~এক~
পাড়াটায় ঢুকে তিন্না কেমন থতমত খেয়ে গেল। ফোনে যেমন শুনেছিল, তার সঙ্গে একেবারেই মিল নেই। এত বাড়ি তো থাকার কথা নয়? চারিদিকে মাঠ থাকার কথা না? ফোনে লেখা ডিরেকশনটা দেখে নিল আর একবার। চশমার দোকান, তার নাম নাকি চশমে বদ্দুর। বাবা বলত বাঙালির বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। ভাগ্যিস এই দোকানটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি!
ওই যে দোকানটা। তার উল্টোদিকে নাকি রাস্তা। ওটা রাস্তা? বলেছিল গাড়ি ঢোকে। তা ঢুকবে হয়ত, কিন্তু তবু, দুদিকের দোকান এমন উপচে পড়ছে, গাড়ি ঢুকলে নির্ঘাৎ ঝুলে থাকা চানাচুরের প্যাকেটে ঘষা খাবে। এর পরে মনসা মন্দির। সেটাও শুনেছিল – গাছতলায় ছোটো মন্দির, কিন্তু খুব নাকি ভীড়। গাছের নিচে?… ও বাবা! ওটা নাকি? বিরাট গেটের ওপর লেখা শ্রী শ্রী মনসা মাতার মন্দির, বাঁধানো হাতা, আড়াই তলা সমান উঁচু চুড়ো – এক হাত লম্বা মন্দিরের এ কী সাংঘাতিক শ্রীবৃদ্ধি!
এসব নাকি মাঠ ছিল। বাচ্চারা খেলত। কটা বাচ্চাই বা খেলত? পাড়াটাই তো ওইটুকু। শুনেছিল, মোট গোটা বিশেক বাড়ি। সবই মাঠের ওপারে। এখন তো মাঠ–ই আর বাকি নেই। সবই বাড়ি। হেঁটে যেতে যেতে তিন্না একটা তে–মাথার মোড় দেখতে পেল। তার মানে এখানেই মাঠ শেষ হয়েছিল। তারপরে ছিল পুরোনো সময়কার বাড়িগুলো। এখন রাস্তার ডানদিকে মাঠের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মোড়টার বাঁদিকে একটা ছোট্ট পার্ক দেখা যাচ্ছে। চারধারে উঁচু গ্রিলের বেড়া। ওই মোড়ে পৌঁছে বাঁদিকে ঘুরে ডানহাতে তিন নম্বর বাড়ি। অর্থাৎ পার্কের সামনেই। দোতলা ফ্ল্যাট। অর্থাৎ ঘর থেকে এই রুমাল সাইজের পার্কের ওপারে মন্দিরের চুড়ো দেখা যাবে।
হলদে রংচটা দেওয়াল নিয়ে দোতলা বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে দুদিকের বড়ো বড়ো চার–পাঁচতলা বাড়িগুলোর মধ্যে। দেখাচ্ছে বেমানান। দুদিকের বাড়িগুলো বেশ নতুন। এবং বড়ো। কী করে এই বাড়িটা প্রোমোটারের নজর এড়িয়ে রয়ে গেল? আশ্চর্য। দুদিকের বাড়িগুলো স্পষ্টতই এই বাড়ির ডবল বা তিনগুণ জমি দখল করে তৈরি। বাড়িটা তাদের মধ্যে কেমন ক্ষুদে লাগছে। তিন্না ভাবল, জানতে হবে কী করে বাড়িটা রয়ে গেল আগের দশায়।
ওপরতলা, নিচতলা দুই–ই সমান অন্ধকার। বাড়ির সামনের দিকে কেউ নেই, না বাড়িই খালি? বোঝার উপায় নেই। সামনে একতলার দরজা। রাস্তা থেকে চারটে সিঁড়ি উঠে দরজায় পৌঁছতে হয়। তিন্না দরজার পাশে লাগানো কলিং বেলের বোতাম টিপল। ভেতরে চিনচিনে শব্দ জানান দিল বেল বেজেছে। আদ্যিকালের ক্রিং ক্রিং বেল নয়, আজকালকার অত্যাধুনিক ইংরেজি নার্সারি রাইমের সুরে বাজা ইলেকট্রনিক বেল–ও নয়। মাঝামাঝি। বাড়ির ভেতরে নড়াচড়ার শব্দ নেই। রাস্তাটাও বিশেষ জনবহুল নয়। ওই দূরে একটা দোকানের আলো দেখা যাচ্ছে…
“কে?” দোতলার একটা জানলার একটা পাল্লা খুলল। তিন্না ঘাড় তুলে কাউকে দেখতে পেল না। বলল, “আমি ফোন করেছিলাম…”
“এক–মিনিট।” জানলা আবার বন্ধ হল। তিন্না দাঁড়িয়েই আছে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। কতক্ষণ লাগে রে বাবা, ওপর থেকে নামতে? গলাটা শুনে বোঝেনি পুরুষ না বয়স্ক মহিলা। দ্বিতীয়টা হলে অবশ্য ওপর থেকে নিচে আসতে সময় লাগতে পারে…
সে প্রতীক্ষারও শেষ হল। খট্ করে ছিটকিনি খোলার শব্দ হল। তারপরে নাইট–ল্যাচ খোলার শব্দ। দুপাল্লার দরজাটা মাঝখান থেকে কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে থেমে গেল। ভেতরের অন্ধকারে কে দাঁড়িয়ে, দেখা গেল না। গলা এল। আবার জানতে চাইল, “কে?” মিহি পুরুষকণ্ঠ। বয়স্ক নয়।
এত সাবধানতা? চারিদিকে তো ছাপোষা মধ্যবিত্তেরই বাড়িঘর। এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না তিন্না। ফলে উত্তর দিতে দেরি হল। খুট্ করে একটা শব্দের সঙ্গে মাথার ওপর একটা আলো জ্বলে উঠল। তারপরেই আবার, “ও, এক–মিনিট…” আবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তারপরে ঝনাৎ করে একটা চেন খোলার শব্দ – দরজা খুলল আবার।
“আপনিই ফোন করেছিলেন?” তিন্নারই বয়সী হবে।
তিন্না বলল, “হ্যাঁ। ওই বাড়িভাড়া…”
লোকটি দরজাটা পুরো খুলে দু–পা পেছিয়ে গেল। “আসুন, ভেতরে আসুন।” হাত তুলে সুইচ টিপল, তিন্নার মাথার ওপরে বাইরের আলোটা নিভে গেল। তিন্না ভেতরে ঢুকল। লোকটি আরও দু–পা পিছিয়ে গিয়ে আর একটা সুইচ জ্বালাল, এবারে লোকটার মাথার ওপর একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলল। ম্লান হলদে আলোয় তিন্না দেখল একটা প্যাসেজ। ইংরেজিতে একে বাড়ির ‘হল্’ বলা হয়। চওড়ায় বাইরের দরজার সমান। লম্বায় ফুট দশ বারো। মাঝামাঝি দু–দিকে দুটো দরজা। তার পেছনে কী আছে দেখা যাচ্ছে না।
ডানদিকের দরজাটা খুলে লোকটা বলল, “আসুন, আলো জ্বালাই। আসলে আমি ওপরে থাকি তো, তাই… অন্ধকার…”
‘আমি’ কথাটা তিন্নার কানে লাগল। নিচে তাকিয়ে কোনও চটি বা জুতো দেখতে পেল না, যদিও বাঁদিকে একটা নিচু দেওয়াল দেরাজ মতো রয়েছে। তার দরজা বন্ধ। এরকম বাড়িতে তার মধ্যে জুতো থাকে। পা থেকে চটি খুলে পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “বাইরের দরজাটা…?”
লোকটা ডানদিকের ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে বেরিয়ে এসেছে। বলল, “আপনি আসুন, আমি দিচ্ছি… ও, চটি খোলার দরকার নেই…”
তিন্না খালি পায়েই এগিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। রেড অক্সাইডের মেঝে। তবে দামী রেড অক্সাইড না। ওদের ছোটোবেলার বাড়ির মেঝের মতো উজ্জ্বল লাল নয়, একটু কালচে। হঠাৎ তিন্নার মন খারাপ করল। আজকাল বাড়ি ফেরা মানে কেবল বহরমপুর। বহুদিন হয়ে গেছে গ্রামের বাড়ি যায়নি…
বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে লোকটি ফিরল। বলল, “আপনার নামটা আপনি বলেছিলেন, কিন্তু আমি ঠিক শুনতে পাইনি ফোনে…”
তিন্না নাম বলে বলল, “আপনি অবশ্য আপনার নামটা বলেনইনি।”
“বলিনি? ও! আমার নাম জয়েন্দ্র। জয়েন্দ্র বাগচি। বসুন।”
বাহুল্যহীন সুসজ্জিত বসার ঘর। একটা সোফা সেট, আর দেওয়াল ঘেঁষে একটা সাইডবোর্ড। তবে আলোটা বড়োই টিমটিমে।
জয়েন্দ্র দেখল তিন্নার চোখের দৃষ্টি কোনদিকে যাচ্ছে। বলল, “বিজ্ঞাপনে লিখেছিলাম, ফার্নিশড ফ্ল্যাট – আপনি বিজ্ঞাপন দেখেই ফোন করেছিলেন?”
তিন্না মাথা নাড়ল। হ্যাঁ।
জয়েন্দ্র বলল, “ইয়ে, বেসিক ফার্নিচার আমি দেব। এই ঘরে সোফা, ও ঘরে খাট, আয়না, আলনা, আর খাবার ঘরে টেবিল চেয়ার। রান্নাঘরে গ্যাস, বার্নার। এর বাইরে কিছু লাগলে আপনি আনতে পারেন। আলোও আমি দেব। তবে এই আলো না। আমি ভালো আলোই দেব। আসলে হয়েছে কী, এর আগে যারা ছিলেন, তাঁরা আমাকে বলেন আলো কেটে গিয়েছে, ওনারা নিজেরাই লাগিয়ে নিয়েছেন। আমি অত ভাবিনি। কিন্তু তারপরে যাবার সময় সব আলো খুলে নিয়ে অন্ধকার করে গিয়েছেন, বলেছেন ওগুলো তো ওঁদের। আমি সেই জন্য ঠিক করেছি, আলো কেটে গেলেও আমিই এনে দেব, বা ভাড়া যারা নেবেন তাঁরা আনলেও আমি তার দামও দিয়ে দেব…”
জয়েন্দ্র থতমত খেয়ে থেমে বলল, “পরের কথা আগে বলছি, আসলে আপনি আলোটা দেখে ভাবছিলেন আমি বুঝি কেমন বাড়িওয়ালা…”
তিন্না হেসে বলল, “না, না।”
জয়েন্দ্র বললেন, “এটাই ফ্ল্যাট–টা। আমি ওদিকের দরজা দিয়ে আসা–যাওয়া করি। আপনি এসেছেন বলে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলাম। আপনি আগে বাড়িটা দেখে নিন, কেমন? তারপরে বাকি কথা…”
তিন্না চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল, “বেশ, চলুন।”
বসার ঘর, শোবার ঘর, রান্নাঘর, খাবার ঘর, একটা বাথরুম। মন্দ নয়।
“আপনাদের ক’জনের থাকা? আমার এইটুকুই জায়গা। বড়ো ফ্যামিলি হলে…”
তিন্না হেসে বলল, “আমি একা–ই থাকব। এতে আমার হয়ে যাবে। আর একটু ছোটো হলেও আমার আপত্তি ছিল না… তবে এ–ও ভালো। একটু আরামে থাকা যাবে।”
জয়েন্দ্র একটু অবাক হয়ে বলল, “একা? মানে, একা একজন মহিলা… এখানে…”
তিন্না গলাটা কঠিন করে বলল, “কেন? একজন মহিলা একা থাকতে পারেন না?”
জয়েন্দ্র একটু এমব্যারাসড সুরে বলল, “না, না। আমি তা বলতে চাইনি। আমি তো বলছিলামই, এই বাড়িতে একা, বা ছোটো ফ্যামিলি হলেই সুবিধে…”
একা–দোকা নিয়ে তিন্না আর কথা বলতে চায় না। তাই একটা দেওয়াল দেখিয়ে বলল, “ওদিকে কী আছে? বাইরে থেকে মনে হল গ্যারেজ?”
জয়েন্দ্র বলল, “হ্যাঁ। ওতে আমার গাড়িটা আছে।”
তিন্না বলল, “বাড়ির ভেতর থেকে ঢোকার রাস্তা…”
জয়েন্দ্র বলল, “সিঁড়ি থেকে। এই ফ্ল্যাট থেকে নেই। কেন?”
