২৪ ঘন্টা। পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে ঘুরতে এই কয়েক ঘন্টাই সময় নেয়। যদিও আজকাল ইঁদুর দৌড়ের চক্করে পৌনে আটশ’ কোটি-র বেশীরভাগ-ই মনে করে – যদি পৃথিবী একটু গোরুর গাড়ির মত থেমে থেমে, ধীর লয়ে চক্কর দিত, আর দিনগুলো আটচল্লিশ ঘন্টা না হোক, অন্ততঃ ছত্রিশ ঘন্টা হত- তাহলে কি ভালোই না হতো !
বড় বড় কোম্পানীর গোরু তাড়ানো রাখালরা এটা আরো অনেক অনেক বেশী করে মনে করে। কারণ তাহলেই আরো অর্ডার, আরো রেভিনিউ, আরো ব্যবসা। রাখাল-দের, থুড়ি, বড় কর্তাদের আরো আরো প্রমোশন আর ইনক্রিমেন্ট!
কিন্তু চাইলে কি হবে- সকল ঈশ্বর, আল্লাহ ও গড-এর কাছে শত মাথা ঠুকেও পৃথিবীর গতি একটুও কমে না। সুতরাং, কাজের সময় বাড়াও।
খাওয়া, স্নান, শৌচকার্য বাদ। ঘুমোনো তো ভয়ানক পাপ কাজ! সপ্তায় ২৪×৭ = ১৬৮ ঘন্টা না হোক অন্ততঃ ৯০ ঘন্টা। নিতান্ত সম্ভব না হলে ৭০ ঘন্টা কাজ করা হোক- গোরুদের কাছে রাখালদের এই হল আব্দার বা নির্দেশ! তাহলেই আরো বেশী দুধ, আরো বেশী ফসল, আরো বেশী উৎপাদন।
কিন্তু গুগল বাবাজীর স্মরণাপন্ন হয়ে দেখা গেল উল্টোপুরাণ। পৃথিবীতে উৎপাদনশীলতার বিচারে একনম্বরে আছে আয়ারল্যান্ড (হ্যাঁ, চোখ কচলে দেখলাম আয়ারল্যান্ড-ই)। আর তারা কাজ করে সপ্তাহে সাড়ে তেত্রিশ ঘন্টা (নাঃ, ভুল লিখি নি- ২০২৩ এর হিসেব)! দু-নম্বরে লুক্সেমবার্গ- ছোট্ট দেশ। ছেড়ে দেওয়া যাক। তিন নম্বরে ডেনমার্ক। চার নম্বরে বেলজিয়াম (কাজ করে সপ্তায় ২৯.৮ ঘন্টা)। পাঁচ নম্বরে নরওয়ে। সেখানকার লোকেরা সপ্তাহে মাত্র ২৭.৩ ঘন্টা কাজ করে। আর সপ্তাহের বাকি সময় তারা বোধহয় বাড়িতে বসে বৌ-দের দিকে- থুড়ি, গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড-দের দিকে তাকিয়ে থাকে।
(অবশ্য মহিলারা নিশ্চয়-ই বাড়িতে তাদের বর-দের দিকে তাকিয়ে থাকেন না! তাঁদের অন্য অনেক কাজ থাকে।)
আর সকল দেশের সেরা ভারতবর্ষ, সপ্তাহে ৪২ থেকে ৪৮ ঘন্টা কাজ করে উৎপাদনশীলতার (সন্তান উৎপাদন নয়, শিল্পোৎপাদন) নিরিখে বিশ্বে ১৩৩ নম্বরে!
সংখ্যাতত্ত্ব অনেক হল। এবার একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। তবে আমার যা পেশা- তাতে আমরা জনসমক্ষে কি বলে, ভগবান না কি যেন, আর জনান্তিকে ‘পিশাচ’। তাই আমাদের বেশীরভাগ-ই পিশাচ জীবনের প্রথম দিকে অনেক সময়ই টানা ৩৬ ঘন্টা বা কখনো ৪৮ ঘন্টা কাজ করি। তাই ডাক্তারি পেশার কাজের সময় যাকে বলে ‘বেঞ্চমার্ক’ বা উদাহরণ যোগ্য- তা নয়।
তবুও আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের একটা ঘটনা বলি। সারাদিন আরজিকরের আউটডোরে রোগী দেখে, বিকেল পাঁচটায় ক্যান্টিনে গপাগপ্ লাঞ্চ গলাধঃকরণ করে- সন্ধ্যে সাতটা থেকে পরদিন ভোর পাঁচটা পর্যন্ত এমার্জেন্সী অপারেশন করে- ভোর ভোর পিজিটির ঘরে গিয়ে স্নান করে- সকাল ন’টা থেকে ওয়ার্ড রাউন্ড দিতে দিতে দুপুর বারোটার সময় মনে পড়ে যে, সেদিন শিশুপুত্রের ভ্যাকসিন ডেট। নিজের শিশুপুত্রকে ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে যেতে হবে, এই অনুরোধ করায় প্রফেসর সেনরায় (অধুনা প্রয়াত) দয়াপরবশ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটি মঞ্জুর করেন।
দিল্লী এইমসে কাজ শিখতে গিয়ে দেখি, অভুক্ত অবস্থায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে করতে পনেরজন রেসিডেন্ট (জুনিয়র ডাক্তার)-এর মধ্যে দুজনের বুকে বাসা বেঁধেছে কালান্তক যক্ষ্মারোগ (টিবি)। প্রতিবছর-ই নাকি এক-দু জন জুনিয়র ডাক্তারের এরকম হয়ে থাকে!
