গতকাল আদালতে সিবিআই চার্জশিট দাখিল করেছেন। মিডিয়ার সুবাদে যেটুকু জানলাম, প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজন হিসেবে ধৃত সঞ্জয়ের নামটুকুই সেখানে রয়েছে। হ্যাঁ, বৃহত্তর চক্রান্তে আরও অনেক নাম জড়িত ছিলেন, এমন সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে – সে বিষয়ে তথ্যসংগ্রহের কাজ চলছে – প্রমাণাদি পাওয়া গেলে যথাসময়ে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দাখিল হবে – এ-ও সিবিআই জানিয়েছেন বলে মিডিয়ায় সূত্রে জানলাম।
চার্জশিটে আপাতত সঞ্জয় বাদে আর কারও নাম নেই দেখে সরকারবাহাদুর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন বলে এখনও দেখিনি। তাঁদেরই গ্রেফতার করা অপরাধী (তাঁদেরই একজন হলেও) বাদে আর কাউকে সিবিআই ধরতে পারেনি বলে কলকাতা পুলিশ স্বস্তিবোধ করেছেন – বা নিজেদের পিঠ নিজেরাই চাপড়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন – এমন কিছুও ঘটেছে বলে দেখিনি।
এদিকে মেয়েটির শরীরে অজস্র ক্ষতচিহ্ন, খুনের আগে বেধড়ক মারধরের প্রমাণ বা কলেজ প্রশাসন ও দলীয় দাদাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে চলে আসা তার মতবিরোধ এবং সেই সুবাদে ‘দেখে নেওয়া’ তথা ‘উপযুক্ত শিক্ষা দেবার’ সম্ভাবনা – সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনাটি একজনের পক্ষে ঘটাতে পারা মুশকিল বলেই আমাদের কারও কারও সন্দেহ। অবশ্য অপরাধী যদি বাণিজ্যিক হিন্দি বা দক্ষিণী ছবির নায়ক হন, তাহলে অন্য কথা। তবু, তারপরও, অপরাধী যদি একজনই, তাহলে সেই জনৈক সিভিক ভলান্টিয়ার অপরাধীকে বাঁচাতে পুলিশ-প্রশাসন তো বটেই, মায় সরকারি দলের ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকবৃন্দ সদলবলে নেমে পড়লেন, এতখানি বিশ্বাস করতে পারা মুশকিল। অন্তত আমাদের মতো যারা শুরু থেকেই এই আন্দোলনের সঙ্গে রয়েছি – বা বর্তমান আন্দোলন শুরু হওয়ার ঢের আগে থেকেই এমন ঘটনা যে প্রেক্ষিত-পরিবেশে ঘটতে পারে, তার বিরুদ্ধে যথাসাধ্য সরব থেকেছি – তাদের পক্ষে সরকারি বয়ানটি বিশ্বাস করতে পারা বা মেনে নিতে পারা মুশকিল।
কিন্তু আরও মুশকিল তাঁদের নিয়ে, যাঁরা আমাদের এই বিশ্বাস করতে না পারা নিয়ে ভয়ানক বিচলিত হয়ে পড়েছেন – মুশকিল তাঁদের নিয়ে, যাঁরা আমাদের এই ‘তদন্তকারী সংস্থা’-র উপর ‘আস্থা রাখতে না পারা’-কে ‘বিপজ্জনক সামাজিক প্রবণতা’ হিসেবে দেখতে ও দেখাতে চাইছেন। যদিও তাঁরা নিজেরাই একসময় দিব্যি বিশ্বাস করতে পারতেন (হয়তো এখনও পারেন), যে, নন্দীগ্রামে শ’য়ে শ’য়ে (মতান্তরে হাজারে হাজারে) শিশুর হাত-পা ছিঁড়ে মেরে ফেলা হয়েছে, মানুষের রক্তের গন্ধ পেয়ে হলদি নদীতে সুদূর সুন্দরবন থেকে উজিয়ে মানুষখেকো কুমির এসে পড়েছে – বিশ্বাস করতে পারার পাশাপাশি, এমনকি, এসব কথা মানুষকে বিশ্বাস করাতেও পেরেছিলেন। আবার এঁরাই আদালতের রায়ে ‘প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস’ হয়ে যাওয়া অপরাধীদের নির্দোষ হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেন না – সে গুজরাটের দাঙ্গার ক্ষেত্রেই হোক বা উন্নাও-হাথরাস-এর ঘটনায় হোক – অথচ, নিজেদের এই ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্বাস করতে ও করাতে চাওয়া এবং সুবিধেমত অবিশ্বাস করতে পারা-কে ‘বিপজ্জনক সামাজিক প্রবণতা’-কে হিসেবে তাঁরা দেখেন কিনা, সেটা জানা যায়নি।