তিন্না বলল, “না, ঠিক আছে।” গ্যারেজ থেকে ঢোকার রাস্তা না–থাকাটা একটু স্বস্তির। অত কথায় গেল না তিন্না। বলল, “বাড়ি তো ভালো। তবে অন্ধকার তো, আর আলোও, যেমন আপনি বললেন, কম – দেওয়ালে ড্যাম্প বা সেরকম কিছু থাকলে বুঝতে পারব না…”
জয়েন্দ্র তাড়াতাড়ি বলল, “দেওয়াল… ড্যাম্প – না, না। এসব নেই। একেবারেই না। আপনি দেখবেন… আপনার যদি অপছন্দ না হয়ে থাকে, তাহলে বাকি কথা চলুন, ওপরে গিয়ে বলি। এই আলোতে বেশিক্ষণ থাকলে আমার মন খারাপ করে।”
সত্যিই বাড়ির আলোগুলো বড্ড ম্যারম্যারে। জয়েন্দ্রর পেছনে পেছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই তিন্নার মনটা বেশ খানিকটা আলোকিত হয়ে গেল। বেশ সুসজ্জিত বাড়ি তো! ভদ্রলোকের টেস্ট আছে। সিঁড়িতে ছবিগুলো চমৎকার।
“এগুলো কার…” প্রশ্নটা মাঝপথে বদলে “কি আপনার তোলা ছবি?” জানতে চাইল তিন্না।
“হ্যাঁ। সব। বিভিন্ন সময়ের।”
“আপনি ফোটোগ্রাফার?”
ওপরে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল জয়েন্দ্র। বলল, “না, না। আমি সেলস–এ আছি। আর্মাদিও কোম্পানি। নাম শুনেছেন?”
শুনেছে তিন্না, তবে না শোনাই ভালো। মাথা নেড়ে বলল, “না। কী প্রডাক্ট?”
জয়েন্দ্রর নিজের বাড়িটা নিচের চেয়ে অনেকটাই দামী। মেঝেতে টাইলস, দেওয়ালে ডিসটেম্পার, স্লাইডিং উইন্ডো, পেলমেট, পর্দা – আর, সবচেয়ে বড়ো কথা, ঝকঝকে আলো। তিন্না বোঝে না, কেন বাঙালিরা নিচের তলায় ভাড়াটে রেখে নিজেরা ওপরে ওঠে সিঁড়ি বেয়ে। সম্ভবত ওপরে আলো বেশি, আর নিচেটা ড্যাম্প হয় বলে। তবে তিন্নার মোটের ওপরে নিচের ফ্ল্যাটটাই বেশি ভালো লেগেছে। রেড অক্সাইডের মেঝে, চুনকাম করা দেওয়াল, আর খড়খড়ি দেওয়া কাঠের জানলা ওর অনেক বেশি পছন্দ। কিন্তু এসব কথা এখনই বাড়ির মালিককে বলে কাজ নেই। দাম–দর হোক, খবর নিতে হবে অনেক।
“আমার এই ফ্ল্যাটটা আপনার ওই ফ্ল্যাটের মতোই, শুধু একটা ঘর বেশি – ওই গ্যারেজের ওপরের ঘরটা। আসুন, বসুন।”
দামী সোফা সেট, দামী পর্দা। ঘর সাজাবার সব কিছুই বেশ দামী আর চোখে পড়ার মতো। তিন্না তারিয়ে তারিয়ে দেখল। জয়েন্দ্র, “এক্সকিউজ মি, চা, বা কফি?” জানতে চেয়ে ভিতরে গেল জল বসাতে। তিন্না টেবিল থেকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ইস্যু–টা নিয়ে ওল্টাতে লাগল।
“আমার কাছে বাড়ি নিলে আপনার দুটো সুবিধে হবে।” জয়েন্দ্র ফিরে এসে ওর সামনে বসে বলল, “এক তো আমি একা, অর্থাৎ সারাক্ষণ ওপরতলায় বাড়িওয়ালার উপস্থিতি সহ্য করতে হবে না। আর দুই, আমি মাসে দশ থেকে পনেরো দিন – কখনও তিন সপ্তাহ – শহরে থাকি না। আমার একসেট চাবি আপনার কাছে থাকবে, সুতরাং আপনি দুটো বাড়িতেই হাত–পা ছড়িয়ে থাকতে পারবেন।”
তিন্না হেসে বলল, “আমার হাত পা অত লম্বা নয় যে আমি নিচের সব ঘরে ছড়ানোর পরেও ওপরে এসে হাত পা চালাতে হবে। কিন্তু আপনি থাকেন না, কেন?”
জয়েন্দ্রও হাসল। বলল, “আমার যে বললাম, সেলস–এর চাকরি – সারা স্টেট ঘুরতে হয়, এমনকি তিন মাসে একবার স্টেটের বাইরেও যেতে হয় প্রোডাক্ট মিটিং অ্যাটেন্ড করতে।”
তিন্না বলল, “ওই আর্মাদিও কম্পানির প্রোডাক্ট? কী বিক্রি করেন?”
জয়েন্দ্র বলল, “ইতালিয়ানে আর্মাদিও মানে আলমারি। ওরা প্রথমে আলমারি বেচত। এখন সবরকম ফার্নিচার–ই তৈরি করে। এখানে যা দেখছেন সবই আমাদের তৈরি। ইন ফ্যাক্ট, নিচে যা আছে, সেগুলোও আমাদেরই। দেখবেন, ভালো, স্টাইলিশ, টেঁকসই। কেনার পক্ষে আইডিয়াল।”
তিন্না বলল, “সে তো আমি বুঝতেই পারছি, কম্পানির লোক যদি নিজেই নিজের জিনিস ব্যবহার করে, সে নিশ্চয়ই ভালো। তবে বাড়িওয়ালাই যদি বাড়ি সাজিয়ে দেয়, তাহলে ভাড়াটে আর কিনবে কী করে?”
জয়েন্দ্র আবার ভিতরে গিয়ে কফির কাপ নিয়ে এল। তিন্না লক্ষ করল, বেশ গোছানো লোক। ট্রে–তে লেসের ট্রে–ক্লথ, কফির কাপ, শুগার পট, মিল্ক – কোনওটারই অভাব নেই। চামচগুলো একপাশে একসঙ্গে সাজিয়ে রাখা। বেশ সাহেবী শুধু নয়, এ–বাড়িতে মহিলা নেই ভাবতে অসুবিধে হয়।
“কবে থেকে থাকতে পারবেন?” ভাড়া ইত্যাদি আলোচনার পরে, তিন্না থাকতে চায় জেনে জানতে চাইল জয়েন্দ্র। ততক্ষণে কফি শেষ, বাইরে সন্ধের আকাশের ম্লান আলোও নিভে এসেছে।
তিন্না বলল, “মাসের শুরু থেকেই থাকি? তবে তার আগে, উনত্রিশে রবিবার, যদি এসে আমার মালপত্র – মানে জামাকাপড় ইত্যাদি নামিয়ে দিয়ে যাই?”
জয়েন্দ্র বলল, “কিছু যদি মনে না করেন, তাহলে বাইশে রবিবার করবেন? কারণ বলি, উনতিরিশে আমি থাকব না। পঁচিশে বাইরে যাব। ফিরতে ফিরতে সেই দোসরা – আগামী মাসের।”
তিন্নাকে একলহমা ভাবতে হল। “বাইশে যদি আমি সব পোশাক আশাক এখানে রেখে যাই, তাহলে তো মাসের পয়লা তারিখ অবধি চালাতে পারব না।”
জয়েন্দ্র একটু তাড়াতাড়িই বলল, “না, আমি তা বলছি না। আমি বলছি, আমি তার মধ্যেই সব রেডি করে রাখব। আপনি বাইশ তারিখেই শিফট্ করতে পারবেন। বাড়িটা তো খালিই পড়ে আছে… আপনি শুধু আসবেন, আর কী…”
জয়েন্দ্র চুপ করে গেল কারণ তিন্না একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বলল, “ওই সময়ের ভাড়া আপনাকে দিতে হবে না।”
তিন্না সে নিয়ে ভাবছিল না। বলল, “ঠিক আছে। রবিবার সকালেই আমি সব কিছু নিয়ে চলে আসব।”
~দুই~
বেশ বাড়ি। তিন্না বহুদিন বাধ্য হয়ে হস্টেলে বা পেইং গেস্ট হয়ে কাটিয়েছে। ফলে বাড়িতে থাকার মজা ও ভালোই উপভোগ করে। আর শুধু বাড়িটাই ভালো, তা নয়, বাড়িওয়ালাও যেমন বলেছিল, নির্বিরোধী। যখন থাকে, নিজের মতো থাকে, আবার এসে রোজ আড্ডাও মারে। তিন্নার প্রায় তিন মাস হতে চলল, এর মধ্যে লোকটা বাইরেই কাটিয়ে দিল প্রায় দু–মাস।
তিন্না যে দিন এসে থাকতে শুরু করেছিল, সেদিনই বিকেলে জয়েন্দ্র এসে হাজির – হাতে একটা চাবির গোছা। বলেছিল, “এই নিন। আমার বাড়ির স্পেয়ার চাবির সেট। এখানে থাক। যদি হঠাৎ দরকার পড়ে?” তিন্না চাবিটা দরজার পাশের চাবি ঝোলানোর হুকে ঝুলিয়ে রেখে ফিরে দেখে ডাইনিং টেবিলের পাশের চেয়ার টেনে আরাম করে বসছে জয়েন্দ্র।
“চা, বা কফি আছে? নইলে আমি ওপর থেকে নিয়ে আসতে পারি।”
কফি ছিল, কিন্তু তক্ষুনি বানিয়ে খাওয়ান’র ইচ্ছে ছিল না তিন্নার। কিন্তু জয়েন্দ্র যে ভাবে বসেছিল, তাতে সে যে সহজে উঠবে না, তা–ও বোঝা যাচ্ছিল। তিন্নার মা খুব দুশ্চিন্তা করেছিলেন। “একা থাকবি – সোমত্থ মেয়ে… একজন পুরুষমানুষের বাড়িতে – লোকটা কেমন জানিসও না…?” ইত্যাদি। মা–কে বোঝানো কঠিন, কেন তিন্না অসহায় একজন মেয়ে নয়। অনেক দিন হয়েছে শহরে একা আছে। কাজের সূত্রে মানুষ চরিয়ে খাওয়ার অভ্যেসও হয়েছে। লোক চিনতে পারে।
নিজের বাড়ি থেকে আনা চা খেতে খেতে জয়েন্দ্র বলেছিল, “আমি বুধবার থেকে থাকব না। প্রায় দু’সপ্তাহ। প্রয়োজন হলে আপনি ভেতরে গিয়ে সব ঠিক আছে কি না দেখে নেবেন।”
অবাক হয়ে তিন্না বলেছিল, “আপনার বাড়ির – ভেতরটা?”