তার অনেক বছর পরে কাজ শিখতে গেছি ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি, হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দেশ, অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দেশ, দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো দেশ- জার্মানীতে।
হাসপাতালে প্রথম দিন আমায় বলে দেওয়া হল- সকাল সাতটায় সেমিনার রুমে চলে আসতে। প্রথমে সেমিনার, তারপর অপারেশন। জানুয়ারী মাস। তাপমাত্রা শূন্যের চার ডিগ্রী নীচে।
আবহাওয়া বাদ সাধলেও জার্মানরা যেন ‘ফাঁকিবাজ ভারতীয়’ বলে আঙুল তুলতে না পারে! তাই রাস্তায় গোড়ালি ডোবা বরফ ঠেলে হাসপাতালে ঢুকে সেমিনার রুমে পৌঁছলাম তখন সকাল ছ’টা সাতান্ন। সূর্যোদয় দূরে থাক, রাস্তায় তখনো আলো জ্বলছে। আই কার্ড বুলিয়ে অটোমেটিক দরজা খুলে দেখি প্রায় সকলেই পৌঁছে গেছে।
হুঁ হুঁ বাবা। এ হল ‘জার্মান ষ্ট্যান্ডার্ড টাইম’। ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রেচেবল টাইম’ নয়! ঠিক সকাল সাতটায় শুরু হল দিনের কাজ।
সেখানে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে কম্পিউটারের স্ক্রীনে রোজকার রুটিন দেখা যেত। তবে জার্মান ভাষায়। একদিন আমি আর গুজরাটের ডাক্তার কুশল আমাদের স্বল্প শেখা জার্মান জ্ঞান ফলিয়ে, পরের দিনগুলোতে কি সার্জারি হবে সেটা দেখার চেষ্টা করছি।
ওই হাসপাতালে তুর্কিয়ে অভিবাসী একজন অর্থোপেডিক্সের ডাক্তার আমাদের বলল, ‘তোমরা তো জার্মান জানো না, তাহলে কম্পিউটার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছ কেন? সব তো গোলমাল করে দেবে তোমরা।’
কিছু বললাম না। কথায় বলে না, ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।’
কঞ্চি চলে গেল।
পাশে দাঁড়ানো একজন জার্মান অ্যানাস্থেটিস্ট বলল, ‘ডু ইউ নো টি জি আই এফ?’
আমরা অবাক হয়ে বললাম, ‘টি জি আই এফ? সেটা কি?’
নব্বই-এর দশকে ওরিয়েন্ট কোম্পানীর ফ্যানের একটা বিজ্ঞাপনে অভিনেতা অর্জুন চক্রবর্তী যেরকম মুখ করে বলতেন, ‘আরে, ইয়ে পি এস পি ও নেহি জানতে!!’
অনেকটা সেইরকম ঢঙে অ্যানাস্থেটিস্ট ভদ্রলোক বললেন, ‘টি জি আই এফ জানো না?
‘নো’
’টি জি আই এফ মানে- থ্যাঙ্ক গড ইটস্ ফ্রাইডে। আজ শুক্রবার, দুটোর পরে কাজ শেষ। শনি-রবি ছুটি। কোনো কাজ নেই। ঘরে যাও, রিল্যাক্স কর। আবার পরের সপ্তায় কাজ।’
আমি আমার স্বল্প শেখা জার্মান ফলিয়ে বললাম, ‘জিয়া গুট (Sehr gut- খুব ভালো)’
সেই বিরাট চেহারার অ্যানাস্থেটিস্ট বললেন, ‘ভির জেহন আম মনটাগ (Wir Sehen Am Montag- সোমবার দেখা হবে)।’
প্রত্যুত্তরে বললাম, ‘ডাঙ্কে সোন (ধন্যবাদ)।’
‘উইলকমেন’
এভাবেই শিখেছিলাম কাকে বলে ‘টি জি আই এফ’।
অথচ সেই ‘শোন ক্লিনিক’ ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড় বেসরকারি অর্থোপেডিক হাসপাতাল। সেখানে ইউরোপের সবচেয়ে বেশী অর্থোপেডিক অপারেশন হত তখন।
তবে হাসপাতাল সপ্তাহে ১৬৮ ঘন্টা খোলা থাকলেও কোনও একজন ডাক্তার, নার্স বা কর্মী এমনকি ৯০ বা ৭০ ঘন্টাও কাজ করে না।
ছবি: একটি অন্তর্জাল থেকে, অন্যটি আমার নিজের তোলা- জানুয়ারী ২০১৫, মিউনিখ।