত নন। কাজেই তাঁদের এই আন্দোলন বা অনশনের কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব স্বাস্থ্য-পরিষেবার ওপর পড়বে না। এই অংশটা আগেই পরিষ্কার করে দিলাম কেননা ‘ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে মানুষের পরিষেবা পেতে সমস্যা হচ্ছে’ এমন অপপ্রচারের মাধ্যমে আন্দোলনের গতিরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং, প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা চলছে। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না, সবাই জানেন।
এবার বলি, কেন আন্দোলন? কলেজের নির্বাচন এবং ভোটদান প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর নায্য দাবী এবং অধিকার। ‘ডাক্তার’ হয়ে ওঠার প্রতিটি পর্বে রাজনৈতিক সচেতনতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আশেপাশের সমস্ত ঘটনা, সমাজ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি থেকে অনেক দূরে থেকে এবং সে সম্পর্কে কোনও ধারণা না রেখে শুধুই সাদা শার্ট আর দামী প্রেসক্রিপশন প্যাডের চাকচিক্যে আর যাই হোক, ‘ডাক্তার’ হয়ে ওঠা যায় না। ডাক্তারির প্রতিটি দাঁড়ি-কমার সাথে রাজনীতি জড়িয়ে আছে। এই যে অবৈজ্ঞানিক ওষুধপত্র নিয়ে এত কথা বলি কিংবা প্রথম ছ’মাসে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে বলে বলে মুখে ফেনা বের করে ফেলি; তার সাথে রাজনীতির যোগ নেই? অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চাটার প্রতিদিনের খাবারে প্রোটিনের অভাব নিয়ে কথা বলি, তার সাথে রাজনীতি নেই? স্বাস্থ্য সবার মৌলিক চাহিদা হওয়া উচিত, এটা বলার মধ্যে রাজনীতি নেই? শুধুই বইতে মুখ গুঁজে আর রেটিনার দশটা স্তরের নাম মুখস্থ করে ‘ডাক্তার’ হওয়া যায় না। সচেতন চিকিৎসক হওয়ার পেছনে কলেজ ক্যাম্পাসের রাজনীতি যে বড় ভূমিকা রাখে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাজনৈতিক রঙ নির্বিশেষে বরাবরই শাসকদল স্বাধীন ছাত্রছাত্রীদের দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। স্বাধীন ছাত্রছাত্রী যারা কোনও বাজারচলতি রাজনৈতিক দলের পতাকা বয় না। যারা মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা বলে। কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের চোখরাঙানি নয়, ছাত্রছাত্রীদের অধিকারের কথা বলে। ছাত্রাবস্থায় এরকম একটি স্বাধীন সংগঠনের অংশ ছিলাম ভেবে গর্ব হয়। সেই ছাত্র সংগঠনের নাম মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস’ অ্যাসোসিয়েশন।
সেই সংগঠনের বর্তমান দাবী কী? খুবই সামান্য এবং খুবই যৌক্তিক দাবী। বহু বছর কলেজে ভোট বন্ধ। এবার ভোট করাতে হবে। প্রথমে কলেজ কর্তৃপক্ষ সে দাবী মেনেও নেয়। দিনক্ষণও ঠিক হয়ে যায়। পরে কারও অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে জানিয়ে দেওয়া হয়, ভোট করানো সম্ভব হবে না। ‘অদৃশ্য অঙ্গুলি’ কার সেটা বোঝা খুব একটা মুশকিল নয়। শাসকের শুধু রঙ বদলায়। ভেতরের চরিত্রটা একই থাকে। যে কোনও দিন ভোট হ’লে এবং ‘পুকুর চুরি’ না করতে পারলে নিশ্চিত পরাজয় বুঝে উর্ধ্বতন চেয়ার থেকে ভোট না করানোর আদেশ এসেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের আজ্ঞাবহ অংশের সে আদেশ উপেক্ষা করার সাহস নেই। শিরদাঁড়া বন্ধক রাখা আজকাল বিশেষ যোগ্যতার মধ্যে পড়ে। যত বেশি শিরদাঁড়া ঝোঁকানো যাবে তত বেশি ইনাম মিলবে। কাজেই যেনতেনপ্রকারেণ ভোট করতে দেওয়া যাবে না। ভাবতে অবাক লাগে, মেডিক্যাল কলেজের মতো প্রচারের আলোয় থাকা জায়গায় গণতন্ত্রের এই হাল হ’লে যেখানে আলো পৌঁছোয় না সেখানে গণতন্ত্র কীভাবে বাঁচে?
ছাত্রছাত্রীরা অনশনের সিদ্ধান্ত একদিনে নেননি। তাঁরা প্রথমে অনুরোধ এবং আলোচনার রাস্তাতেই গেছেন। বদলে এসেছে রীতিমতো হুমকি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াতেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের আন্দোলন সমর্থন করি। তাঁরা জিতে ফিরবেন এই আশা রাখি। অনেক দিন নিজের কলেজে যেতে পারি না। আবীরে মাখামাখি বিকেলগুলো মিস করি। ঘামে ভেজা বিকেল, স্লোগানের বিকেল, একসাথে গলা মেলানোর বিকেল মিস করি। কলেজ কোনও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। কলেজ-ক্যাম্পাসে শেষ কথা বলবে সেখানকার ছাত্রছাত্রীরাই। লং লিভ ডিএসএ। লং লিভ মেডিক্যাল কলেজ।