“হ্যাঁ, কেন? অসুবিধা হবে? আসলে খালি বাড়ি পড়ে থাকবে, সেজন্যই তো চাবি রেখে যাওয়া…”
তিন্না মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু সব চাবির একটা করে সেট নেওয়ার পরে খেয়াল করেছিল ওর বাড়ির বাইরের আর সিঁড়ির দরজার মাত্র দুটো করেই চাবি ওকে দিয়েছে জয়েন্দ্র। চাবি হাতে নেবার সময়ে কিছু ভাবেনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই ধরণের তালার তিনটে করে চাবি দেওয়া হয় – চাইলে চারটেও নেওয়া যেতে পারে কেনার সময়েই।
তিন্না সেদিনই দোকানে গিয়ে দুটো বড়ো তালা কিনে এনে একটা সিঁড়ির দরজার ভেতরে আর অন্যটা বাইরের দরজার বাইরে লাগানোর ব্যবস্থা করে নিল। যে বাড়িওয়ালা নিজের বাড়ির ভেতরে ভাড়াটের আনাগোনা অবাধ করে দেয়, তার হয়ত ভাড়াটের বাড়ির প্রাইভেসি নিয়েও বেশি মাথাব্যথা নেই। অবশ্য দু–দিকের দরজাতেই ভেতরে ছিটকিনি রয়েছে, তবু…
তবে জয়েন্দ্র এমনই মিনমিনে এবং চুপচাপ, যে ওর মাথায় এরকম কিছু আসতে পারে, তা–ও অসম্ভব বলেই মনে হয়। এবং ব্যাপারটা হলোও তাই – দিনের পর দিন, সপ্তাহ কেটে গেল, জয়েন্দ্র যে নতুন তালার উপস্থিতি লক্ষ করেছে, তা–ই মনে হয় না তিন্নার।
তবে ঘটনা একটা ঘটল মাস তিনেক পরে। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে মনে পড়ল আগের দিন রান্না করার সময় হলুদের কৌটোটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে প্রায় সবটা হলুদগুঁড়োই নষ্ট হয়েছে। যা আছে, তা দিয়ে রান্না করা যাবে না। অটো থেকে চশমে বদ্দুরের সামনে নেমে উলটো দিকের গলিতে ঢুকে দু–তিনটে বাড়ি পেরিয়ে মনসা মন্দির পেরিয়েই ডান হাতে মুদির দোকান। এমনিতে তিন্না ওখান দিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। বুঝতে পারে দোকানি আর খদ্দেরদের নজর ওর পিঠে বিঁধছে। পাড়ার দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করা তিন্নার পছন্দ নয়। লোকে অনর্থক কথা বলে। এটা সেটা জানতে চায়। অবিবাহিত, অল্পবয়সী একটা মেয়ে নিজে–নিজে, একা–একা থাকে–খায় শুধু নয়, বাজারও করে – এটা প্রতিবেশীদের অশেষ আগ্রহের কারণ। সেটা যতক্ষণ আড়ালে হচ্ছে ততক্ষণ তিন্নার আপত্তি থাকলেও বলার কিছু থাকে না। কিন্তু সেটা যখন সামনাসামনি এসে পড়ে – সওয়াল, বিচার, ‘এ আবার কেমনধারা’ জাতীয় রায় শুনতে হয়, তখন সহ্য করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই পাড়ার রাস্তাটা হনহনিয়ে হেঁটে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। বাজারহাট করতে হলে অফিস–ফেরতা করে আনে, নইলে নেট থেকে কিনে হোম–ডেলিভারি করিয়ে নেয়।
আজও দোকানি আর খদ্দেরদের নজর ওরই দিকে। আজ খদ্দের বলতে একজন বয়স্ক লোক, আর একজন অল্পবয়সী মহিলা। তিন্নার চেয়ে অল্পই বড়ো হয়ত, বা বিয়ে হয়ে গেছে বলে বড়ো দেখাচ্ছে। বয়স্ক লোকটি প্রায়ই থাকেন। দোকানির বন্ধুস্থানীয় হতে পারেন। মহিলাকে আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না তিন্না।
তিন্না দোকানের দিকে ফেরামাত্র থতমত খাওয়া তিন জোড়া চোখে ঘুরে গেল অন্য দিকে। অপ্রস্তুত, তাই প্রত্যেকের চোখই অন্য অন্য দিকে। তিন্না হাসি চেপে দোকানে ঢুকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “গুঁড়ো হলুদের প্যাকেট আছে? পঞ্চাশ গ্রাম…”
দোকানি অকারণে ব্যস্ত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন, আসুন… কাদেরটা দেব? আমার কাছে…”
তিন্না থামিয়ে দিয়ে বলল, “ভালো কোনও কম্পানির দিন…”
দোকানি দোকানের পেছন দিকে তাকিয়ে ডেকে বলল, “অ্যাই, শীতল, ক’টা হলুদের প্যাকেট বাড়া… পঞ্চাশ গ্রাম…” বলে তিন্নার ডান পাশে দাঁড়ান মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বৌদি, আপনার আর কিছু বাকি আছে, না দাম জুড়ব?”
মহিলা তিন্নার একটু পেছনে, তাই তিন্না বুঝতে পারছে না উনি কী করছেন, কিন্তু কোনও উত্তর এল না। দোকানিও বোকার মতো ওঁর দিকেই তাকিয়ে। তিন্না এদিক ওদিক শো–কেস–এ রাখা পণ্যের দিকে নজর দিল। তবে বেশি দেরি হল না, ভেতর থেকে একটি ছোকরা ছেলে – শীতলই বোধহয়, এগিয়ে এসে দু–তিনটে হলুদের প্যাকেট ফেলল দোকানির সামনে।
“এই যে, এই যে,” বলে দোকানি সবকটাই এগিয়ে দিলেন তিন্নার দিকে। তিন্না না তাকিয়েই একটা তুলে নিয়ে বলল, “কত?”
দোকানি আবার হাত বাড়ালেন। দাম মুখস্ত নেই। তিন্না হলুদের প্যাকেটটা আবার দোকানির হাতে দিয়ে ব্যাগ খুলল টাকা বের করার জন্য, দোকানি দাম বললেন, তিন্নার কাছে খুচরো নেই, একটু বড়ো একটা নোট দিল। তখনই ডান পাশ থেকে মহিলা বললেন, “আপনি ওই বাইশের দুই নম্বরে এসেছেন, না?”
তিন্না ডানদিকে তাকিয়ে সানগ্লাস খুলে মহিলাকে যেন প্রথম দেখল। এই ধরণের প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয় সাধারণত, তারপরে বাড়তে থাকে, তাই তিন্না এই প্রশ্নগুলোকে হয় পাত্তা দেয় না, নয়ত খুব সংক্ষেপে উত্তর দেয়। কিন্তু এই মহিলার প্রশ্নের সুরে, বা তাকান’র পরে মুখের ভঙ্গীতে কোনও অনাবশ্যক কৌতুহলের ছায়া নেই। বরং একটা উৎকণ্ঠার ছোঁয়া। তিন্না উত্তর দেবার আগেই আবার বললেন, “ওই, পার্কের সামনের হলদে দোতলা বাড়িটায়…?”
ঘাড় হেলাল তিন্না। বলল, “হ্যাঁ।”
ভদ্রমহিলা একটু এগিয়ে এলেন। বললেন, “কুসুমদি ভালো আছেন? অনেক দিন দেখা হয়নি…”
কুসুমদি?
তিন্না কিছু বলার আগে আবার মহিলা বললেন, “আপনার বাড়িউলি… কুসুমদি…”
তিন্না মাথা নেড়ে বলল, “বাড়িউলি নয়। আমার বাড়ির মালিকের নাম জয়েন্দ্র। বাড়িতে কোনও মহিলা থাকেন না।”
মহিলা খুব অবাক স্বরে বললেন, “সে কী!” তারপরে প্রায় অসহায়ের মতো দোকানি আর অন্য বয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন। তাঁদের মুখের ভাব দেখে তিন্নার মনে হলো ওঁরা কোনও দিন এই কুসুমদির কথা শোনেননি, এবং খুব ইন্টারেস্টও নেই। বরং দোকানি তিন্নার চেঞ্জ ফেরত দিয়ে মহিলাকে বললেন, “আপনার টোটালটা মাসকাবারি খাতায় লিখে দিয়েছি,” বলে একটা ছোটো খাতা বাড়িয়ে দিলেন।
তিন্না দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে শুনতে পেল মহিলা বলছেন, “আপনি শীতল কিংবা কার্তিককে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন…”
দোকানি কী উত্তর দিলেন শোনার আগেই তিন্না দোকান থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লেগেছে।
একটু গিয়েই বুঝল পেছনে দ্রুত পায়ের শব্দ। মহিলা তিন্নার চেয়ে অন্তত ইঞ্চি ছয়েক খাটো। তিন্না হনহনিয়ে হাঁটলে ধরতে পারবেন না। তবে তিন্না যাবেই বা আর কতটুকু? ওই তো পার্কের পরেই বাড়ির দরজা দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া, ব্যাগে পার্সটা ঢোকাতেও হবে…
পার্সটা ঢুকিয়ে তিন্না ব্যাগটা বন্ধ করতে করতেই মহিলা পাশে এসে গেলেন। একটু হাঁপ ধরা কণ্ঠে বললেন, “বাড়ির মালিক তো কুসুমদি?”
এখন দুজনে পার্কের পাশে। পার্কে কেউ নেই, সামনের ফুটপাথের গায়ে পাড়ার যত গাড়ি পার্ক করা। এখানে বেশিরভাগ বাড়িতেই ফ্ল্যাটের তুলনায় পার্কিং কম। তিন্না দাঁড়িয়ে পড়ল। জয়েন্দ্র শহরে নেই, কিন্তু তবু কেন জানি তিন্না মহিলাকে নিয়ে বাড়ির কাছে যেতে চায় না।
তিন্না বলল, “দেখুন, আমি বাড়ি ভাড়া নিয়েছি জয়েন্দ্র বাগচির কাছ থেকে। আমি নিচে থাকি, উনি থাকেন ওপরে। আমি বাড়ি ভাড়া নেওয়ার দিন একদিনই ওপরে গিয়েছি, তখন অবশ্য সারা বাড়ি দেখিনি, কিন্তু যা দেখেছি, এবং এ ক’দিনে যা বুঝেছি, উনি একা–ই থাকেন।”
ভদ্রমহিলা সজোরে মাথা নেড়ে বললেন, “জয়েন্দ্র আবার কে? কুসুমদির তো ছেলেমেয়ে নেই?”
তিন্না কী বলবে বুঝতে পারল না। একটু চুপ করে থেকে বলল, “আপনি ঠিক জানেন?”
আবার সজোরে ঘাড় হেলালেন মহিলা। বললেন, “আমার সঙ্গে কথা হত রোজ। ওনার শোবার ঘর ছিল…” বলে হাত তুলে দেখালেন তিন্নার বাড়ির দিকে, “দোতলায় ওই–পাশের পেছনের দিকের ঘরটা। আর আমাদের ছাদটা, এখান থেকে দেখা যায় না, আমাদেরটা একতলা বাড়ি কি না… ঠিক ওরই পেছনে একটু ত্যারচা করে। ফলে ছাদের কোণে দাঁড়ালে ওই ঘরটার সমান সমান হয়ে যায়। রোজ কথা হত… কিন্তু প্রায় বছরখানেক হলো আর দেখি না। তারপরে তো আজকাল অনেক দিন হয়ে গেল সারাক্ষণই পর্দা টানা থাকে…”
তিন্না এবারে একটু জোর দিয়েই বলল, “দেখুন, আমাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন যিনি, তাঁর নাম জয়েন্দ্র বাগচি। উনি ওপরে থাকেন, আমি থাকি নিচে। ওপরে আর কেউ থাকেন না। সুতরাং…”
ভদ্রমহিলা কিছু বললেন না, শুধু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন পার্কের গ্রিলের গেটের দিকে। তিন্না কি এগোবে? না অপেক্ষা করবে? হঠাৎ মুখ তুলে মহিলা বললেন, “এই জয়েন্দ্র বাগচি কি ফর্সা, রোগাটে গড়ন, পাতলা চুল? একটা পুরোনো মারুতি গাড়ি চালান – লাল রং?”
চালান বললে বাড়াবাড়ি হয়। গাড়িটা পড়ে থাকে তিন্নার শোবার ঘরের পাশের গ্যারেজে। জয়েন্দ্র মাসে দু–তিন দিন সন্ধের পরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত খুব বাড়বার আগেই। বলে সিনেমা গিয়েছিল। একদিন জানতেও চেয়েছিল, তিন্না কি যাবে সিনেমায়? তিন্নার সিনেমায় কোনও ইন্টারেস্ট নেই শুনে বলেছিল, তাতেও আপত্তি নেই, একটু নদীর ধারে ঘুরে ওখানকার দৃশ্য দেখে, বাইরে খেয়ে ফেরা যেতে পারে। তিন্না যায়নি, তবে দেখেছে গাড়িটা লাল–ই বটে। গাড়িটা নিয়ে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, কাজের সুবিধার জন্য কিনেছিল, তখন কম্পানি কার–অ্যালাওয়েন্স দিত। পরে টানাটানি হওয়ায় অ্যালাওয়েন্স বন্ধ হয়ে যায়। তাই পড়েই আছে। মাঝে মাঝে শুধু চালান’র জন্যই চালায়।
“বেচে দিতে পারেন তো?” জানতে চেয়েছিল তিন্না।
জয়েন্দ্র হেসেছিল। “দাম পাব না। তার চেয়ে থাক, বেচারা। যতদিন চালান’ যায়…”
আবার মাথা নাড়লেন মহিলা। বললেন, “ও তো ভাড়াটে ছিল। নিচে থাকত।”
এবার বিরক্তি না হলেও গলায় একটু অধৈর্যের সুর আনল তিন্না। “দেখুন, আমি ভাড়াটে মাত্র। ভাড়াটের কাছে বাড়িওয়ালা ডিটেল জানতে চাইতে পারেন, সেটা আইনত সিদ্ধ। কিন্তু ভাড়াটে তো আর বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতে পারে না, আপনি কি এই বাড়ির মালিক? কই দেখি, আপনার মালিকানার প্রমাণ দেখান… কিন্তু পাড়ার লোকে তো জানতে চাইতে পারে? আপনারা সবাই এসে জিজ্ঞেস করুন না, ওই কী বললেন, কুসুমদি – কোথায় গেলেন?”
মহিলা এবারে একেবারেই থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন, “আসলে কী জানেন, পাড়াটা সেরকম নয়।”
“সেরকম নয় মানে? কী রকম নয়?”
