রুডলফ ভির্শ-র (Rudolf Virchow) কথা পড়ছিলাম। চিকিৎসকের সামাজিক দায় বিষয়ে সোচ্চার সেই কিংবদন্তী জার্মান চিকিৎসক-গবেষক। মেধা ও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তির প্রদর্শনের সুবাদে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বার্লিনের শব-ব্যবচ্ছেদাগারের অধিকর্তা হয়েছিলেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদির চাইতে, তখন, ভির্শ-র মনে শুধুই নিজের গবেষণা।
চিকিৎসাশাস্ত্রকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক করে ফেলতে পারার চ্যালেঞ্জ। এবং পাশাপাশি বিজ্ঞান যদি চিন্তাপদ্ধতি ও কার্যপ্রণালী বদলাতে না পারে, তাহলে তা তেমন কাজের নয়, এমন ভাবনাও।
নিজের ল্যাবরেটরিতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে মুখ গুঁজে ভির্শ যখন খুঁজে চলেছেন প্যাথলজির নিত্যনতুন আলো, বাইরে তখন জার্মানির মানুষ পথে নেমেছেন বাক-স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে। ঠিক পরের বছরই মার্ক্স লিখবেন সেই অমর কথাগুলো – ইউরোপ ভূত দেখছে; কমিউনিজমের ভূত।
আর ভির্শ লিখছেন, বাইরে এতশত ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে আমি শান্তভাবে নিজের গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
এমন সময়, জার্মানির উত্তর সাইলেসিয়া অঞ্চলে ভয়াবহ মড়ক লাগল। টাইফাস জ্বরের মড়ক। হাজারে হাজারে মানুষ মরতে থাকল। খবর পৌঁছে গেল বার্লিন অবধি। ভির্শ চাইলেন সামনাসামনি দেখে ব্যাপারটা বুঝতে। সরকারকে লিখলেন, তাঁকে যেন সুযোগ দেওয়া হয় সরেজমিনে দেখেশুনে সরকারের কাছে একটি বিজ্ঞানসম্মত রিপোর্ট জমা দেবার। সরকারও অখুশি নন, যদি ‘তদন্ত চলছে’-র আড়ালে চাপা পড়ে যায় মানুষের বিক্ষোভ, সে তো খুবই সুবিধেজনক ব্যাপার।
সাইলেসিয়া পৌঁছে ভির্শ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বাড়িতে চিঠিতে লিখেছিলেন, মানুষের দুর্দশা অকল্পনীয়। একদিকে এমন উদাসীনতা, মেনে নেওয়ার অভ্যেস, পশুসুলভ আনুগত্য – দেখলে ভয় করে…
কেবলমাত্র একটি ছোট শহরেই, ভির্শ দেখলেন, হাজারতিনেক অনাথ শিশু। অনাহার, অপুষ্টি, মৃত্যু… হাহাকার…
সরকার আশা করেছিলেন, ‘বিজ্ঞানসম্মত রিপোর্ট’। যেমন, আরও বেশি সংখ্যায় ডাক্তার প্রয়োজন, আরও বেশি হাসপাতাল হলে ভালো হতো, এই জাতীয় কথাবার্তা।
ভির্শ দুষলেন সরকারকে। সরাসরি। খাদ্যসঙ্কটে উদাসীন থাকা, মড়কের আগেকার দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে না বসা। আর দুষলেন চার্চ-কে, হাসপাতালগুলোর ভয়াবহ অব্যবস্থার জন্য।
লিখলেন, প্রুশিয়ান আমলাতন্ত্র আর ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা পদদলিত মানুষের দুর্দশা যে কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই মহামারী।
মহামারী দেখেশুনে দশ দিনের মাথায় রুডলফ ভির্শ যখন বার্লিনে ফিরে এলেন, তিনি এক বদলে যাওয়া মানুষ। চারপাশের ঘটনাবলী থেকে নিভৃতে বসে নিজস্ব গবেষণা চালিয়ে যাওয়া যেতেই পারে, কিন্তু ভির্শ যে বিজ্ঞানের পিয়াসী, যে প্রায়োগিক বিজ্ঞান মানুষের কার্যপ্রণালী বদলে দিতে পারে, তা যে সমাজবিচ্যুত হয়ে সম্ভব নয়, ভির্শ সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে উঠলেন।
যে নিশ্চয়তা, পরবর্তী কালে, ভির্শ-কে পৌঁছে দেবে এই অমোঘ বোধে – “Medicine is a social science… The physicians are the natural attorneys of the poor, and social problems fall to a large extent within their jurisdiction.”
তো অনেক বাবামায়েরই শখ দেখি, সন্তান ডাক্তার হলে ভালো হয়। আকাশ-বাতাসের কোচিং ক্যাম্পে লাখ লাখ টাকা দিয়ে ভর্তি করারও বেশ উদ্যোগ। কিন্তু, সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনা, আমজনতার সমস্যা জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি উদ্বেগ এসব থেকে সন্তান দূরে থাকুক, এমনটাই আশা।
কিন্তু সেই সন্তান যখন ডাক্তার হয়ে সমস্যায় পড়ে – সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসমস্যা বা আর্থসামাজিক ব্যবস্থাজনিত সঙ্কট ইত্যাদি বড় বড় কথা ছেড়েই দিচ্ছি, নিতান্ত ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলছি – যেমন কর্পোরেট হাসপাতালে মাইনে মেরে দেওয়ার সমস্যা, চাকরির ন্যূনতম সুরক্ষা না থাকার সমস্যা, আবার সরকারি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দাদাগিরির সমস্যা, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনার সমস্যা – তখন সমস্যাজনিত বিপদের চাইতেও বিস্ময়বোধ প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। আর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে শারীরিক আক্রমণের মুখোমুখি হলে তো… (আবার অন্য চিকিৎসক আক্রমণের মুখোমুখি হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাহুতাশের বেশি কিছু করে উঠতে পারে না।)
তো আমজনতার অধিকার নিশ্চিত করাটা তো বটেই, নিজের অধিকার ঠিকঠাক বুঝে নেওয়াটাও একটা অভ্যেস। যা রাতারাতি গজায় না। নিজের কলেজে নিজের ভালোমন্দটুকু নিজেরাই বুঝে নেওয়া যাবে, স্বাধীন বোধ ও গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা বিকাশের ক্ষেত্রে এ একেবারে প্রাথমিক পদক্ষেপ। সেই অধিকারে হাত পড়লেও যারা চুপ করে থাকে, তাদের পক্ষে বাকি জীবনেও অপরের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদে সামিল হওয়া তো দূর, নিজের অধিকার লুণ্ঠিত হতে দেখেও একান্তে হাহুতাশের বেশি কিছু করে ওঠা সম্ভব হয় না।
আপনি কি চান, আপনার পরবর্তী প্রজন্ম অসুস্থ হলে ঠিক তেমন সব-কিছু-মেনে-নেওয়া চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হোক? এমনকি আপনিও নিজের শেষ জীবনে??
চাইলে, বেস্ট অফ লাক। না চাইলে…
নিজেদের মেডিকেল কলেজে নিজেদের ছাত্রসংসদ নিজেরা বেছে নিতে পারবে, স্রেফ এটুকুর দাবিতে মেডিকেল কলেজে অনশনে বসেছে – বসতে বাধ্য হয়েছে – একদল ছাত্রছাত্রী।
পারলে, তাদের পাশে দাঁড়ান। এটুকু কঠিন কিছু নয়।