সবাই বলে ছেলেটি এক ভীতুর ডিম! কারো সাথেই মারামারির নেই সাহস।
মনের ভেতর ছেলেটি খুব একলা মানুষ – পাহাড় দেখে আনমনে সে, লোকের কাছে খুব নীরস!
ছেলেটি খুব আকাশ দেখে একলা ছাদে – শেষ ক’দিনে অনেকটা সে সারিয়ে ক্ষত,
হয়ে গেছে অনেকটা নীল এবং গভীর, যেমনটা চায় মনের মত।
শেষ ক’দিনে বিকেল হলেই নদীর জলে দেখেছে ঢেউ,
পাগল হয়ে স্বচ্ছ জলে মুখ ডুবিয়ে তল খুঁজেছে, দেখেনি কেউ।
শেষ ক’দিনে অনেক মৃত্যু, হরেক রকম ঘটনা আর মানুষ দেখে,
সেই ছেলেটি ভাবছে শুধু – সময় চলে যেতে যেতে মানুষ কত কিছুই শেখে!
শেষ ক’দিনে মাঝে মাঝেই ঘরের কথা পড়ছে মনে – অনেক খুঁজেও কুলকিনারা পায়নি বোধ এ,
শরীর ঢাকা সাদা পোশাক – কাফন যেন! সেটাই নাকি পড়ার নিয়ম এখন অকাল মৃত্যুরোধে!
লাইনে দাঁড়ায় মানুষ এসে – এক এক করে অনুযোগের, অভিযোগের তীর ছুঁড়ে যায়,
‘পরিযায়ী? মৃত্যু নিয়ে ঘুরছো নাকি? – এই বলে রোজ প্রতিবেশী থামিয়ে দেয় মোড়ের মাথায়!’
হাসপাতালে ডিউটি শেষ। অষ্টপ্রহর সেই ছেলেটির কানের ভেতর বাজতে থাকে নিরন্ন স্বর,
‘আপনে যে কন করোনা নাই! দ্যান না লিকে! গেরাম য্যানো ঢুকতি পারি!
মেলা দূরে আমাগো ঘর!’
সাদা প্যাডে সেই ছেলেটি চিঠির মত লিখতে থাকে ‘করোনা নাই, থাকবে ঘরে’, বুক কাঁপে আর হাত নড়ে যায়!
দুঃখ কষ্টে অবাক হয়ে ভাবতে থাকে – তাঁর মত এক ঘরবাড়ি হীন ভবঘুরের কথায় মানুষ কেমন করে ঘর ফিরে পায়?
সেই ছেলেটি বিবশ হৃদয়, গভীর রাতে জানলা খুলে বাইরে তাকায় –
মাস কয়েকের ব্যবধানে দৃষ্টিসীমায় মেঘের মত – ওই তো দূরে
তাঁর গ্রামের ঘর দেখা যায়!
নির্ঘুম এক বাবা-মা এর মুখ অসহায়।
কেমন হবে ডাক্তারি টা ফেলে যদি
এই রাতে সে চুপিচুপি ঘর ফিরে যায়?
একলা তখন সেই ছেলেটি
মুঠোফোনে ‘মা’ কে খুঁজে ডাকতে থাকে!
ঘরের জন্য এই যে এমন ‘মন কেমন’ এর নিবিড় বিষাদ,
এই কথা সে বলবে মা কে।
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে, না ঘুমানো মা এর গলা – কি হলো রে?
বলিস না ক্যান?
খারাপ কিছু?? কি রে খোকা?
সেই ছেলেটি মাকে ভেবে মন খারাপে ছাই চাপা দেয়। – আরে না না। ঘরে যাবো।
মা হেসে কন, পাল্টাবি না তুই কোনদিন!
আসবি ঘরে, এতে আবার বলার কি রে? আস্ত বোকা!
সেই ছেলেটি মাকে বলে – কাল যদি যাই বিকেল বেলা, পরশু রাতে ফিরতে হবে।
মা শুনে তো বেজায় খুশি – বলেন ‘খোকা, আয় দুটো দিন। মুখটাকে তোর শেষ দেখেছি সেই যে কবে! ‘
সেই ছেলেটি খুব খুশি হয় – গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে – অনেক ব্যস্ত রাতের শেষে, অনেক দিনের পর!
সকাল বেলা ঘুম ভেঙে যায় মা এর ফোনে,
কান্নাভেজা গলা – শোন না খোকা, খুব খুশিতে পড়শিকে আজ তোর কথা যেই বলতে গেলাম,
সবাই এলো তেড়ে! তাঁদের কথা – ডাক্তার তো! কোনোমতেই ছেলে যেন না ফেরে ঘর!
বল না খোকা, কিসের পেশা তোর? কিসের এমন কাজ – যে তোকে ভয় করে আজ লোকে?
বল না আমায়, আমি কি আর বুঝতে পারি?
সেই ছেলেটি চোখ মুছে নেয়। হেসে বলে – দোষ কারো নয় মা। ওঁরা কোটি কোটি মৃত্যু ভয়ে ভীত, ওঁরা মরছে বলেই – যমকে রুখি।
শেষ হলে এই মহামারী,
একদিন ঠিক
তোমার ছেলেও পাবে ঘরে ফেরার চিঠি,
সত্যি সেদিন, ফিরবে দেখো ঘরে।
কেউ জানে না –
সেই যে নীরস, ভীতু একলা ছেলে,
কোন সাহসে
কেমন করে সামনে কঠিন মৃত্যু দেখে ও রুটিন মেনে লড়ে!
সেই ছেলেটি মিথ্যেবাদী। জানেই না যে,
সত্যি সেই ফিরবে নাকি …
সেই ছেলেটি সত্যি বলছি বেজায় রকম স্বার্থপর!
সেই ছেলেটির জন্য কি কেউ লিখবে চিঠি – ‘করোনা নেই। আটকাবে না। যাও ফিরে ঘর’?