ক্যান্সার যেদিন ধরা পড়ল, ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন ‘বাড়িতে কে কে আছেন?’ শোনার পর বললেন, ‘ছেলে কত বড়?’ আমি বললাম, ‘সতেরো-য় পড়বে কয়েকদিনের মধ্যে’…
‘হুমম, তাহলে তো ছোটই..!’
আমি ভাবলাম সতেরো ছোট? সতেরোয় তো আমরা প্রেম করেছি, একা স্কুলে গেছি, পাড়ার মাংসের দোকানে লাইন দিয়ে মাংস কিনেছি…! তাহলে কি বেশিদিন আর বাঁচবো না? একমাত্র মাতৃহারা হওয়ার পক্ষে সতেরোটা কম…বেশ কম…
গতকাল প্রায় বছর পনেরো পর মুখোমুখি বসলাম আমি আর আমার দাদা| গতকাল আমার বাড়ি থাকারই কথা ছিল না| কিন্তু আশ্চর্যভাবে সেই প্রোগ্রামটা ক্যান্সেল হয়ে গেল| আমি রয়ে গেলাম| প্রায় বছর পনেরো পর আমার দাদা এলো! আমার শৈশব-কৈশোরের একমাত্র সঙ্গী, আমার সুহৃদ, আমার উপুড়-কথার আধার| বাবা-মা কাজে বেরিয়ে যেতেন| সে সময় আমার মনের সব আনন্দ, সবটুকু ব্যথা, সবগুলো প্রেমে পড়া কাকে বলব দাদাকে ছাড়া?
তারপর হঠাৎই সব মিলিয়ে গেল| আচম্বিতে| কোন কারণ ছাড়াই| তখন রাত্রিগুলো রইল আমার সঙ্গী হয়ে| কেঁদেছি অনেক| এখন ভাবি ক্যান্সারের খবরে তো অত কাঁদিনি! তাহলে কি ম’রে যেতে ভয় হয় শুধু অনেকগুলো মানুষের গায়ে-গায়ে জড়িয়ে থাকতে পারবো না আর, সেই ভাবনায়?
আমি বললাম, গতকাল, আমার বৌদিকে, ‘আমি আটকে গেছি আমার অশীতিপর বাবা-মা আর শাশুড়িমায়ের জন্য| সত্যি বলতে কি দেবু আর ঋজুর জন্য আমি ভাবি না|’ মাথা নেড়ে সজোরে আপত্তি জানালো সুতপা, মানে আমার বৌদি, ‘না বুচান, ওরা হয়তো মুখে বলেনা, কিন্তু ওরাও তোমার সঙ্গে ইমোশনালি য়্যাটাচড|’
ঋজুর এই আঠেরোয় ও আর আমার ওপর অন্য কোনভাবেই নির্ভর করেনা, ঐ ইমোশন ছাড়া| কিন্তু প্রশ্ন হ’লো এই ইমোশনটা কী বস্তু? ওটা কি জ্যান্ত? ওর কি ক্ষয় আছে? ওকে কি যত্নআত্তি করতে হয়? নাহলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়? অতি আদরে সে কি মাথায় চ’ড়ে বসে? আর যদি পাত্তা না দেন বিশেষ, মুক্তি দেন, তাহলে আপনার নাগাল পায়না সেভাবে, আর তাই ঘুরঘুর করে আশেপাশে, কিন্তু আপনার ওপর জাঁকিয়ে বসতে পারে না…!?
২০০৭ সাল থেকে আমি প্রতিনিয়ত এই অভ্যাস করে গেছি| ইমোশন ঝেড়ে ফেলার অভ্যাস| ছোটবেলায় বড়মামাকে দেখতাম চুল আঁচড়াবার পর জামার ওপর থেকে চুল থেকে পড়া ময়লা (যা শুধু বড়মামাই দেখতে পেতেন) টোকা মেরে ফেলে দিচ্ছেন| কী নিপুণতায়, অনায়াসে, অবলীলায়….! ঐ ভঙ্গিটি আমার এতটাই প্রিয় ছিল, যে, মামাবাড়িতে থাকলে, বড়মামা অফিসে বেরোনোর আগে জামাপ্যান্ট পরে আয়নার কাছে গেলেই দৌড়ে পাশের খাটে বসতাম আমি| অপলকে দেখতাম কত যত্নে টোকা মারছেন তিনি| কোন ঔদ্ধত্য নেই, রয়ে-সয়ে, বুঝে-সুঝে, দেখে-শুনে টোকা| অথচ কী অসম্ভব নিরাসক্তি… প্রবল ডিটাচমেন্ট…! ঠিক ওভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি অগুন্তি ছড়িয়ে থাকা আবেগে টোকা দিতে শিখে গেছি| যখনই দেখেছি কোন প্রেম, কোন স্নেহ সজোরে চেপে ধরছে আমায়, আমি টোকা মেরেছি| ২০০৭ থেকে এই নাগাড়ে অভ্যাস আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে| ক্যান্সারের খবরে তাই অদ্ভুতভাবে ঋজু বা দেবুর কী হবে ভাবিনি, ভেবেছি কত কাজ এখনও বাকি, করা গেল না তো…..
কামনা করি শুধু সবাই ভালো থাক| প্রচুর মানুষের মধ্যে থাক| কিন্তু একা থাক| অনেকের মধ্যে থেকে এই অপূর্ব একা থাকার অভ্যাস করা খুব দরকার| কেঁদে কেঁদে অনর্থক রাত্রিযাপনের বিলাসিতা করার সময় কোথায় আমাদের? জীবন যে বড্ড ছোট! কোন কারণ ছাড়া আমার দাদা বহু বছর ধরে বোনের সঙ্গে একফালি সম্পর্ক-ও না রেখে আমায় এই বড়টুকু ক’রে দিয়েছে| না হ’লে গতকাল কি আমি অনায়াসে দু’ঘন্টা ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম? জ্বালা করতো না চোখ?