মহিলা হঠাৎ হুড়হুড় করে বলে ফেললেন, “জানেন, আগে পাড়াটা নাকি খুব ভালো ছিল। সবই ওই একতলা, দোতলা বাড়ি – সামনে এইটা,” বলে পার্কটা দেখালেন, আর তারপরে রাস্তার ওদিকটা দেখিয়ে বললেন, “সবটা জুড়ে ছিল মাঠ। তখন সবার সঙ্গে সবার খুব সদ্ভাব ছিল বলে শুনেছি। শুনেছি গত বছর পনেরোয় সবই কেমন বদলে গেছে। প্রথমে এই মাঠের দিকটা বিক্রি হয়ে গেল, তারপরে এক এক করে পুরোনো বাড়িগুলো। কোনও রকমে তখনকার কাউনসিলরকে ধরে মাঠের এই অংশটা বাঁচল। মানে পার্ক করে দেওয়া হল আর কী। আর খানিকটা বাঁচল মনসা মন্দিরটার কল্যাণে। প্রোমোটাররা পুরোনো বাড়িগুলোর দিকে নজর দেবার পর থেকে শুনেছি পাড়াটাই বদলে গেল। এক এক করে সবকটা মাল্টিস্টোরি হয়ে গেল। আর পাড়ার পুরোনো বাড়িগুলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে ওই মাল্টিস্টোরির ফ্ল্যাট মালিকদের কখনওই বনিবনা হলো না। এই যে এত বাড়ি, দেখবেন, যারা পুরোনো বাড়িতে থাকে, তাদের সঙ্গে এই ফ্ল্যাটবাড়ির লোকের কোনও সদ্ভাব নেই। আমরা যতটা পারি একে অপরকে এড়িয়ে চলি। আর পুরোনো বাড়ি আছেই বা কটা বাকি? ওই আপনার বাড়িটা, ওটার পেছনে – ওই আপনার বাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে গলিতে ঢুকতে হয়, আমাদের বাড়ি – আর আরও ভেতরে গোটা ছয়েক, সাতেক। ব্যাস। কেউ কারওর ব্যাপারে থাকে না। জানেন, এই পার্কে পুজো হয়, আমাদের থেকে চাঁদাও নেওয়া হয়, কিন্তু ভোগ–প্রসাদ কিছুই পাই না। এসে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়… কথাবার্তা যতটুকু হয়, সবই কথা কাটাকাটি। এইটুকু পাড়া, এইটুকু –টুকু রাস্তা, তাতে দেখুন, কত ফ্ল্যাট – সবার গাড়ি, সেগুলো রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে রাস্তা দিয়ে চলা দায়, বাইরে থেকে কেউ গাড়ি নিয়ে আসলে রাখার জায়গা নেই… শুধু তাই না, কী নোংরা… সবই এই ফ্ল্যাট…”
বোধহয় তিন্নার মুখের ভাব দেখেই মহিলা থেমে গেলেন। তারপরে বললেন, “কিন্তু কুসুমদির যে কী হলো, কী করে জানা যাবে…”
~তিন~
পরদিন ভোরে তিন্নার ঘুম ভাঙল জয়েন্দ্রর দিকের দরজা খোলার শব্দে। এই ক’মাসে সিকোয়েনসটা চিনে গেছে তিন্না। সিঁড়ির দরজার বাইরে জয়েন্দ্র তালা লাগায় না। শুধু হুড়কো লাগায়, আর এই হুড়কো খোলে সামান্য শব্দেই। তারপরে চাবি দিয়ে দরজার নাইট–ল্যাচ খোলে জয়েন্দ্র। তাতেও প্রায় শব্দ হয় না। কিন্তু এর পরেই দরজার একটা পাল্লা ঠেলার শব্দ হয়। ভারি বাইরের দরজাটা ঝুলে গেছে বয়সের ভারে। নিচটা মাটিতে লেগে যায়। ঘ্যাঁস্ করে শব্দ হয়। অন্যান্য দিন দরজার অর্ধেকটা খুলে জয়েন্দ্র ঢুকে পড়ে, কিন্তু সঙ্গে লাগেজ থাকলে অন্য পাল্লাটাও খোলে। খট্ করে ছিটকিনি নামার শব্দ হয়। এই পাল্লাটাও ঝুলে গেছে, কিন্তু এটার ঘ্যাঁস্ শব্দটা হয় দরজাটা প্রায় পুরোটা খুলে যাওয়ার পরে। তিন্না বিছানায় শুয়েই শুনল জয়েন্দ্র বড়ো স্যুটকেসটা গড়িয়ে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করল। ছিটকিনি লাগাল, নাইট–ল্যাচ বন্ধ হল, ঘুমটা পুরোটা ভেঙে গেছে বলেই সিঁড়ির আলোর সুইচের খুট শব্দ পেল, বড়ো সুটকেসটা নিয়ে সিঁড়ি উঠলে ধাপে ধাপে লেগে ঘুট–ঘুট করে যে শব্দটা হয়, সেটা ওপর দিকে মিলিয়ে গেল, তারপরে শুনতে পেল ওপরের দরজা খোলা, এবং বন্ধ হবার শব্দ। তিন্না মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল ওর আন্দাজ ঠিক। ছটা তেইশ। ভোরে ফিরলে এইরকম সময়েই ফেরে জয়েন্দ্র। পাশ ফিরে শুল। জয়েন্দ্র এই সময়ে ফিরলে অফিস যায় দেরিতে। দশটা সাড়ে–দশটা নাগাদ ঘুম থেকে ওঠে। ততক্ষণে তিন্না সাধারণত থাকে না। তবে জানে। জয়েন্দ্রর রুটিনটা ওর মুখস্ত। তিন্না আজও থাকবে না। সাড়ে আটটা নাগাদ বেরিয়ে যাবে। কুসুমদির ব্যাপারটা জয়েন্দ্রকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কিন্তু সকাল সকাল না।
বিকেলবেলা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই ফিরল তিন্না। জয়েন্দ্র নেই। ওর ফিরতে অন্তত আরও ঘণ্টা দুয়েক। সাধারণত জয়েন্দ্র ফিরে এসে তিন্নার সিঁড়ির দিকের দরজায় টোকা দেয়। চা চেয়ে খায় এক কাপ। তিন্না রোজের মতো পেছনের দরজার তালাটা খুলে রাখল। সময়েই ফিরল জয়েন্দ্র। সন্ধের অন্ধকার তখন আকাশ ছেয়েছে, রাস্তার আলোগুলো সবে জ্বলে উঠেছে, এমন সময় সিঁড়ির দরজা খুলল ঘ্যাস্ শব্দে, বন্ধ হলো, তারপরেই প্রত্যাশিত টোকা পড়ল দরজায়। তিন্না উঠে খুলে দিয়ে সরে গিয়ে বলল, “আসুন।”
জয়েন্দ্র এল। তিন্না জিজ্ঞেস করল, “সকালে ফিরলেন?”
জয়েন্দ্র ঘাড় হেলাল। “ভোরে। তখনও আপনি ঘুমোচ্ছিলেন।”
ঘাড় নাড়ল তিন্নাও। চায়ের জল বসাল। স্বভাবসুলভ এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে জয়েন্দ্র। টেবিলের ওপর তিন্নার ফাইলটা একবার উলটে দেখল। জটিল আই–টি ডকুমেন্ট। তিন্না চা বানিয়ে এক কাপ জয়েন্দ্রর সামনে রেখে নিজের কাপটা নিয়ে টেবিলে বসল। বলল, “দেখুন, ঠিক হয়েছে কি না।”
জয়েন্দ্র বলল, “সবসময় একই কথা বলেন। এখন অবধি ভুল তো পাইনি কখনও।”
তিন্না হাসল। তারপরে বলল, “জানেন, সেদিন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো।”
জয়েন্দ্র চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। থেমে বলল, “কী?” বলে আবার চায়ের কাপ মুখে তুলল।
তিন্না বলল, “কুসুমদি বলে কাউকে চেনেন?”
জয়েন্দ্র থমকে গেল। তিন্না ততক্ষণে নিজের কাপ তুলে নিয়েছে। ওর চোখ কাপের চায়ে। জয়েন্দ্রর মুখ চোখ থেকে অবাক বিস্ময়টা মুছে যাবার পরে কাপ নামিয়ে আবার তাকাল ওর চোখের দিকে।
জয়েন্দ্রর ভুরু কুঁচকোন। “কুসুমদি… তার কথা কে বলল আপনাকে?”
তিন্না বাঁ হাত তুলে নিরুদ্দেশের দিকে দেখিয়ে বলল, “সেদিন পাড়ার দোকানে গেছিলাম। একজন মহিলা, বললেন ওদিকে থাকেন…” ডান হাত তুলল, এমনভাবে যাতে ওদিক বলতে হনলুলু থেকে সুন্দরবন যা খুশি বোঝাতে পারে, “উনি জানতে চাইছিলেন। বললেন, বাড়ি নাকি ওই কুসুমদির। আপনি নাকি ভাড়াটে। তাই…”
জয়েন্দ্র চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করল, “কী নাম মহিলার?”
মাথা নাড়ল তিন্না। “আমি জিজ্ঞেস করিনি। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে বেশি গপ্পো করা আমার পোষায় না।”
জয়েন্দ্রও মাথা নাড়ল। অনুমোদনসূচক। “আপনি কী বললেন?”
তিন্না আবার চায়ে চুমুক দিল। বলল, “আমি বলে দিয়েছি, বাড়ি আপনার, আর এ বাড়িতে কোনও কুসুমদি থাকেন না। ঠিক বলেছি না?”
জয়েন্দ্র আবার কাপটা তুলে নিল। তারপরে আবার নামিয়ে রেখে বলল, “ঠিকই বলেছেন। কুসুমদি বলে কেউ নেই।”
একটু আগে জয়েন্দ্র বলেছে, ‘তার কথা কে বলল আপনাকে?’ কিন্তু সে কথা তিন্না বলল না। গলায় নিশ্চিন্ত সুর এনে বলল, “হ্যাঁ। উনি একটু কী রকম যেন করছিলেন, বলছিলেন উনি কুসুমদিকে চেনেন… আমি বলেছি পুলিশকে খবর দিতে।”
জয়েন্দ্র কেমন চমকে বলল, “সে কী! পুলিশকে খবর দিতে বলেছেন?”
তিন্না অবাক। কেন? বলবে না? ভুল বলেছে কিছু?
জয়েন্দ্র বলল, “না, মানে… পুলিশ টুলিশ কেন?”
তিন্না হাসল। বলল, “কারওর মনে যদি সন্দেহ হয়ে থাকে, তাহলে তার নিরসনের একটা ব্যাপার থাকে তো? তাই বলেছি।”
জয়েন্দ্র আমতা আমতা করে বলল, “আর পুলিশ আসলে কী বলবেন?”
তিন্না আরও অবাক। বলল, “পুলিশ আমার কাছে আসবে কেন? আপনাকে জিজ্ঞেস করবে। আপনি বলে দেবেন, কুসুম বলে কেউ নেই। ছিলও না। বাড়ি আপনার। ব্যাস।”
“হ্যাঁ, তা বটে…” বলে জয়েন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তিন্না বলল, “তবে মহিলা কোথাও যাবেন বলে মনে হলো না। বরং পুলিশের কথা বলায় একটু যেন ঘাবড়েই গেলেন। বললেন, পাড়াটা অদ্ভুত। কেউ কারওর সাতে পাঁচে থাকে না। বিশেষ করে ওই ফ্ল্যাট–বাড়ি আর এরকম পুরোনো বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে নাকি সম্পর্ক ভালো নয়।”
জয়েন্দ্রকেও একটু নিশ্চিন্ত দেখাল। বলল, “ঠিক বলেছেন। জানেন, ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর লোকেরা নিজেদের মধ্যেও ভালো সম্পর্ক রাখে না। খুব খেয়োখেয়ি। পুজো আসুক, দেখবেন।”
তিন্না পুজোয় থাকবে না। বহরমপুর যায় প্রতি বছর। এবারেও যাবে। তবে ততদিন এ–বাড়িতে পড়ে থাকা যাবে না।
কথা আর বিশেষ এগোল না। আধখানা চা খেয়েই জয়েন্দ্র বিদায় নিল। তিন্না মন দিল রাতের রান্নায়।
খেয়েদেয়ে তিন্না শুয়ে শুয়ে ল্যাপটপে সিনেমা দেখছিল। হঠাৎ মনে হলো সিঁড়ির দরজায় যেন টোকার শব্দ হচ্ছে? সিনেমাটা মাঝপথে থামিয়ে শোবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। সব নিশ্চুপ। তারপরে আবার শুনতে পেল, সিঁড়ির দরজায় বাইরে থেকে, টুক–টুক–টুক… সাধারণত যতটা জোরে টোকা দেয় জয়েন্দ্র তার চেয়ে অনেক আস্তে। অর্থাৎ, ও বুঝতে পারছে না তিন্না জেগে আছে কি না। তিন্না ইয়ারফোন দিয়ে সিনেমা দেখে, সুতরাং শব্দও বাইরে যায়নি। তবে হয়ত ওপর থেকে ওর খোলা জানলায় ঘরের আলো দেখেছে। জবাব যদি না দেয়, কী–ই বা হবে? ভাববে তিন্না ঘুমোচ্ছে। চলে যাবে। তিন্না একবার ঘুরল আবার ঘরের ভেতরে ফিরে যাবার জন্য। তখনই আবার টুক–টুক করে টোকা পড়ল দরজায়। নাঃ, উত্তর না দিলে তিন্নার বক্তব্যটা জয়েন্দ্রর জানা হবে না। সেটাও জরুরী। তিন্না এসে খাবার ঘর থেকে সিঁড়ির দিকের দরজায় দাঁড়াল। বলল, “কে?”