আসলে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তর পড়াশোনা করলেও, এই কথাটুকু এঁদের চোখ এড়িয়ে গেছে, যে – প্রমাণের অনুপস্থিতির অর্থ অনুপস্থিতির প্রমাণ নয়। (Absence of evidence doesn’t signify evidence of absence) আদালত যেহেতু বস্তুনিষ্ঠ ও অকাট্য প্রমাণ চায়, সেহেতু প্রমাণের অভাবে অনেকেই ছাড়া পেয়ে যান, কিন্তু যাঁরা ছাড়া পেয়ে যান, সবক্ষেত্রে সেই ছাড়া পেয়ে যাওয়াটা তাঁদের নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণিত করে দেয় না। (ঠিক যেমন, তোলাবাজ দুর্নীতিপরায়ণ নেতা ভোটে জিতলেই ‘জনতার আদালতে’ নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হয়ে যান, এমন নয়।)
এবং আরও একটি কথা। শাশ্বত নিরপেক্ষ সত্যি বলে কিছু হয় না। এমনকি প্রতিদিন সকালে পুবদিকে সূর্য ওঠে, এটুকুও নয় (কেননা, সূর্য কোথাও ‘ওঠে’ না)। পুরোটাই দর্শকের অবস্থান সাপেক্ষ। অতএব, কৃষিজমি বা বনজঙ্গল থেকে মানুষকে সরিয়ে (অথবা ফুটপাতে হকার বসতে দিয়ে তারপর তাদের উচ্ছেদ করে) ‘উন্নয়ন’ করার মাধ্যমে সত্যিসত্যিই ‘বৃহত্তর জনস্বার্থ রক্ষা’ হয় কিনা, সে-ও অবস্থান সাপেক্ষ (যেমন, আমি বিশ্বাস করি, হয় না)। এবং এই সহজ স্বাভাবিক ব্যাপারটা ‘বিপজ্জনক সামাজিক প্রবণতা’ বলে ভাবার কারণ দেখি না। (অবশ্য কেউ যদি বিশ্বাস করতে চান, যে, সন্দীপ ঘোষের যাবতীয় নির্দেশ, মেয়েটির মেনে চলা উচিত ছিল, কেননা হাজার হোক সন্দীপ ঘোষ শিক্ষক এবং ছাত্র/ছাত্রীর কাছে শিক্ষক তথা গুরু ঈশ্বরের সমতুল্য – তবে আমি তেমন ভাবনাকে বিপজ্জনক হিসেবেই দেখব এবং আপনি যদি বলেন, যে, এটা আমার দৃষ্টিকোণমাত্র, আমি দ্বিমত হবো না। কেননা অভীক দে বিরূপাক্ষ বিশ্বাসদের সঙ্গে আমার/আমাদের দৃষ্টিকোণের ফারাক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত)।
অতএব, পুলিশ সরকারি শাসক দল তথা সরকারের আদেশ অনুসারে কাজ করবে – সরকারকে রক্ষা করবে – এবং সরকারের (ও সেই সুবাদে সরকারি দলেরও) স্বার্থ রক্ষার জন্য যা যা দরকার (ও উপযুক্ত) বলে মনে হয়, তা-ই করবে – এবং পুলিশের কর্তব্য বলতে তা-ই, এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন। অনেকে আবার পুলিশ যা যা করে, ঠিক তাকেই ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা’ করা বলে – এমনও বিশ্বাস করতে পারেন। (যদিও এমন অবস্থানের সঙ্গে আমি সহমত নই।)
