মনোময়কে তোমরা হয় চেনো না, নইলে সবাই চেনো।
সেই নানান দোষে ভরপুর এক মানুষ। দোষে গুণে ভরপুর বলতে পারলেই খুশি হওয়া যেত। কিন্তু গুণের আভাস মাত্রও নেই।
হায়, অনেক চেষ্টায়ও সেই গুণহীন দুঃখবিলাসীকে ভুলতে পারি না। অথচ দ্বিজেন্দ্রলাল থেকে হালের সবাই তাকে বলেই যাচ্ছে যদি ভালোবাসা পেতে চাও,
হেসে নাও দু দিন বই তো নয়!
________________________________________
– মনোময়, আর তো কয়েক দণ্ড। বলো, তোমার কথা বলো, যা তোমার ইচ্ছে হয় বলতে, বলো, শুনি!
– কী বলি বলো তো? যা বলব সবই সেই চর্বিত চর্বণ। নানান দোষে পুরোপুরি ভরপুর।
– পুরোটাই দোষ? আহা, তাই কি হয়! দোষেগুণে ভরপুর বলো অন্তত।
– না হে, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে চিরে চিরে দেখেছি। গুণ নেই। পুরোটাই ছি ছি দিয়ে ভর্তি। সেই মায়ের কোল থেকে আজ এই অবধি। কাদা আর কাদা!
– কাদা? কীসের কাদা মনোময়?
– আরে, সে পরতে পরতে কাদা। ওই যে বই কেতাবে ষড়রিপু বলে না! এক থেকে ছ নম্বর পর্যন্ত গিজগিজ করছে আগাপাশতলা শরীরে আর মনে। কোনও সম্পর্ক মানেনি, সময় মানেনি এমন সব বদমায়েশি। সেই ছোটোবেলা থেকেই।
– শিশুবেলায় তো পূত পবিত্র থাকার কথা। ছিলে না?
– শোনো তবে, বলি। নাগদাদু কোলে করে নিয়ে পড়াতে বসত। বয়স কত তখন? ধরো চার কী সাড়ে চার। পড়াশুনো অসহ্য লাগত। পরপর চারদিন তার ওই কোলে বসেই জলত্যাগ করলুম। সে এক কেলেঙ্কারির এক শেষ। নাগদাদুর আসা বন্ধ।
– বটে বটে! ভারি ত্যাঁদড় ছিলে তো! চেষ্টা করোনি ভালো হবার?
– নাঃ করিনি। সেই শিশুবেলা থেকেই কেমন যেন বদমাশ অথচ ভাগ্যনির্ভর ছিলাম। উদ্যোগহীন। আলস্যে ভরপুর। অথচ আশারও কমতি নেই।
– পড়াশুনো করতেও, উন্নতির মুখ দেখতেও আলস্যি?
– হ্যাঁ রে বাপু! নইলে আমাদের আগে পরে কতলোক বিলেত আমেরিকা ঘুরে এলো। থেকেও গেল কতক। চাইলে পারতাম না কি? ইচ্ছেই করল না!
– শুধুই কি ওই, ইচ্ছে করল না? নাকি…
– হ্যাঁ, এলেমও ছিল না। ঠিক বলেছ, মেধার এলেম, সাহসের এলেম। আর হ্যাঁ, স্বভাবে কেপ্পন আর ফ্যামিলি হাভাতে গোছের বলে টাকার এলেমও ইয়ে…
– না হে মনোময়, যা দেখছি অজুহাত সব ফালতু। পুরুষকার বস্তুটিই তোমার ছিল না।
– তা হবে। তবে ওই হরমোনের চক্রান্তটি, যাকে মন বলে রটায় সবাই, বোধহয় ছিল। খুব সন্দেহজনক সব অ্যাক্টিভিটি সারা জীবন।
– তা এখন যে এত মন খুলে বলছ সব, ভয় হচ্ছে না?
– কীসের ভয়? লোকলজ্জার? না না, লোকলজ্জা আর নতুন করে কী হবে?
– তবে? বলছ কেন এত সব?
– শোনো বলি। এখন একটাই রবীন্দ্রগান, গাইতে তো জানি না, গুনগুন করছে মনের ভেতর।
– বটে বটে, এর মধ্যে আবার তাঁকেও টানলে দেখি। কোন গানটা মনোময়। না গাও, লিরিকটা তো বল!
– ওই যে,
আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে।
ভয় কোরো না, সুখে থাকো, বেশিক্ষণ থাকব নাকো–
এসেছি দণ্ড-দুয়ের তরে॥
দেখব শুধু মুখখানি, শুনাও যদি শুনব বাণী,
না হয় যাব আড়াল থেকে হাসি দেখে দেশান্তরে।
– ওঃ বাবা, কাকে দেখতে চাইছ?
– কাকে আবার, আমার ভাগ্যদেবীকে।
– তবে তার কথাই না হয় বলো খানিক, শুনি।
– পুরুষকার তো ছিল না। তাই ওই দেবীটিকেই আঁকড়ে ধরতে চাইতাম খুব। নানান ফর্মে আর রূপে।
– তো একটা রূপ তো বলো!