প্রশ্নটা অর্থহীন, কিন্তু এ ছাড়া আর কী বলবে? বাইরে থেকে জয়েন্দ্রর গলা অস্পষ্ট। “আমি। দরজাটা একটু খুলবেন?”
তিন্না মাথা নাড়ল। বন্ধ দরজার ওপারে জয়েন্দ্র দেখতে পাবে না, তবু নাড়ল। বলল, “এখন রাত প্রায় এগারোটা। এখন কী চাইছেন?”
“একটা কথা বলব। খুব জরুরী।”
“না। জয়েন্দ্রবাবু, এখন এত রাতে জরুরী কথা শোনার জন্য দরজা খুলব না। কিছু মনে করবেন না। আমি রাত–পোশাক পরে নিয়েছি, এখন আবার বদলাতে পারব না। কাল সকালে বলবেন? না হলে ফোন করুন?”
একটু চুপ করে থেকে জয়েন্দ্র বলল, “আচ্ছা। কাল সকালে আপনি তো সাড়ে ন’টার মধ্যে বেরিয়ে যাবেন?”
তিন্না বলল, “আপনি সাড়ে আটটায় আসুন, আমি রেডি হয়ে থাকব। এক ঘণ্টা যথেষ্ট তো?”
জয়েন্দ্র ঘাড় নাড়ল কি না তিন্না দেখতে পেল না। কিন্তু, “আচ্ছা। সাড়ে আটটায় আসব,” বলে জয়েন্দ্র চলে গেল। তিন্না কিছুক্ষণ দরজায় কান লাগিয়ে রইল। জয়েন্দ্রর পায়ের শব্দ না পেলেও ওপরে দরজা বন্ধ হবার শব্দ পেল। তারপরে আবার একবার নিজের বাড়ির দুটো দরজাই ভালো করে বন্ধ আছে কি না দেখে নিয়ে শুতে গেল।
পরদিন সকালে জয়েন্দ্র ঠিক সাড়ে আটটায় হাজির। তিন্না তৈরিই ছিল। ওপরে জয়েন্দ্রর দরজা বন্ধ হওয়া মাত্র সিঁড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল। জয়েন্দ্র ঘরে ঢুকে একটু কাঁচুমাচু মুখে হেসে বলল, “স্যরি, কাল রাতে…”
তিন্না হাসল। বলল, “না, ঠিক আছে। আসলে কী জানেন তো, একা থাকি তো, তাই নানারকম প্রিকশান…”
জয়েন্দ্র বলল, “না না। ঠিকই বলেছেন। আমারই ভুল হয়েছে।”
তিন্না কেটলি থেকে কফি প্রেস–এ গরম জল ঢেলে বলল, “সে যা হোক। কী বলতে এসেছিলেন?”
জয়েন্দ্র আমতা আমতা করে বলল, “আসলে… ইয়ে… আসলে কী জানেন, এই বাড়িটা সত্যিই কুসুম মুখার্জীর।”
তিন্না কফি প্রেসটা টেবিলে রেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বলল, “সে কী! তবে আপনি যে কাল বললেন…?”
জয়েন্দ্র মাথা নিচু করে বলল, “পুরোটা শুনলে বুঝবেন। আসলে কুসুম মুখার্জী বাড়ির মালিক। উনি বেশ বয়স্ক মানুষ, একা থাকতেন। আমি ছিলাম ভাড়াটে। উনি ওপরে থাকতেন, আমি নিচে। মানে এখানে। উনি ওখানে, মানে আমি এখন যেখানে…”
তিন্না থামিয়ে দিয়ে বলল, “বুঝেছি। উনি ওপরে, আপনি নিচে। তা, সমস্যাটা কী হলো?”
জয়েন্দ্র বলল, “হ্যাঁ। মানে আসলে ওনার কেউ নেই। একা। আমিই সব কিছু করে দিতাম। আমাকে বলতেন তুমি আমার ছেলে। আমার পরে এ বাড়িটা আমি তোমাকেই দিয়ে যাব।”
তিন্নার বুকটা ধক্ করে উঠল। বলল, “তারপর?”
জয়েন্দ্র বলল, “না, সেরকম কিছু না। বয়স্ক ছিলেন, তবে অসুস্থ নন। চলাফেরা করতে অসুবিধে ছিল না, তবে বাড়ি থেকে বেরোতেন না। যাবার তেমন কোনও জায়গা ছিল না, আর পাড়ার লোকেদের সঙ্গে – জানেনই তো কেন – সদ্ভাব ছিল না। সারাক্ষণ ফ্ল্যাট–বাড়ির লোকেদের ওপর রেগে থাকতেন। আমি কত বলতাম…”
তিন্না বলল, “কী বলতেন?”
জয়েন্দ্র বলল, “না, মানে সেরকম কিছু বলতাম না। মানে বলতাম সদ্ভাব রেখে চলতে – তাহলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্পও তো করা যায়, তা শুনতেন না। একবার আমি বাইরে থেকে ফিরেছি, দেখি ওপরতলায় সব বন্ধ। সব জানলা–টানলা – সবকিছু। অবাক হয়ে ভাবছি কী হল, তখন তো আমি নিচে – দরজা খুলে ঢুকে দেখি আমার খাবার টেবিলে – এইখানে, ওপরের সব চাবি, আর একটা চিঠি…” জয়েন্দ্র পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ খুলে তিন্নার সামনে ধরল…
তিন্না হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল। একটা চিঠিই বটে। হাতে লেখা।
জয়,
হঠাৎ ঠিক হলো বলে তোমাকে জানিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না, কিন্তু আমি তোমার বুদ্ধি নিয়েই আমার মাসতুতো বোনের সঙ্গে ওদের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছি। ওরা আমার ছোটোবেলার খুব কাছের ভাই–বোন ছিল, আজ আমাকে আর একা রাখতে চায় না। তাই যাচ্ছি। কম দিনের জন্য না, তাই তোমাকে ওপরের চাবিটা দিয়ে গেলাম। তুমি এখন হাত পা ছড়িয়ে ওপর নিচ মিলিয়ে থাকতে পারো। আমি ওখানে পৌঁছে তোমাকে চিঠি দেব।
ইতি,
তোমার মাসিমা
তিন্না চিঠিটা ফেরত দিল। বলল, “কবে লিখেছেন, তারিখ দেননি।”
জয়েন্দ্র চিঠিটা উলটে আবার বাড়িয়ে দিল। “আমি লিখে রেখেছি। এই যে…” তিন্না আর চিঠিটা নিল না। উঁকি দিয়ে দেখে বলল, “প্রায় সতেরো মাস আগের…”
জয়েন্দ্র আবার চিঠিটা পকেটে রেখে বলল, “হ্যাঁ। সেই থেকে আমি এই বাড়িতে একা…”
তিন্না বলল, “এটা উনি আপনাকেই লিখেছেন? উনি আপনাকে জয় বলতেন? এর পরে আর কোনও চিঠি আসেনি? এই মাসতুতো বোন কে? কোথায় থাকেন?”
জয়েন্দ্র বলল, “হ্যাঁ। আমাকে জয় বলতেন। আর কোনও কিছুই আমি জানি না। এই মাসতুতো বোনের কথা উনি কোনও দিনই আমাকে বলেননি। সুতরাং কোথায় গিয়ে থাকতে পারেন, এই শহরেই, না দূরে কোথাও, কিছুই আমি জানি না।”
তিন্না বলল, “আপনার বাড়িতে ঢুকে চাবি রেখে গেছিলেন মানে আপনার চাবি ওঁর কাছে ছিল?”
জয়েন্দ্র বলল, “ছিল তো। আমি তো থাকি না – হঠাৎ বিপদ আপদ হলে যদি ঢুকতে হয়? তা সেটাও একই সঙ্গে রেখে গেছিলেন।”
তিন্নার হঠাৎ খেয়াল হল। বলল, “বেশ, উনি নয় আপনাকে বাড়িতে থাকার অনুমতি দিয়ে গেছেন। কিন্তু বাড়ি ভাড়া দেবার অনুমতি তো দেননি?”
জয়েন্দ্র এবার একটু অস্বস্তিতে পড়ল। বলল, “সেটা আমি একটা অন্যায় করেছি। স্বীকার করছি। আসলে কী জানেন, আমার কম্পানি তো এখন একটু ফাইনানশিয়াল ক্রাইসিসে আছে, তাই আমাদের অনেক অ্যালাওয়েন্স ট্যালাওয়েন্স কমিয়ে দিয়েছে। তাই ভাবলাম…”
তিন্না গলাটাকে কঠিন করে বলল, “তাই ভাবলেন বাড়িটা বেআইনিভাবে ভাড়া দিয়ে টাকাটা নিজেই নেবেন, তাই তো?”
কাঁপা গলায়, “না, না…” বলে জয়েন্দ্র চুপ করে গেল।
তিন্না তেমনই কঠিন গলায় বলল, “না না কী? আপনি আপনার মাসীমাকে – কী নাম? কুসুম মুখার্জী – ওনাকে ভাড়া দিচ্ছেন?”
জয়েন্দ্র মুখ তুলে বলল, “ইয়ে কী করে দেব? ক্যাশ দিতাম যে। কিন্তু তা তো আর…”
তিন্না বলল, “অন্তত এইটুকু করুন, যে ভাড়াটা একটা আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করে রেখে দিন…”
জয়েন্দ্র প্রায় হাতে চাঁদ পাবার মতো করে বলল, “হ্যাঁ। এটা ভালো আইডিয়া… আপনার আর আমার দুজনেরই…”
তিন্না মাথা নাড়ল। বলল, “না। আমার ভাড়াও আমি আর আপনার হাতে দেব না। ইন ফ্যাক্ট, এই বাড়িতে আমি আর থাকব কি না সেটাও আমাকে ভাবতে হবে। গতমাসের ভাড়া অবধি আমি আপনার হাতে দিয়েছি, কিন্তু আর দেব না। আমি আমার ভাড়া নিয়ে কী করব সে বিষয়ে আমি আমার অফিসের ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলব।”
জয়েন্দ্র বলল, “আর…”
তিন্না বলল, “আর কী?”
জয়েন্দ্র বলল, “পাড়ার লোকেদের আপনি কি কিছু বলবেন? পুলিশকে?”
তিন্না মাথা নাড়ল। “পাড়ার লোকেদের সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় নেই। আর, পুলিশের কাছে গিয়ে আমি কী বলব? আপনি বলুন।”
জয়েন্দ্র বলল, “আমি? আমিই বা কী বলব?”
তিন্না ভাবল একটু। বলল, “সবই বলবেন।”
জয়েন্দ্র বলল, “আমি এ নিয়ে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু পুলিশের কাছে যাওয়া মানে… বুঝছেন তো?”
তিন্না মাথা নাড়ল। বুঝছে না। “কী হবে গেলে?”
জয়েন্দ্র বলল, “ওরা কী বুঝতে কী বুঝবে… আমি কেন এতদিন পরে আসছি? কী বলব?”
তিন্না বলল, “বলবেন – এই চিঠি পেয়ে অপেক্ষা করেছেন। তারপরে এখন মনে করছেন আর অপেক্ষা করা উচিত হবে না।”
“আর ওরা তো এখানেই এসে হাজির হবে।”
তিন্না এবার বিরক্তির সুর বের করল। “এখানেই থাকতেন উনি। এখান থেকে গেছেন। পুলিশ এখানে আসবে না তো কি রাজভবনে যাবে?”