তো সেই বিচারবুদ্ধি অনুসারে, সরকার – যাঁরা অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে এতটুকু বিচলিত নন (দাবিদাওয়া মেনে নেবার ব্যাপারে তো এতটুকুনিও নন) – এবং সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের নেতানেত্রীরা, যাঁরা জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন-আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন কটুকাটব্য (ক্ষেত্রবিশেষে শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করে) করছেন – পুলিশ তাঁদের স্বার্থরক্ষা করতে অনশনকারীদের সঙ্গে যথাসম্ভব অসহযোগিতা করবেন ও পুলিশের তেমন কাজ যে আদতে পুলিশের তরফে যথাযথ দায়িত্ব/কর্তব্যপালন, এমনটাও অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন।
সুতরাং, অনশনস্থলে পুলিশ বায়োটয়লেট বসাতে দেয়নি – কেউ বলতে পারেন, পুলিশ ঠিকই করেছে।
সুতরাং, অনশনমঞ্চের উপর পুলিশ ছাউনি লাগাতে দেয়নি – কেউ বলতেই পারেন, পুলিশ একদম ঠিক কাজ করেছে।
সুতরাং, অনশনমঞ্চে বসানোর জন্য কিছু চৌকি ও চেয়ার ভ্যানে করে আনা হচ্ছিল – পুলিশ ভ্যানগুলোকে আটক করে – রাত্তিরবেলায় আসবাবপত্র ছেড়ে দিলেও ভ্যান এখনও অব্দি থানায় আটক – আপনার এমন মনে হতেই পারে, পুলিশ একদম সঠিকভাবে কর্তব্য পালন করেছে।
কেউ কেউ এ-ও ভাবতে পারেন, রোদে-পুড়ে-জলে-ভিজে নিরন্তর পরিশ্রম করে চলা পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে না পারা (এবং তাঁদের ‘ছোট ছোট ভুল’ বিষয়ে ক্ষমাসুন্দর হতে না পারা) একপ্রকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসহিষ্ণুতা মাত্র এবং এমন অসহিষ্ণুতা একধরনের ‘বিপজ্জনক সামাজিক প্রবণতা’। এবং বলা-ই বাহুল্য, আমি তেমন চিন্তাধারার সঙ্গে সহমত হতে পারব না।
তো গণতান্ত্রিক দেশের অবাধ গণতন্ত্রে সবারই সবরকম মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এমনকি বিভিন্নরকমের ভেক-এর আড়ালে সরকারি অনাচারের পক্ষে দাঁড়ানোরও স্বাধীনতা রয়েছে।
কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্ত এমন আসে, যখন পক্ষ নিতে হয়। পক্ষ নিতেই হয়। পক্ষ নিতে হয় স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায়।
পুলিশ যখন অনশনমঞ্চের উপর ছাউনি লাগাতে ডেকরেটরদের বাধা দেয়, তখন জুনিয়র ডাক্তাররা নিজেরাই প্যান্ডেল বাঁধতে বসেন। বেঁধেও ফেলেন।
গতকাল যখন পুলিশ অনশনমঞ্চে আসার পথে চৌকি-চেয়ার-সহ ভ্যান বউবাজার থানায় এনে আটকে রাখে – কলকাতার রাস্তা সেই অলৌকিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকে, যখন – গভীর রাতে – একদিকে যখন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে উঠেছে, তখন জুনিয়র ডাক্তাররা ঘাড়ে করে চৌকি বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বউবাজার থেকে এসপ্ল্যানেড – হ্যাঁ, ঠিক তখন, সেই মুহূর্তটিই, পক্ষ নেবার সময়।
জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের যাত্রাপথ ছিল বউবাজার থেকে এসপ্ল্যানেড – তাঁদের ঘাড়ে ছিল ডেকরেটর্স থেকে ভাড়া করে আনা চৌকি।
