ভাষা চর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা ভালো বলতে পারবেন।
শব্দার্থ কী ভাবে বদলায়।
শব্দার্থ পরিবর্তনের স্বরূপের ভাগগুলি
১) শব্দার্থের প্রসার বা বিস্তারঃ শব্দের মূল অর্থ কোনো নির্দিষ্ট অর্থকে অতিক্রম করে যখন তার অর্থের সীমাবদ্ধতার বাইরে বস্তু নিরপেক্ষ বা ব্যক্তি নিরপেক্ষ হয়ে ওঠে তখনই তাকে শব্দার্থের বিস্তার বা প্রসার বলে। এই ক্ষেত্রে অনেক সময় শব্দটির একটি মূল অর্থ এবং এক বা একাধিক সহযোগী অর্থ থাকে।
যেমন – কালি – এই শব্দটির প্রকৃত অর্থ হল কলমে ব্যবহারযোগ্য কালো রঙের লেখার জন্য ব্যবহৃত তরল সামগ্রী। কিন্তু বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন রঙের তরল সামগ্রী যা লেখার জন্য ব্যবহৃত হয় তাকেও প্রচলিত অর্থে কালি বলে পরিচয় দেওয়া হয়। যেমন – লাল কালি, সবুজ কালি, নীল কালি প্রভৃতি।
আরও উদাহরণ
সাগর- সগর বংশীয়- সমুদ্র, ইত্যাদি…
২) শব্দার্থের সংকোচ বা সংক্ষেপঃ শব্দের অর্থ যখন একাধিক থাকা সত্ত্বেও কিংবা কোনো শব্দের একাধিক অর্থগুলির মধ্যে যখন একটি মাত্র অর্থকে প্রধান রুপে গ্রহণ করা হয় তখন তাকে শব্দার্থের সংকোচ বা সংক্ষেপ বলা হয়।
যেমন – মৃগ এই শব্দটির অর্থ হল বনের পশু বা বন্যপ্রাণী। এই কারনে মৃগয়া কথাটি এসেছে। কিন্তু বর্তমানে মৃগ শব্দের দ্বারা শুধুমাত্র হরিনকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এখানে তাই বলা যায় যে প্রসারিত অর্থ সংকুচিত হয়েছে।
অন্য উদাহরণ
অন্ন- যা খাওয়া হয়- ভাত
জলদ- জলদাতা- মেঘ
৩) শব্দার্থের সংশ্লেষ বা সংক্রম বা রূপান্তরঃ শব্দের অর্থ ক্রমান্বয়ে সংকোচ বা প্রসারের ফলে যখন কোনো একটি নতুন অর্থ লাভ করে এবং সে অর্থের সঙ্গে শব্দের মৌলিক অর্থের কোনো যোগ থাকে না তাকেই শব্দার্থের সংশ্লেষ বা অর্থের সংক্রম বা অর্থের রূপান্তর বলা হয়।
অনেক সময় শব্দের অর্থের পরিবর্তন এমনভাবে হয় যে আপাতদৃষ্টিতে আদি অর্থের সঙ্গে পরিবর্তিত নতুন অর্থের কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায় না।
যেমন – দারুণ – শব্দের অর্থ হল কাঠ যা খুবই কঠিন বা নীরস, কিন্তু বর্তমানে নির্মম নিষ্ঠুর বা হৃদয়হীন বা ভয়ানক এমনকি অতিশয় অর্থেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উদাহরণটিতে আদি ও পরিবর্তিত অর্থের মধ্যে মিল বিরল হলেও অর্থ পরিবর্তনের ইতিহাস যদি দেখা যায় তাদের মধ্যে কিন্তু যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়।
অন্য উদাহরণ
বুজরুক- সম্মানিত ব্যক্তি- ভণ্ড
কৃপণ- কৃপার পাত্র- ব্যয়কুণ্ঠ
গবেষণা- গরু খোঁজা- বিশেষ বিষয়ে নিয়মানুগ বিশ্লেষণ
কদর্থ আমার ধারণা ওপরের এই আলোচনার বাইরে গিয়ে অন্য কিছু।
কদর্থ বি. বিকৃত, অসংগত বা ভুল মানে; কুত্সিত অর্থ। [সং. কু + অর্থ]। ̃ ন, ̃ না বি. 1 নিন্দা; 2 কদর্থ করা (আমার বক্তব্যর এই কদর্থন আমাকে খুবই পীড়া দেয়)। কদর্থিত, কদর্থী-কৃত বিণ. ভুল অসংগত বা বিকৃত অর্থ করা হয়েছে এমন।
কদর্থ n a distorted meaning; a misinterpretation; a perverted meaning. কদর্থ করা v. to distort or pervert the meaning (of); to misinterpret. ̃ন, ̃না n. distor tion or perversion of meaning; misin terpretation; censure. কদর্থিত a. having the meaning distorted or perverted; misinterpreted.
(তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ) কু+অর্থ; (নঞ্ তৎপুরুষ সমাস)
প্রসঙ্গত বলি ওপরের যা লেখা পুরোটাই কপি-পেস্ট।
কদর্থ কথাটার আভিধানিক মানে যাই হোক এর ব্যবহারিক দিকটা অতুলনীয়। আমরাও কেমন যেন সেই বিশেষ অর্থটাতেই আটকে থাকি, আমাদের স্বভাব আর রুচি অনুযায়ী।
আমার পাঠকবৃত্তে সকলেই সুরুচিমান। আমারও ভাষা ব্যবহারের ইতরবৃত্তিতে অনীহা। নইলে হিন্দি কোন শব্দ বাংলায় এসে শব্দার্থ সঙ্কোচের পাল্লায় পড়ে সাব-অলটার্ন রূপ নিয়েছে, কিম্বা লাগানোর মত নিরীহ একটি ক্রিয়া তার কদর্থিত রূপান্তর এই সব নিয়ে একটা পরিচ্ছেদ নামানোই যেত।
তদুপরি আমি পল্লবগ্রাহী ও ব্যাকরণভীত। তবু হঠাৎ ব্যাকরণ নিয়ে পড়লাম কেন?
★ আমার গত দিনের লেখায় বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে।
বিপ্লব শব্দটা অস্বস্তিকর বা স্বস্তি প্রদায়ক যাই হোক না কেন, এর বৃহত্তর অর্থের হাত থেকে আমাদের গ্রহ রক্ষা পায়নি।
‘উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে’ নিষ্প্রাণ গ্রহে প্রাণের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এক বিপ্লবই ছিল বই কি। আবার এই যে আদি নারী পুরুষ গাছ থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়ালেন, এবং তাঁদের উত্তরপুরুষ ও উত্তরনারী আপনি সময়ের তরী বেয়ে ক্রমশ ফেসবুকে অ্যাকটিভ হলেন এও তো এক বিপ্লব।
জানি আপনি গুগল ঘেঁটে Evolution আর Revolution-এর পঞ্চাশ হাজার তফাত বার করে বুঝিয়ে দেবেন আমার বোঝার ভুলটা। বিস্তৃত সময় ব্যাপী হলে তা বিবর্তন আর হঠাৎ হলে বিপ্লব এই রকমের বোঝাবেন কেউ।
তা’ মশাই, সেই বিগ ব্যাং নামের সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে আজ অবধি যে কাঁড়ি কাঁড়ি সময় গেছে, সেই তুলনায় পৃথিবীর প্রাণের ইতিহাসের বিস্তৃতি তো তুচ্ছই। ধরতে গেলে হঠাৎই।
তো এই কচকচানির মধ্যে না গিয়ে, আমি বরং বিপ্লব শব্দটা নিয়ে কমেন্ট যা এসেছে তার মধ্যে বেছে কয়েকটি শোনাই। বিপ্লব কথাটির বাইরে অন্য কথা যা এসেছে, সেইটুকু বাদ দিয়েছি। নিজের কথা বসাইনি।
★ বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
★ হরিদাস মালাকার পার্টিতে এই কথা বলেছিলেন । ডাক্টার এর কাজ হোল আগে মানুষের চিকিৎসা করা । ঠিক মতোন ।
★ ইউনিভার্সিটিতে আমাদের একজন স্যার ছিলেন। যিনি লণ্ডনের চাকুরি ছেড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিলো, যিনি জমিদার পরিবারের সন্তান, যিনি কংসারী হালদারের সাথে দেখা করতে রাত আটটায় পাথর প্রতিমার বিল দিয়ে হাঁটছেন, যিনি নিজের এম্বাসাডর গড়িতে না এসে স্রেফ এস ফর্টিন বাসে সল্টলেক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন তেলের পয়সাটা গরীবদেরকে সাহায্যের জন্য…উনি প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলেছিলেন, চুপচাপ কাজ করে যেতে হয়।
বিপ্লব মানে যদি সদার্থক পালটে দেওয়া কিছু,তবে তা দীর্ঘজীবী হোক।
★ সাংগঠনিক রাজনীতির মানুষ, হৃদয়ের রাজনীতির মানুষ শিখুক এই লেখা পড়ে।
★ এটা ঠিকই, মানুষের জন্য কাজই আসল রাজনীতি,আসল বিপ্লব। সেই বিপ্লব, সেই রাজনীতির জয় হোক