জয়েন্দ্র খুব কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “না। মানে আমাদের অশান্তি বাড়বে…”
তিন্না কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, “দেখুন, একটাই সমস্যা। যদি পরে জানা যায় কুসুম মুখার্জীর চলে যাওয়ার পেছনে কোনও গণ্ডগোল আছে, তাহলে আপনাকেই পুলিশ আগে ধরবে – কেন আমাদের কিছু জানাননি, এতদিন ধরে মহিলার কোনও খবর না পেয়েও কিছু করেননি কেন? তখন কী বলবেন?”
জয়েন্দ্র ঘাড় কাত করল। কিছু বলল না।
তিন্না বলে চলল, “আমার সাজেশন, আপনি আজই লোকাল থানায় যান। আপনার বাড়িভাড়ার কোনও ডকুমেন্ট আছে? আমার সঙ্গে তো আপনি কোনও লিগাল দলিল–টলিল করেননি। সে নাহয় আপনি বাড়ির মালিক নন বলে। কিন্তু আপনার সঙ্গে কুসুম মুখার্জীর কোনও দলিল হয়েছিল?”
মাথা নাড়ল জয়েন্দ্র। না।
“তবে ওই চিঠিটাই নিয়ে যান। সব খুলে বলুন। বলুন আপনার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না বলে এসেছেন। তারপরে ওদের ভাবতে দিন।”
চিন্তিত জয়েন্দ্রকে সিঁড়ির দরজা দিয়ে বের করে দিয়ে তিন্না অফিসে বেরোল।
~চার~
সন্ধেবেলা তিন্না বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই জয়েন্দ্র হাজির।
“গিয়েছিলেন?” জানতে চাইল তিন্না।
ঘাড় কাত করল জয়েন্দ্র। “পোস্ট অফিসে গিয়ে জানতে চাইলাম থানা কোথায়? জানতাম না। তারপরে গিয়ে ওখানকার অফিসারকে বললাম সব কথা – পুলিশ কিছু করবে না।”
ভুরু কোঁচকাল তিন্না। “করবে না? মানে?”
জয়েন্দ্র বলল, “আমি চিঠিটা দেখালাম। বললাম এক বছরের ওপর হয়ে গেছে, উনি গেছেন, কোনও খোঁজ নেই। অফিসার বললেন, আপনি কী সন্দেহ করছেন? আমি বললাম, কিছু নয়, কিন্তু কেউ চিঠিতে লিখে গেলেন, আগামী দিনে জানাবেন কোথায় গেছেন, বলে কিছু জানালেন না, সেটাই কি সন্দেহজনক নয়? তাতে পুলিশ বললেন, উনি অ্যাডাল্ট। নিজের ইচ্ছেয় গেছেন, চিঠি দিয়ে গেছেন। তারপরে জানালেন কি না–জানালেন, তাতে আপনার কী? আমি বললাম, কিন্তু বাড়িটা ফেলে গেছেন যে? উনি বললেন, আপনাকে তো থাকার অধিকার দিয়ে গেছেন – থাকুন। ফিরে এলে ফেরত দিয়ে দেবেন, না এলে আপনার বাড়ি হয়ে গেল… বলে হা হা করে হাসলেন।”
তিন্নাও হাসল। হা হা করে নয়, নিঃশব্দে। বলল, “তবে তো ভালোই হলো। কিছু ডায়রি–টায়রি হয়েছে?”
মাথা নাড়ল জয়েন্দ্র। “কিছুইতো লিখলেন না। বললেন, যান, বাড়ি যান।”
তিন্না একটু ভাবল তারপরে বলল, “তার মানে আপনি যে অ্যাট অল পুলিশের কাছে গেছিলেন, তার কোনও প্রমাণই নেই। তাই তো?”
জয়েন্দ্র থতমত খেয়ে বলল, “কিন্তু… আমি গিয়েছিলাম। সত্যি…”
তিন্না মাথা নাড়ল। বলল, “আপনি যাননি এ কথা বলছি না। কিন্তু আপনি তো সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। কাল যদি গোলমাল বেরোয়, তাহলে পুলিশকে আপনি বিশ্বাস করাতে পারবেন, যে আপনি গিয়েছিলেন, তখন পুলিশ বলেছে যান, বাড়ি যান?”
ফ্যাকাশে মুখে জয়েন্দ্র তাকিয়ে রইল তিন্নার দিকে। ওর অসহায়, নিরুপায় মুখটা দেখে তিন্নার প্রায় কষ্টই হলো। বলল, “অন্তত যে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর নামটা জেনে এসেছেন তো? মুখে না বললেও বুকে নেমপ্লেট থাকে…”
জয়েন্দ্রর মুখে হাসি ফুটল। বলল, “হ্যাঁ। ছিল। কৌশিক… কৌশিক মুখার্জী।”
“নামটা মনে রাখবেন,” বলে তিন্না চায়ের জল বসাল।
আরও দু–চার দিন কাটল। জয়েন্দ্র আস্তে আস্তে ওর ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে। মাস শেষ হয়ে আসছে, তিন্না বুঝতে পারে না বাড়িভাড়াটা কী করবে – শেষে জয়েন্দ্রকে যে বুদ্ধিটা দিয়েছিল, সেটাই কাজে লাগায় – ব্যাঙ্কে গিয়ে একটা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে ভাড়াটা তাতে জমা করে।
সপ্তাহ দুয়েক পরেই জয়েন্দ্র চা খেতে খেতে তার নতুন আর্জি জানাল। “বাড়ি ভাড়াটা বুঝলেন, আমিই চাই। আপনি আমাকেই বাড়ি ভাড়া দেবেন। আমি আপনাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছি। কুসুম মুখার্জীর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ওনার সঙ্গে আমি বোঝাপড়া করে নেব।”
জয়েন্দ্রর গলায় একটা দৃঢ়তা আর চোখের দৃষ্টিতে একটা কাঠিন্য – দুটোই তিন্নার কাছে নতুন। পরিচিত মিনমিনে জয়েন্দ্র এ নয়। তিন্নার কাছে টাকা ছিল, কিন্তু জয়েন্দ্রর সামনে কখনওই টাকার ব্যাগ খোলেনি। তাই বলল, “কাল সকালেই টাকা তুলে দিয়ে দেব।”
জয়েন্দ্র ঘাড় নাড়াল। বলল, “সকালেই দিতে হবে না। বিকেলে দিলেও হবে।”
বেশ কিছুদিন হলো জয়েন্দ্র বাইরে যায়নি। কথায় কথায় তিন্না জিজ্ঞেস করল, “বাইরের কাজ এখন কম হচ্ছে?”
জয়েন্দ্র কিছু বলল না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কাপের ওপর দিয়ে তাকাল। দৃষ্টিটা তিন্নার ভালো ঠেকল না। কথা বাড়াল না, কিন্তু মনে হলো, আর সময় বাকি নেই বেশিদিন। যা করার এর মধ্যেই করে ফেলতে হবে।
রোজের মতো তিন্না বেরোল। ও জানে ওর বেরোন’র মিনিট পনেরো–কুড়ির মধ্যেই বেরোয় জয়েন্দ্র। গলি ধরে বেরিয়ে চশমার দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে পরের বাস স্টপে বাস ধরে। বাস স্টপের দুটো বাড়ি আগে রাস্তার উলটো দিকের ক্যাফে থেকে বাস স্টপটা দেখা যায়। আগেও তিন্না ওখানে বসে জয়েন্দ্রর চলে যাওয়া দেখেছে। আজ বাস স্টপ অবধি হেঁটে গিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল – ক্যাফের বিশাল কাচের জানলার ঠিক ভেতরের টেবিল, আর তার পরের টেবিলটা অবধি বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। তার পরের টেবিলটাই অন্ধকারে। ওখানে বসলে নিশ্চয়ই বাইরের আলোয় বাস স্টপ দেখা যাবে, কিন্তু বাস স্টপ থেকে তাকালেও কেউ ভেতরে কে আছে দেখতে পাবে না। তার ওপর জয়েন্দ্র আসতে আসতে যদি সামনের টেবিলে কেউ এসে বসে, তাহলে তো আরোই না।
রাস্তা পেরিয়ে ক্যাফেতে ঢুকে তিন্না একটা বড়ো কফির কাপ নিয়ে বসল। জয়েন্দ্র এল সময়মতোই। ও বসার বারো মিনিট পরে। বাস স্টপে দাঁড়াল, নজর ওর রাস্তার দিকেই। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই যে বাসটা এসে দাঁড়াল, সেটা চলে যাবার পরে তিন্না দেখল জয়েন্দ্র নেই বাস স্টপে। চলে গেছে। তা–ও অপেক্ষা করল আরও মিনিট সাত–আট। এর মধ্যে ফোন করে প্রতীপদা কত দূরে জেনেও নিয়েছে। কফির দাম মিটিয়ে তিন্না বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। সাবধানের মার নেই, ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখেও নিয়েছে। জয়েন্দ্রর দেখা নেই।
পার্কের পরের রাস্তাটা পেরোতে গিয়ে আড়চোখে দেখল প্রায় চারটে বাড়ি দূরে প্রতীপদার গাড়িটা। সাদা গাড়ি, কালো কাচ। দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কে আছে। দরজায় এসে চাবি দিয়ে তালা খুলে প্রায় পা টিপেটিপে বাড়িতে ঢুকল তিন্না। কেন এত সাবধানে? নিজেরই তো বাড়ি। জানে, ওপর তলায় কেউ নেই। তবু সাবধানের মার নেই। পেছনের দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে ওপরের বাড়ির দরজায় টোকা দিল। বেশ জোরেই জিজ্ঞেস করল, “জয়েন্দ্রবাবু, আছেন?” জয়েন্দ্র নেই। কেউ সাড়া দিল না। নিচে নেমে এল আবার। খাবার টেবিলের পাশের সাইডবোর্ডের ড্রয়ারে চাবিগুলো রাখা আছে। এগুলো কাল সন্ধেবেলাই নিয়ে এসেছে। গত তিন মাসের মধ্যেই কাজটা করে নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু প্রতীপদার অযথা সাবধানতার জন্য দেরি। আর একটু দেখ… এই পরামর্শ ছাড়া আর কিছুই বলে না লোকটা।
নিজের যতগুলো চাবি ওকে দিয়েছে জয়েন্দ্র, তার মধ্যে গ্যারেজের চাবি নেই। সামনের দিকেরও না, পেছনের দরজারও না। সেটা তিন্না সেদিনই দেখে নিয়েছিল, যেদিন প্রথম জয়েন্দ্র বাইরে গিয়েছিল। গ্যারেজের চাবি, আর জয়েন্দ্রর শোবার ঘরের একটা আলমারির। বাকি আলমারি, দরজা – সবের চাবি রয়েছে জয়েন্দ্রর চাবির গোছায়। অন্যান্য আলমারির ভেতরে যা আছে তা থেকে বোঝাই যায় সেগুলো কোনও বয়স্ক মহিলার এবং সংসারের। কিন্তু জয়েন্দ্রর কোনোও ব্যক্তিগত কিছু তিন্না হাতে পায়নি। তাই সেই তালাগুলোর জন্য স্কেলিটন চাবি জোগাড় করতে হয়েছে প্রতীপদার টালবাহানা ঠেলে। “ধুত্তোর, নিকুচি করেছে তোমার আর কয়েকদিন দেখা…” বলে শেষে কাল জোর করেই অফিস থেকে চাবিগুলো নিয়ে এসেছে তিন্না।
গতকাল সকালেও তিন্না ফিরে এসেছিল জয়েন্দ্র বেরিয়ে যাবার পরে। তখন গ্যারেজের পেছনের দরজার তালায় বিদেশী একটা লুব্রিক্যান্ট দিয়ে রেখেছিল। ডাব্লু–ডি–ফর্টি। তেলের মতো কাজ করে, কিন্তু তেল চুঁইয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। স্প্রে করে দিতে হয়। আজ যাতে সহজে খোলা যায়।
অফিস থেকে আনা চাবিগুলো একটা একটা করে ঢুকিয়ে ঘোরাতে শুরু করল তিন্না। পুরোনো তালা, অনেকদিনই হয়ত খোলা হয়নি। তিন্নার ধারণা এক বছরের কিছু বেশি অবধি তো বটেই। আরও বেশিও হতে পারে। সাবধানে তালায় চাবি ঘোরাতে হয়। চারটে চাবি ট্রাই করে পঞ্চম চাবিতে তালাটা খুলল। তিন্না সাবধানে দরজাটা ঠেলল। কাল রাতে যতটা সম্ভব বন্ধ দরজাতেই কবজাগুলোতে লুব্রিক্যান্ট স্প্রে করেছিল। তাও দরজাদুটো আড়ষ্ট। অল্প ক্যাঁচ শব্দও হল। তিন্না গ্যারেজে ঢুকল।
গ্যারেজ যেমন হওয়া উচিত, তেমনই। গাড়ি, পেছনের দেওয়ালে ঘেঁষে কিছু ইঞ্জিন অয়েলের খালি ডাব্বা, পুরোনো বাতিল টায়ার, দুটো ধুলোমাখা খালি জেরিক্যান, তাকের ওপরে কয়েকটা বাক্স, তাতে গাড়ির জন্য স্প্যানার–ট্যানার কিছু, একটা পালিশের কৌটো, তার ভেতরে পালিশটা শুকিয়ে কাঠ… আর গ্যারেজের পেছনের দেওয়ালে একটা দরজা। বাইরে থেকে হুড়কো আর তালা দেওয়া। তিন্না বুঝল এই দরজা দিয়ে বাড়ির পেছনের দিকের তিনটে ঘরের একটায় ঢোকা যায়। কিসের ঘর এটা? তালা দেওয়া কেন? কাছে গিয়ে হাতের টর্চ জ্বেলে দেখল এ তালাটাও নতুন না। ওর কাছে যা চাবি আছে তা দিয়ে এটা খোলা যাবে? জয়েন্দ্রর দেওয়া চাবির গোছায় সব নতুন চাবি। এবং এ তালায় যে রকম চাবি লাগবে, সেরকম আকৃতিরই কোনও চাবি নেই। সুতরাং তিন্নার নিজের স্কেলিটন চাবির গোছাই সম্বল। তিন্না দুটো চাবি লাগিয়েই বুঝল এ তালাতেও লুব্রিক্যান্ট ছাড়া চাবি ঘুরবেই না। তাই চট করে বাড়িতে ফিরে গিয়ে ডাব্লু–ডি–ফর্টির ক্যানটা নিয়ে ফিরে এল। এখন ভালো করে স্প্রে করে রাখলে আজ দুপুরের মধ্যে যদি কাজ করে, তাহলে দুপুরেই দরজাটা খোলা যাবে। আজকের মধ্যেই সবটা শেষ না করতে পারলে…
স্প্রে করা শেষ করে তিন্নি বেরিয়ে এসে সিঁড়ির ওপর স্প্রে–র ক্যানটা রেখে হাতে তালা–চাবি নিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে টেনেছে, খচ্ করে চাবি ঘুরে সিঁড়ির দিকের বাইরের দরজা খুলে গেল, আর সজোরে ধাক্কা মেরে দরজার পাল্লাটা খুলে ভেতরে ঢুকে এল জয়েন্দ্র। এতো জোরে ধাক্কা মেরেছে যে দরজাটা ঘ্যাঁস্ করে মেঝেতে আটকায়ওনি, বরং ছিটকে খুলে সিঁড়ির দেওয়ালে লেগে অর্ধেক ফিরে গেছে।
~পাঁচ~
তিন্নার হাতে তালা চাবি। পায়ের কাছে ডাব্লু–ডি–ফর্টির ক্যান। তিন্নার বাড়ির খোলা দরজার ওপারে জয়েন্দ্র। কিন্তু তিন্নাকে যেতে হবে চার পা, জয়েন্দ্রকে দু পা। তিন্নাকে এই চার পা যেতে দুটো ধাপ সিঁড়ি উঠতেও হবে।
সেই দু পা–ও এগিয়ে এল জয়েন্দ্র। এবার ও তিন্নার বাড়ির পেছনের দরজার সামনে।
“কী করছেন?”