আদতে তাঁদের ঘাড়ের খাটিয়ায় ছিল রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পচাগলা শবদেহ। আর যাত্রাপথের শুরু ছিল সেক্টর ফাইভের স্বাস্থ্যভবন, অথবা সল্টলেকে রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের অফিস, কিংবা নবান্ন-র কন্ট্রোলরুম, যেখান থেকে সব অনাচার নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে…
আর এই যাত্রার শেষ কোথায় – এবং সৎকারের পর শুরুটা কোথা থেকে হবে, তার কিছুই আমাদের জানা নেই।
আমরা হয় এই পচাগলা সিস্টেমকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন করে শুরুর যাত্রায় সঙ্গী থাকতে পারি – নইলে এমন প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে পারি, কিংবা একে ‘বিপজ্জনক সামাজিক প্রবণতা’ হিসেবে দাগিয়ে দিতে পারি – আসলে পুরোটাই দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ – পুরোটাই পক্ষ নেওয়ার ব্যাপার। পুরোটাই অবস্থান-গ্রহণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
শুধু সরকার তথা সরকারি দলের পক্ষে দাঁড়িয়ে – অপশাসন দুর্নীতি তোলাবাজি ধান্দাবাজি অরাজকতার পক্ষে দাঁড়িয়ে – সেই অবস্থানকে কোনও নিরপেক্ষতা বা অরাজনীতি কিংবা সমাজতত্ত্বের কোনও উচ্চমার্গের বয়ানে পেশ করার ভণ্ডামি না করলেই হলো।
কথাগুলো হয়ত তিক্ত শুনতে লাগছে, কিন্তু আর ধৈর্য্য থাকছে না। অনশনরত ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সত্যিই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। অমানবিক সরকারের কাছে মানবিক আচরণের আশা যেহেতু নিতান্তই দুরাশা, তাই, অনশনকারীদের পক্ষে থাকলেও আমি আমরণ অনশনের মতো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ছিলাম। এবং যত সময় এগোচ্ছে, উত্তরোত্তর আরও অসহায় আর অস্থির লাগছে। পুজোর হইহুল্লোড়ের দিনগুলোতে প্রায় প্রতিবারেই ল্যাদ খেয়ে কাটাই – এবারে সেটাকেই হোলিয়ার-দ্যান-দাউ মোড়কে পেশ করতে চাইছি, এমন নয় – এবারে সত্যিসত্যিই উৎকণ্ঠিত অস্থির আর ডিপ্রেসড লাগছে।
পুনঃ- ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখি, উৎসবে যাঁরা মেতে আছেন, তাঁদের আনন্দকে লঘু করে দেখতে বা দেখাতে চাইছি না – উৎসবে যোগ দেওয়া এবং না-দেওয়া, দুরকম কাজেরই স্বাধীনতা সবার রয়েছে এবং সেই স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। (ডিসক্লেইমার দিতে হচ্ছে, কেননা এই পয়েন্ট নিয়েও বাজারে একাধিক পোস্ট দেখেছি)।
I am an old man of 72. The govt, CM and the administration is heartless, vindictive and demon and most oppressive. The entire machinery is rotten. All the strongest protest are hardly yielding any result. I support this movement from core of my heart. But I feel very sad for the fast to death move of the junior doctors. I fervently appeal to my respected loving doctors to withdraw this extreme step and continue the protest in other manner. You cannot fight against dead wall.
You are a very respected and god-gifted strata of the society. So please take practical approach to this barbaric act.