– দেদার লটারির টিকিট কাটতাম সেই যবে থেকে দুপয়সা রোজগার করেছি তবে থেকে। দু বার মিজোরাম লটারির পঞ্চাশ টাকার প্রাইজও পেলাম সেকালে। বিদেশে বন্ধু লাস ভেগাসে গিয়ে কী এক মেশিনে কয়েন ফেলে, বুঝলে তো ঝন ঝন করে ডলার, পড়ছে তো পড়ছেই। জ্যাকপট! বুঝলে তো? শুনলে লোভ হয় কিনা বলো!
– মোটে দুবার? মোটে পঞ্চাশ? এর বেশি পেতে সাধ আর হয়নি?
– হয়নি আবার! সেই যে অনলাইন সুপারলোটো এল একবার। কোটি টাকার প্রাইজ। সেই কুড়ি বছর আগে। দশ টাকার টিকিট কেটে সারা হপ্তা নেশায় রিমঝিম। কোথায় লাগে তোমাদের সিঙ্গল মল্ট ভদকা স্মারনফ। শালার লোকজন সেই নেশাটাকেও…।
– এ্যাই এ্যাই, মুখ খারাপ কোরো না মনোময়, লোকে কিন্তু তোমাকে
– আরেঃ, ছাড়ো তো লোকের কথা! লোক না পোক, রামকৃষ্ণ বলে গেছে। তা সেই ভাগ্য দেবীটিও কম নখরাবাজ নয়, বুঝলে তো?
– আবার তার সঙ্গে আবার কী নিয়ে লাগল তোমার?
– কী আর বলি বলো? ওই লাস ভেগাসের জ্যাকপটের সমান প্রাইজের এক লটারি টিকিট কেটেছিলাম একগাদা টাকা দিয়ে। লটারির টিকিটের হাজার টাকা দাম, কেউ ভেবেছে কোনও কালে? তা সেই ভাগ্যদেবী কী করেছে জানো?
– কী আর করবে? বড় জোর প্রাইজ পাওনি, এই তো?
– তা হলে তো মিটেই যেত। সে আমি সারা জীবনই পাইনি। অভ্যেস আছে। কী হল শোনো। মেলা টাকার প্রাইজ তো। কাজেই টিকিটও অনেক। ওই A থেকে Z অবধি সিরিজ। আমি বেছেকুছে মাঝামাঝি J সিরিজের একখানা কেটেছিলাম।
– তো?
– বাধবি তো বাধ, পুরো নম্বর মিলিয়ে বেধে গেল টিকিট। চোখ কচলে বুকের ধুকপুকুনি আর মাথা ঘোরা এট্টু কমলে খেয়ালে এলো সব মিলেছে। শুধু ওই সিরিজটা মেলেনি। U সিরিজ। আমি ছাড়ব না। যদি সিরিজ ছাপতে ভুল হয়ে থাকে। যদি… যদি…
– বেশ হয়েছে। মেলেনি মেলেনি, তাতে অত ইয়ে কীসের তোমার? ঘুমোও দেখি। ডাক্তার ঘুমোতে বলে গেল তো সব ওষুধ খাবার পর।
– হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ঘুমোই। কাল সকালে এসো কিন্তু যদি কোনো খবর থাকে সিরিজ বদলানোর।
★
নিস্পন্দ মনোময়ের মুঠিতে ধরা ছিল তার বড় সাধের জ্যাকপট টিকিট। টেবিলের সব ওষুধ শেষ। কাঁপা হাতে সিরিজের J- টাকে কলমের আঁচড়ে U করার চেষ্টা করেছিল বোকা জালিয়াতটা।
★
আর হ্যাঁ, তার টেবিলে একটা দুমড়ানো কাগজে একটা লেখা পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে ওটাই নাকি সুইসাইড নোট।
★
সেই লেখাটা
শোনো জ্যাকপট
_______________
★
সেই যে আয়ত চোখ, কটু কথা, দোলে দুই বেণী
নম্বর একই, শুধু সিরিজ মেলেনি
জ্যাকপট তুমি তাই
আজও সেই দূরে থেকে গেলে
কুয়াশায় ঢাকা এক পাহাড়ি বিকেলে
দুখানা স্বপ্ন চোখ প্রহেলিকা মুখোশ পেরোনো
বড় চেনা লেগেছিল।
জ্যাকপট শোনো,
সে মুহূর্তে চিনলাম আজীবন ভুলের সিরিজে
যে টিকিট হারিয়েছে, একা নিজে নিজে…
সেই অভিজ্ঞানই তুমি
কবেই তামাদি হয়ে মিটে গেছে দেনা
আজ এই মূল্যহীন চেনা
… নেই কোনও দাম
তবু আমি শুধু শুধু কেন চিনলাম?
সব কিছু মিটে গেছে? মেটেনি বোধ হয়…
ক্ষত দাগ ঢেকে যায়।
রক্তক্ষরণের ঋণ? সে কি শোধ হয়!