জয়েন্দ্র গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাও শ্লেষ বোঝা যায়।
“হাতে কী?”
তিন্নার বাঁ হাতে তালা চাবি। বাঁ পায়ের কাছে স্প্রে ক্যান। ও তালাচাবি ডান হাতে নিয়ে ক্যানটা তুলে নিতে নিচু হল।
“অ্যাই!” জয়েন্দ্রর গলায় ধমকের সুর। এই জয়েন্দ্রও তিন্নার অপরিচিত। “খবরদার!” জয়েন্দ্রর ডান হাত প্যান্টের পকেটে গেল। পকেট থেকে বেরোল একটা ছুরি। ক্লাস্প নাইফ। জয়েন্দ্র ছুরি চালাতে জানে? ডান হাতে ছুরি ধরে জয়েন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে ভাঁজ করা ফলাটা খুলল। রামপুরী চাকু। ধাপে ধাপে খুলল ফলা। কট্–কট্–কট্–কট্ শব্দ করে। তিন্না একটু নিশ্চিন্ত হলো। জয়েন্দ্র ছুরিটা না তাকিয়ে খোলেনি। ফলাটা দেখে ধরে টেনেছে। ছুরি চালানোয় ও পারদর্শী নয়।
“কী ওটা? ওটারই গন্ধ পেয়েছিলাম কাল সন্ধেয়? কী করছেন ওটা নিয়ে?”
তিন্না ভেবেছিল সারা দিনে লুব্রিক্যান্টের গন্ধ মিলিয়ে যাবে। তবে সিঁড়ির নিচের জায়গাটা বদ্ধ। তার মানে সবটা মেলায়নি কাল সন্ধেয় জয়েন্দ্র ফেরা অবধি।
জয়েন্দ্র এগিয়ে এল আরও। তিন্নার চেয়ে ও প্রায় দু ফুট ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা ওর অ্যাডভান্টেজ। তবু…
“দেখি ওটা কী?”
জয়েন্দ্রর বাড়ানো বাঁ হাত তিন্নার ডান হাতের দিকে এগোল। ক্যানটা চাইছে। তিন্না জানে কী করতে হবে। বাঁ হাতের তালাচাবিটা বাড়িয়ে দিয়ে শেষ মুহূর্তে ফেলে দিয়ে স্প্রে–টা জয়েন্দ্রর চোখে করলেই… বাঁ হাতটা সবে বাড়াতে শুরু করেছে এমন সময় আর একটা ঘটনা ঘটল।
জয়েন্দ্র সিঁড়ির বাইরের দরজা বন্ধ করেনি। সেই খোলা দরজায় একটা মূর্তি এসে দাঁড়াল। হাতে পিস্তল। “হাত তোলো। কেউ নড়বে না। পুলিশ…” প্রতীপদা।
চমকে পেছন ফিরেছে জয়েন্দ্র, এই সুযোগে তিন্না একসঙ্গে দু হাত থেকে তালা, চাবি, স্প্রে সব ফেলে দিয়ে দু–হাতে সিঁড়ির রেলিঙের শেষটায় ভর দিয়ে সারা শরীরটা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে সপাটে লাথি মারল প্রথমে বাঁ পা দিয়ে জয়েন্দ্রর ডান কনুইয়ে, আর তার এক লহমা পরেই ডান পা দিয়ে জয়েন্দ্রর বাঁ চোয়ালে। প্রথম লাথিতে হাত থেকে ছুরিটা ছিটকে গিয়ে পড়ল সিঁড়ির মাঝামাঝি আর দ্বিতীয় লাথিতে জয়েন্দ্রর মাথাটা ঝটকা খেয়ে গিয়ে লাগল সিঁড়ির রেলিঙের লোহার গ্রিলে। জয়েন্দ্রর শরীরটা পাক খেয়ে গোল হয়ে গিয়ে পড়ল বাইরের দরজায় দাঁড়ান প্রতীপদার পায়ের কাছে। প্রতীপদা পিস্তলটা ওপর দিকে তুলে নিয়েছিল, এখন পকেটে রেখে উবু হয়ে বসে জয়েন্দ্রর নাকের কাছে দু–আঙুল রেখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “মরেনি। কপাল ভালো তোর… এই, কে আছো, একে তুলে দিদির বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাও…”
দুজন উর্দিপরা পুলিশ ঢুকে এল পেছনের খোলা দরজা দিয়ে। ধরাধরি করে জয়েন্দ্রকে নিয়ে তিন্নার খাবার ঘরের মাটিতে শোয়ানো হলো। জ্ঞান ফেরার আগেই হাতকড়া পরানো হয়ে গেছে। মাথায় বরফ দেওয়া হয়েছে। তবু গ্রিলে ঠোকা খাওয়ার জন্য আলুটা ভালো রকমই বেড়ে উঠেছে। জ্ঞান ফেরার পরে একবার বলতে চেয়েছিল, “আমি… আমি কিছু করিনি।” কিন্তু প্রতীপদার আঙুল নেড়ে, “আপাতত মহিলা পুলিশ অফিসারকে আক্রমণ করেছিলেন, সেটুকুই যথেষ্ট,” শুনে জয়েন্দ্রর সমস্ত জারিজুরি খতম। মাটি থেকে টেনে তুলে চেয়ারে বসানো হয়েছিল। প্রতীপদা জানতে চেয়েছিল, “ফিরে এলেন কেন? রোজের মতো তো চলে গিয়েছিলেন।”
মাথা নেড়েছিল জয়েন্দ্র। “যাইনি। সকালে উনি যখন চান করছিলেন তখন আমি বেরিয়েছিলাম সিগারেট কিনতে।”
“চান করছিলেন, জানলেন কী করে?” চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল প্রতীপদা।
“বেরোচ্ছি যখন, তখন… মানে আমার বাইরে যাবার রাস্তাটা তো ওনার বাথরুমের পাশ দিয়েই…”
“বেশ। তারপর?”
“আমি রাস্তার মোড়ে সিগারেটের দোকানেই আড্ডা দিচ্ছিলাম, দেখি উনি… ম্যাডাম… বেরিয়ে বাস স্টপে গেলেন, কিন্তু বাসে না উঠে কিছুক্ষণ উলটো দিকের ক্যাফেটা দেখে তারপরে ক্যাফেতে ঢুকে গেলেন। আমার খুব আশ্চর্য লাগল। তাই আমিও যেমন যাই তেমনই বেরিয়ে এলাম, কিন্তু বাসে না চড়ে বাস স্টপের পাশের শো–রুমে ঢুকে অপেক্ষা করলাম। দেখি ম্যাডাম বেরিয়ে আবার ফিরে গেলেন বাড়ির দিকে। আমিও ফিরে এলাম…”
প্রতীপদা বলল, “কিন্তু বাড়িতে ঢুকলেন না। পার্কে বসে রইলেন, কেন?”
“আসলে ম্যাডাম কী করছেন বুঝতে পারছিলাম না। তাই… পরে মনে হল…”
“কী মনে হলো?”
“না, মানে ম্যাডামের ভাবভঙ্গী আমার ভালো লাগছিল না। আমার সঙ্গে কেমন একটা যেন… তাই…”
“তাই ফিরে গিয়ে ঢুকলেন। ছুরি নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন কেন?”
“না না!” প্রায় আর্তনাদ করে উঠল জয়েন্দ্র। “আক্রমণ না। আমি ছুরি টুরি… ভয় দেখাচ্ছিলাম।”
প্রতীপদার গলায় ইস্পাত। “কেন? কী করেছিলেন ম্যাডাম, যে আপনি ছুরি নিয়ে ভয় দেখাচ্ছিলেন?”
জয়েন্দ্রর মুখে উত্তর নেই।
প্রতীপদা অন্য দিক দিয়ে শুরু করলেন। “কী আছে, গ্যারেজের পেছনের ওই ঘরে?”
“ইয়ে, কয়লা।”
আশ্চর্য হয়ে প্রতীপদা বলল, “কয়লা? কয়লা? মানে?”
জয়েন্দ্র বলল, “আগে তো বাড়িতে কয়লা দিয়ে রান্না হত, আর তখন থেকেই কয়লা রাখা হত ওই ঘরে। পরে যখন গ্যাস–ট্যাস হল, তখন থেকে আর ও ঘর ব্যবহার হয়নি।”
অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে প্রতীপদা বলল, “সেই কত বছর আগের কয়লা এখনও পড়ে আছে?”
ঘাড় নাড়ল জয়েন্দ্র। হ্যাঁ।
উঠে দাঁড়াল প্রতীপদা। বলল, “চলুন তো, দেখি…”
দুজন উর্দিপরা পুলিশ এসে দাঁড়াল জয়েন্দ্রর পেছনে। জয়েন্দ্র প্রায় উদভ্রান্তের মতো চারিদিকে দেখে বলল, “না না…”
প্রতীপদা ঝুঁকে পড়ল। “কেন? ওখানে কয়লা নেই?”
“আছে… আছে…”
প্রতীপদার নাক এখন প্রায় জয়েন্দ্রর নাক ছুঁয়েছে। “আর কিছু আছে?” উত্তর নেই। “কী আছে?”