★ “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক ” , নিজেদের কাজের স্বভূমিতে সনিষ্ঠ অনুশীলনে। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমার দেখা এক বিরল “অমল মানুষ” (যতদূর মনে পড়ে, এই শিরোনামে ওঁর একটা বই ছিল)। ওঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা । আপনাকে সেলাম ।
★ খুব সময়োপযোগী লেখা। বস্তুত, ন্যস্ত কাজ করে যাওয়া ও তাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামই তো প্রগতি।
★ কবি সাক্ষাতের কথোপকথন প্রসঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতার বক্তব্য মনে পড়ে গেল। এম ই কালিনিন ছিলেন পাইওনিয়ার ফ্রন্ট অর্থাৎ কমসোমলের দায়িত্বে। কমসোমলের খুদে সদস্যদের জিজ্ঞেস করতেন,’বড়ো হয়ে কী হতে চাও।’ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তর আসত: ‘আদর্শ মানুষ হতে চাই’/ ‘প্রকৃত কমিউনিস্ট হতে চাই’ ইত্যাদি। উত্তরে উনি বলতেন,’তোমাদের জবাবে খুশি হলাম না, কারণ হয়তো খুশি করার জন্য এসব বলছ। আমি খুশি হব যদি তোমরা বল আমি একজন ভালো চিকিৎসক হব,ভালো প্রযুক্তিবিদ হব কিংবা বিজ্ঞানী হব।’
★ সে বহু বছর আগের কথা। ঐ যে বললি, ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতির খপ্পরে পড়েছিলিস! সেই সময়ে।
রাজনৈতিক class হোতো। একবার খবর এলো “উনি ” এবারের ক্লাসে কিছু বলবেন। “উনি ” কে সেটা উহ্য থাক।
যতদূর মনে পড়ে, তুইও ছিলিস।
সেদিন ওনার একটা কথা আমার আজও মনে আছে –“আমরা মনে করিনা তোমরা কাঁধে রাইফেল নিয়ে বিপ্লব করবে। তবে পেশাগত ভাবে প্রক্রিয়ার অনুকূলে কাজ করবে, এটাই কাম্য “!
★ এই কথাটা আমিও মানি। আমার তিন বন্ধু, তিনজনের নামই বিপ্লব, এই একবছরে মডারেট কোভিড হয়েও সুস্থ হয়ে উঠেছে (একজন আপনার লিস্টেও আছে)। এ একমাত্র এই ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ আশীর্বাদের কারণে।
★ ভীষণ ভাল লাগল। এরকম নীরব যত বিপ্লব সব দীর্ঘজীবী হোক
★ বিপ্লব শব্দের পরিধিটাই বাড়িয়ে দিলেন, পাল্টে দিলেন ওর অর্থের অভিমুখ।
★ আন্তরিক কামনা করি আপনার, আপনাদের’বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক”… বহমান হোক উত্তর-প্রজন্মেও…
★ অপূর্ব এই লেখা। এইসব লেখা পড়লে মনে হয় এখনও জীবন মানে একটা সদর্থক ভ্রমণ , তার উদ্দেশ্য আছে গন্তব্য আছে। মানুষ আছে। মানুষ মানুষের জন্য।
★ আমার নিজের মনে হয় অরুনাচল বিপ্লব একটা বিশ্বাস। বিপ্লব একটা স্বপ্ন। যা আমাদের মত কিছু বুড়ো এখনও সেই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে। এই বিপ্লব কখনো আসবে না তাও আমরা জানি। তবু এখনো যখন একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে সুন্দরবনে গিয়ে কোন দুর্গত মানুষজনের মুখে অন্ন তুলে দেয়। তখন আমার মনে হয় বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয়েছে৷ রাজনৈতিক বিপ্লব আসবে না কোনদিন। সামাজিক বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।
★ বিপ্লব এমনই হোক। দীর্ঘজীবী হোক বিপ্লব।
এর মধ্যে কোন মন্তব্যে বিপ্লব শব্দটির অর্থের
প্রসার, সঙ্কোচ বা রূপান্তর ঘটেছে, অথবা উপহাসের জন্য কদর্থ, বিচার করার মত ধীমান নই আমি।