জয়েন্দ্রর মাথা ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। মাটির দিকে চেয়ে, প্রায় শোনা যায় না, এমন ভাবে বলল, “কুসুম মাসিমা।”
~ছয়~
সন্ধের অন্ধকার নামার পরে তিন্না যখন প্রতীপদার গাড়িতে বাড়ি ফিরল, তখনও সামনেটা নানা টিভি চ্যানেলের ও–বি ভ্যানে ছয়লাপ। বিরাট বিরাট আলোয় সামনেটা আলোকিত। রাজ্যের ক্যামেরাম্যান তাদের চ্যানেলের জার্নালিস্টদের ইন্টারভিউ নিতে ব্যস্ত। সরু গলিতে বেশি ভ্যান ঢুকতে পারেনি, তাই অনেকেই হাতে ধরা ক্যামেরা নিয়েও একই কাজ করে চলেছে।
মুদির দোকানের সামনে রাস্তার পাশে একটা খালি জায়গা দেখে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে প্রতীপদা বলল, “তুই আজ ঢুকতে পারবি না। তার চেয়ে আমার বাড়ি চলে চ’।”
তিন্না সারা দিনের পরা শার্ট প্যান্টের দিকে চেয়ে বলল, “সবই তো ভেতরে…”
ইঙ্গিতটা বুঝে প্রতীপদা বলল, “বৌদির একটা নাইটি পরে নিবি। কাল সকালে এখান থেকে সব হটিয়ে দেব। তখন আসিস।”
প্রায় সায় দিতে যাচ্ছিল তিন্না। হঠাৎ চোখ পড়ল মুদির দোকানের দিকে। পরিচিত দুটো চোখ একদৃষ্টে দেখছে ওদের। বলল, “প্রতীপদা, একজনকে একটু এক্সপ্ল্যানেশন দিতে হবে। একমিনিট।”
জানলার কাচটা নামিয়ে হাত নেড়ে ডাকল। মহিলা রাস্তা পেরিয়ে হেঁটে এলেন। মুখের হাসিটা অস্পষ্ট। তিন্নার পাশে প্রতীপদা এখন ইউনিফর্মে – তাই আরও অস্বস্তিতে।
তিন্না বলল, “আপনার বাড়ি তো ওই পেছনের রাস্তায় বলেছিলেন?”
মহিলা হাত তুলতে যাচ্ছিলেন, না তুলেই থুতনি দিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন, “হ্যাঁ, ওইখানে…”
“ওখানে গাড়ি দাঁড় করানো যাবে?”
যাবে শুনে তিন্না পেছনের দরজা খুলে বলল, “উঠুন। পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি সাব–ইনস্পেকটর প্রতীপরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমার বস্। আপনার নামটা আমি সেদিন জিজ্ঞেস করিনি…”
“নমস্কার। আমার নাম সৈরিন্ধ্রী দাস। আপনি এই ডানদিকের রাস্তাটা নিয়ে নিন। এখান থেকে ঘুরে পেছন দিয়ে এই টিভির ভীড় এড়িয়ে যাওয়া যাবে।”
প্রতীপদা গাড়ি চালিয়ে দিল। সৈরিন্ধ্রী বললেন, “আপনিও পুলিশ?”
তিন্না হাসল। বলল, “হ্যাঁ।”
“আপনারা জানতেন কী হয়েছে?”
তিন্না মাথা নাড়ল। “না। জানতাম না। কোনও কমপ্লেন হয়নি। তবে আমার নিজের একটা ইন্টারেস্ট ছিল। আপনি তো কুসুম মুখার্জীকে অনেকদিন চিনতেন?”
এবারে সৈরিন্ধ্রী মাথা নাড়লেন। “না, গো। আমি তো বিয়ে হয়ে এসেছি সাত বছর পেরিয়ে আট বছর হচ্ছে। তবে আমার শাশুড়ি চিনতেন। সে কথা কুসুমদি–ই বলেছেন আমাকে – আমি তো শাশুড়িকে দেখিনি। উনি আমার বিয়েরও ছ–সাত বছর আগে চলে গেছেন।”
তিন্না বলল, “তাহলে আপনি হয়ত জানেন না যে কুসুম মুখার্জী নিঃসন্তান ছিলেন না। ওঁর এক মেয়ে ছিল… আছে। প্রায় পঁচিশ বছর আগে, মেয়ের যখন বয়স বছর পনেরো–ষোলো, ও বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ও প্রেম করছে জানতে পেরে ওর বাবা, মানে কুসুম মুখার্জীর স্বামী সুনির্মল মুখার্জী বিয়ের ব্যবস্থা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে পালানোর পরে সুনির্মল মুখার্জী মেয়েকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন, এবং তারপরে আমৃত্যু ওঁর কোনও খোঁজ নেননি।”
সৈরিন্ধ্রীর বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল। সৈরিন্ধ্রী গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, “বাপরে! কী অদ্ভুত কথা! আমি তো এসব জানতামই না। নিজের মেয়েকে এমন ভাবে কেউ ভুলে যেতে পারে? উনি তো এই সেদিনও বেঁচে ছিলেন। প্রায় সাতাশি বছর বয়সে মারা গেলেন…”
সৈরিন্ধ্রীর বসার ঘরে বসে বাকি কথা হলো। তিন্না বলল, “মুখার্জীরা যদিও মেয়ের কোনও খোঁজ নেননি, সুচিত্রা – মানে মেয়ে – কিন্তু ওদের খোঁজ নিত। ও থাকে অ্যামেরিকায় না ক্যানাডায়। ওর বর প্রথমে মিডিল ইস্টে, পরে ইউ–এস–এ চলে যায়। এখন অবশ্য ওর বর একটা কঠিন নার্ভের রোগে শয্যাশায়ী প্রায় বছর চারেক, সারাক্ষণ দেখাশোনা লাগে, তাই ও হাজবেন্ডকে ছেড়ে নড়তে পারে না – তার ওপর আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। সুচিত্রার এক ছোটোবেলার বন্ধু ছিল এপাড়ায়। তনিমা। তনিমারা অবশ্য অনেক দিন পাড়া ছেড়ে চলে গেছে বাড়ি বিক্রি করে, কিন্তু সুচিত্রার সঙ্গে আবার ফেসবুকে যোগাযোগ হয়েছিল। তনিমা এখন বম্বেতে থাকে। সুচিত্রার সঙ্গে তনিমার যোগাযোগ হয়েছে না জানিয়েই তনিমা মাঝে মাঝে ফোন করে খবরটবর নিয়ে সুচিত্রাকে দিত। কিন্তু গত প্রায় দেড় বছর তনিমা আর কুসুম মাসিকে ফোনে পায় না। যখনই ফোন করে, তখনই ফোন বন্ধ। তখন তনিমাদি আমাকে খবর দেয়।”
সৈরিন্ধ্রী ভুরু কোঁচকালেন। “তনিমাদি? উনি আপনার…?”
“মামাতো দিদি। একে তনিমাদিরা থাকে বম্বেতে, তার ওপর অনেক সাংসারিক অসুবিধে। তাই আমাকে বলে খোঁজ করতে। আমি পুলিশে চাকরি করি বলে। আমার পোস্টিং এখানে নয়, সি–আই–ডিতে। তাই লোকাল থানাকে খোঁজ নিতে বলি। একটা কমপ্লেন না থাকলে পুলিশের পক্ষে পট করে এসে খোঁজখবর নেওয়া সহজ নয়, কিন্তু লোকাল থানা আমাকে জানায় যে ও বাড়িতে কেবল একজন পুরুষই থাকে, কোনও মহিলা নেই। এবং রিসেন্টলি কোনও মহিলার মৃত্যুও হয়েছে বলেও জানা নেই। পাড়ার অবস্থা তো জানেনই। কেউ কারওর খবর রাখে না, কিন্তু কেউ মারা গেলে নিশ্চয়ই জানা যেত। তার ওপর জানা গেল নিচের তলায় ভাড়াটে ছিল একটা গোটা পরিবার। সবে বাড়ি ছেড়ে গেছে, নিচের তলায় এখন কেউ নেই। তখনই প্রতীপদা আর আমি ঠিক করি আমি এখানে ভাড়া আসব। আপনারা জানেন না, সারাক্ষণ লোকাল থানার দুজন লোক এখানে আমার পাহারায় থাকত… ওই মন্দিরে।”
সৈরিন্ধ্রী বললেন, “কিন্তু আমি যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন তো আপনি বললেন, আপনি কুসুমদির কথা জানেনই না।”
তিন্না বলল, “সে তো বাধ্য হয়ে। কোথা থেকে খবর কোথায় যায়, কেউ জানে না। আমি কেন এখানে এসেছি, তা যদি একবার জানাজানি হয়ে যেত তাহলে সমস্যা হতে পারত। যাই হোক, দুটো মিথ্যে বের করতে আমার তিন মাস লাগল। আপনার সঙ্গে দেখা হবার পরে আমি কুসুম মাসির কথা জানতে চাইলাম। তখন মিথ্যে বলল। প্রথমে বলল, কুসুম মাসি ওনার মাসতুতো বোনের সঙ্গে চলে গেছেন। চিঠিও দেখাল। আমি জানতে চাইলাম, তনিমাদি সুচিত্রাকে জিজ্ঞেস করে জানাল কুসুম মাসির কোনও মাসতুতো বোন ছিল না। অথচ জয়েন্দ্র আমাকে যে চিঠি দেখিয়েছে, সেটা নাকি কুসুম মাসির লেখা। অর্থাৎ, ওটা সত্যি না। দ্বিতীয় মিথ্যে বলল, যে ও নাকি পুলিশের কাছে গিয়েছিল, পুলিশ ওকে বলেছে বাড়ির মালিক যদি চিঠিতে লিখে গিয়ে থাকে, তাহলে ও থাকুক, পুলিশের ইন্টারেস্ট নেই। আমি জানতে চাইলাম, কোন অফিসার বলেছে? পট করে বানিয়ে মিথ্যে নাম বলল, কৌশিক মুখার্জী। ও নামে এই থানায় কেউ নেই আমি জানি। বানাতে গিয়ে কুসুম মুখার্জীর নামের কাছাকাছি নামই বানিয়ে ফেলেছে।”
সৈরিন্ধ্রী কিন্তু কিন্তু করে জানতে চাইলেন, “ও কুসুমদিকে মেরে ফেলেছিল? কী ভাবে?”
এবার প্রতীপদা মুখ খুলল। বলল, “এখনও আমরা অতটা জানি না। এক বছরেরও বেশি পুরোনো মৃতদেহ পোস্ট মর্টেম করেও কিছু তেমন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ওই কয়লার ঘরে নিয়ে গিয়ে কয়লা চাপা দিয়ে রেখে দিয়েছিল। একে ঘরে কোনও জানলা নেই, তায় দরজাটা একেবারে চাপা, তার ওপর গ্যারেজের ভেতরে, এবং কত মণ কয়লার নিচে চাপা ছিলেন কে জানে, তাই গন্ধও বেরোয়নি। জয়েন্দ্র এখন বলার চেষ্টা করছে যে উনি স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন। আমাদের সন্দেহ আছে। বছর দুয়েক আগে ওর চাকরি যায় কারণ ফার্নিচার কম্পানিটাই উঠে যায়। পরে নতুন চাকরি পায় একটা – সেলস–এরই, কিন্তু মধ্যে প্রায় আট মাস কোনও চাকরিই ছিল না। ওর ব্যাঙ্ক–এর বই থেকে দেখা গেছে ওই সময় ওর সেভিংস প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল। নিশ্চয়ই বাড়িভাড়াও দিতে পারছিল না, আর তখনই মাথায় বদবুদ্ধি আসে। বৃদ্ধা বাড়িউলিকে মেরে তার বাড়ির মালিক সেজে বসলে আর ভাড়াও দিতে হবে না, বরং নিজেই ভাড়া দিয়ে রোজগারও করতে পারবে। এসব পরে আরও জানা যাবে…”
সৈরিন্ধ্রীকে নমস্কার করে দুজনে বেরোল। দরজার বাইরে এসে সৈরিন্ধ্রী জানতে চাইলেন, “কিন্তু কুসুমদি যদি স্বাভাবিক কারণেই মারা গিয়ে থাকবেন, তাহলে মৃতদেহ লুকিয়ে রাখতে হলো কেন?”
তিন্না বলল, “ও বলছে, ওর ভয় হয়েছিল ওকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে, দূর সম্পর্কের আত্মীয় কেউ নিশ্চয়ই খবর পেয়ে আসবে, তখন ওর কী হবে… আমরা তা মনে করছি না। আমাদের সন্দেহ ওকে কুসুম মুখার্জী বলেছিলেন বাড়ি ছেড়ে দিতে। তখনই ও বাকি সব কিছু প্ল্যান করে।”
দুজনে গিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি চালু করে মেন রাস্তায় পৌঁছে প্রতীপদা বলল, “তোর প্রোমোশনটা এবারে বাঁধা। বুঝলি?”
– কলকাতা, ১১ই মার্চ, ২০২০